ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কেন অভ্যাস বদলাবো?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:১৭, ২ মার্চ ২০২১ | আপডেট: ১৭:১৭, ২ মার্চ ২০২১

মানুষ সাধারণভাবে অভ্যাসের দাস। সে সবসময় নিজের তৈরি করা একটা নিরাপদ বলয়ে থাকতে পছন্দ করে। অভ্যাস এবং সংস্কারটা হচ্ছে একটা নিরাপদ বলয়। সেটা মা-বাবার সংস্কার হতে পারে, পিতৃপুরুষের সংস্কার হতে পারে।

আবার এটা অভ্যাস হতে পারে। ধরুন একটা বাচ্চাকে যদি আপনি ডান কাতে শোয়ানোর অভ্যাস করিয়ে ফেলেন, তাকে যদি বাম কাতে শোয়ান, একটু পরেই সে ডান কাতে চলে যাবে। ডান কাত বাম কাত তো বাচ্চা বোঝে না, কিন্তু অভ্যাস।

আমরা আমাদের অধিকাংশ কাজ করি একান্ত নিজেদের চিন্তাভাবনা অভ্যাস এবং সংস্কার দিয়ে। ভুল দেখলেও সেটা আমরা অনুসরণ করি। ঠিক হলেও আমরা সেটা অনুসরণ করি। এই নিয়ে বিখ্যাত গল্প আছে। গল্পটা কয়েকশ’ বছর আগের। যখন ইউরোপে ফ্যামিলি-পরিবার বড় ছিল এবং একত্রিত ছিল। একটা সময় আসলে একান্নবর্তী পরিবারই সারা পৃথিবীতে ছিল।

তো এটা ক্রিসমাসের গল্প। ক্রিসমাসের সবচেয়ে উপাদেয় খাবারের মধ্যে হচ্ছে হ্যাম বা হ্যামরোস্ট। আস্ত শুকরছানার রোস্ট হচ্ছে তাদের খুব ফেভারিট ডিশ। তো এক মেয়ে তার মাকে দেখছে প্রত্যেক বছরই সে যখন হ্যামরোস্ট করে, শুকরছানার রোস্ট করে, তখন এই মাথা-গলার অংশ কেটে দেয় এবং লেজ কেটে দেয়। তারপর ওটা রোস্ট করছে।

তো একদিন তার মনে প্রশ্ন জাগল। জিজ্ঞেস করল মাকে যে মা, তুমি এই রোস্ট করার সময় গলা এবং লেজ কেটে ফেল কেন? মা বললেন যে, আমি এরকমই দেখে আসছি। আমার মাকে এইভাবেই করতে দেখেছি।

মেয়ে বললেন যে, কেন করছ এটা তুমি জান না? বলে যে না, এটা তোমার অতো জানতে ইচ্ছা হলে তোমার নানীকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে। আমার অতো জানার ইচ্ছা নাই।

তো তার কৌতূহল হলো, নানির কাছে গেল। বলল মাকে দেখলাম এটা করতে। মা বলেছে তোমাকেও এভাবেই রোস্ট বানাতে দেখেছে। কারণটা কী? মা বলল যে, তোমাকে জিজ্ঞেস করতে।

তো নানি বলল যে দেখ, আমাকে জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নাই। আমিও আমার মাকে এভাবেই করতে দেখেছি, আমিও করেছি। অতএব, তোমার যদি কিছু জানতে ইচ্ছা হয়, তো তোমার বড় নানীকে অর্থাৎ আমার মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।

তো তার তো কিশোরী-কৌতূহল। গেল তার নানীর মার কাছে। তার আবার অনেক বয়স হয়েছে, একেবারে বৃদ্ধা! কিছু কানে শোনে, কিছু শোনে না। একটা বললে আরেকটা শোনে। যাই হোক, খুব জোরে চিৎকার করে সে বলল।

বলার পরে সে বলল যে, ও আচ্ছা এই হ্যামরোস্টের ব্যাপারে এসেছো জিজ্ঞেস করতে? তাহলে আসল ঘটনা শোনো। আমি যখন এই সংসারে এলাম তখন আমি তরুণী। সংসারে খুব অভাব ছিল।

তো ক্রিসমাসের সময় যে কড়াইতে রোস্ট করা হবে কড়াইটা ছোট ছিল এবং আমাদের বড় কড়াই কেনার সামর্থ্য ছিল না। আস্ত মাথাসহ ঐখানে রোস্ট করা সম্ভব ছিল না। এজন্যে আমরা মাথাটা কেটে, লেজ কেটে যেটুকু পরিমাণ এই কড়াইতে আঁটে সেটুকু পরিমাণ করে রোস্ট করতাম।

তরুণী বলল, তারপরে? বলে যে, কয়েক বছর করতে করতে এটা অভ্যাস হয়ে গেল। এরপরে যখন সংসারে প্রাচুর্য এল, কড়াই বড় হলো, কিন্তু আমার অভ্যাস আর গেল না।

আমি সেই অভ্যাসবশত ঐভাবেই রোস্ট করতাম। তোমার নানীও ঐটা করতে দেখে ঐভাবে রোস্ট করছে। তোমার মা-ও ঐভাবে করছে এবং তুমিও হয়তো ঐভাবেই করবে।

সে বলে যে না, আমি তো বুঝতে পেরেছি তোমরা কেন এটা শুরু করেছিলে। অতএব, আমি আর করব না।

তো এখন এই যে অভ্যাস এই অভ্যাসের বৃত্ত ভাঙা খুব কঠিন কাজ। দৃঢ়তা সম্পন্ন আধুনিক বা প্রাজ্ঞ মানুষ না হলে বৃত্ত ভাঙ্গা খুব কঠিন। আবার বলা যায় আত্মনিমগ্ন না হওয়া পর্যন্ত কেউ আসলে এই অভ্যাসের বৃত্ত ভাঙতে পারে না। অর্থাৎ নিজেকে জানা বা অভ্যাসের কারণ অনুসন্ধানে যাওয়ার মত চিন্তাসম্পন্ন বিজ্ঞান প্রাজ্ঞ মনস্ক প্রাজ্ঞ মানুষ ছাড়া সবাই পারে না। কেন আমরা প্রাজ্ঞ হতে পারিনা? প্রত্যেকের মধ্যে সম্ভাবনা আছে, কিন্তু আমরা এই অভ্যাসের বৃত্তটাকে ভাঙতে পারি না কেন?

এক মহিলা তিনি কখনো ডাব খেতেন না। ডায়রিয়া হলেও তাকে ডাব খাওয়ানো যেত না। বলে যে, না, ডাব খাব না। কেন খাবে না? তার মা খায় না এজন্যে।

তো তাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে, আপনার মা কেন খায় না, কী জন্যে খায় না? মানে এই মহিলার এক ভাই মারা গেছে। তার অসুখ হয়েছিল। তখন সে ভাই ডাব খেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই সময় গ্রামের গাছে ডাব না থাকায় খেতে পারেননি। তখনকার দিনে এখন থেকে ৬০-৭০-৮০ বছর আগে তো বাজারে ডাব পাওয়া যেত না। আর গ্রামের বাজারে তো ডাব ওঠে না এবং ডাব না খেয়েই তার ভাই মারা গেছে। এইজন্যে তার মা ডাব খায় না। যেহেতু মা খায় না, সেও খায় না। সে শুধু শুনেছে, ঘটনা দেখেওনি।

একটা জিনিস হচ্ছে যে, তার মার একটা ইমোশন আছে। ঠিক আছে, আমার ছেলেকে আমি ডাব খাওয়াতে পারিনি, অতএব আমি ডাব খাব না। কিন্তু তার মেয়ে খাবে না এটা তো আরও অযৌক্তিক। এমনকি অসুস্থ হলে যেখানে ডাব প্রয়োজন, খাবে না। তাকে স্যালাইন দিতে হবে, তবুও ডাব খাবে না। 

তো এই যে সংস্কার, অভ্যাস সেটা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই সংস্কারের বৃত্ত হচ্ছে মানুষের জন্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর। বুঝে না বুঝে আমরা বার বার অভ্যাসের বৃত্তে জড়িয়ে যাই।

কোনো ব্যাপারেই আমরা আসলে রিস্ক বা ঝুঁকি নিতে চাই না। কারণ ক্রিয়েটিভিটি বা সৃজনশীলতা একটা রিস্ক। ইট মে ওয়ার্ক অর মে নট ওয়ার্ক। তো এই রিস্কটা সাধারণ মানুষ নিতে চায় না কখনো। 

আবার দেখা গেলো একজন সুস্থ্য, আধুনিক তরুণ যুবক লিফটে উঠেন না। কেন, তার লিফট ভীতি। কোন এক সময় তিনি লিফটে আটকা পড়েছিলেন। তাই এখন লিফটে উঠলেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অর্থাৎ তার ‘সাফোকেশন’  দেখা দেয়। এই যুবক কিন্তু পেশায় একজন ডাক্তার। বিজ্ঞান পড়লেও নেতিবাচকতা, কুসংস্কার থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি।

এই কুসংস্কার, বদ অভ্যাস বা অবিদ্যাকে বলা যায় এক প্রকার মনের আবর্জনা। দীর্ঘদিনের লালিত এসব অভ্যাস বা বদ অভ্যাস মানুষের মনে এক প্রকার রোগ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ মনের অসুস্থতায় শরীরকে অসুস্থ্য করে ফেলা হয়। বিজ্ঞ মানুষেরা বলেন, ভ্রান্ত বিলাস বা বদ অভ্যাস মানুষ নিজেরাই তৈরি করেন অনেকটা মূর্খের মত।

তো এই সংস্কারের বৃত্ত ভাঙার জন্যে নিজেকে জানা বা কেন এই সংকল্প এ ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে গভীরভাবে। এ জন্য প্রয়োজন মেডিটেশন, মৌনতা, নিজের ভেতরে ডুব দেয়া এবং ডুব দিতে দিতে আত্মার সাথে সংযুক্ত হওয়া। যত প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ধর্ম রয়েছে, ধর্মের মূল জিনিসই ছিল এই সংস্কারের বৃত্ত ভাঙা, নিজেকে জানা।

নিজেকে জানা বা বৃত্ত ভেঙ্গে আলোকিত জীবনের পথে যাত্রা শুরুর জন্যে কোনো বড় প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। শুরু করলেই হলো। একবারে অনেক কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু কিছু একটাতো করতে পারবেন। এই একটা কিছু দিয়েই শুরু করুন। আজই নেমে পড়ুন। পথে নামলে পথই আপনাকে পথ দেখাবে। প্রতিটি ধাপ আপনাকে নিয়ে যাবে পরবর্তী ধাপে। প্রথমেই দেখেন কী কী কুসংস্কার বা খারাপ অভ্যাস আছে আপনার। এগুলো আপনার কী লাভ বা ক্ষতি করে। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখুন। তারপর বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিন।

প্রথমেই প্রত্যয়ন করুন আমি বদ অভ্যাস বা অবিদ্যা মুক্ত হবো। ধ্যানে গিয়ে প্রত্যয়ন করুন, আপনি অবিদ্যামুক্ত হবেন। প্রত্যয়ন এই নিয়ত বা লক্ষ্যকেই দেয় সুদৃঢ় ভিত্তি। আর নিয়ত বা লক্ষ্য সুদৃঢ় হলে মন ও মস্তিষ্ক তা অর্জনে কাজ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। তাই ধ্যানের স্তরে হোক বা স্বাভাবিক জাগ্রত অবস্থায়- মনে মনে বার বার প্রত্যয়ন করুন। ভেতরে সৃষ্টি হবে ইতিবাচক অনুরণন। নিয়ত বা লক্ষ্য সুদৃঢ় হবে। সৃষ্টি হবে নতুন বাস্তবতা। আপনি আবিষ্কার করবেন আপনার নতুন ‘আমি’কে। 

দিনে বার বার বলবো- শোকর আলহামদুলিল্লাহ/থ্যাংকস গড/হরি ওম/ প্রভুকে ধন্যবাদ! বেশ ভালো আছি। প্রতিদিন আমি সবদিক দিয়ে ভালো হচ্ছি, লাভবান হচ্ছি, সফল হচ্ছি, সুখী হচ্ছি। আমি প্রো-একটিভ। হতাশা, নেতিবাচক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত রাখবো। কোনো ক্ষোভ ও ঘৃণা যাতে আমার সিদ্ধান্ত ও কাজকে প্রভাবিত না করে সে ব্যাপারে সবসময় সজাগ থাকবো।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি