মেডিটেশন ও সুস্থ জীবনাচার: বিষণ্ণতা প্রতিরোধ ও নিরাময় করে
প্রকাশিত : ১৩:২৩, ২১ মে ২০২২
‘আপনার প্রতিবেশী যখন চাকরি হারায় সেটা মন্দা (Recession), আপনি হারালে যা ঘটে সেটাই বিষণ্ণতা (Depression)।’ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান কথাটা বলেছিলেন কিছুটা কৌতুকচ্ছলেই। কিন্তু বিষণ্ণতার কবলে পড়েন যিনি, তিনিই কেবল বোঝেন এর নিত্যযন্ত্রণা ও মর্মবেদনা। অগণিত ভোগ্যপণ্য আর নিত্যনতুন প্রযুক্তির ভিড়ে মানুষ যখন ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছে নিজেকেই, তখন বিশ্বজুড়ে বিষণ্ণতার প্রকোপ বাড়ছে, এ আর অস্বাভাবিক কী!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে ৩৫ কোটিরও বেশি মানুষ নানা মাত্রায় বিষণ্ণতার শিকার। এ এখন আর নির্দিষ্ট কোনো বয়সের সীমায় আটকে নেই।’ ৬০-এর দশকে বিষণ্ণতা-আক্রান্ত হওয়ার গড় বয়স ছিল ২৯ বছর, এখন তা নেমে এসেছে ১৪-তে!
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কলেজ হেলথ সার্ভের অধীনে সে-দেশের কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের ওপর বিষণ্ণতার প্রকোপ নিয়ে একটি অনুসন্ধান চালানো হয়। কয়েক বছর ধরে পরিচালিত ব্যাপক আকারের এ গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে রীতিমতো ভয়াবহ তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ-ছাত্রদের শতকরা ৪৫ ভাগ মোটামুটি বিষণ্ণতা-আক্রান্ত। আর শতকরা ৮০ জনই রয়েছে বিষণ্ণতা-ঝুঁকিতে।
বিষণ্ণতার কারণ, প্রতিকার ও এটি প্রতিরোধের কার্যকর উপায় নিয়ে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিষণ্ণতা প্রতিরোধ ও নিরাময়ের কয়েকটি উপায় বাতলে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
চাই গভীর সুখনিদ্রা
অনিদ্রা বা গভীর ঘুমের অভাব বিষণ্ণতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ঘুম আর বিষণ্ণতার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কটি বিপরীতমুখী। বিষণ্ণতা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, আবার অগভীর ঘুম ঠেলে দেয় বিষণ্ণতার দিকে। অর্থাৎ ঘুম ভালো না হলে বিষণ্ণতার মাত্রা বাড়ে, আর এর মাত্রা যত বাড়ে ঘুম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ততটাই। এ এক দুষ্টচক্র, কিছুদিন টানা চলতে থাকলে যা পরিস্থিতিকে নিয়ে যেতে পারে আরো খারাপের দিকে।
তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমান। আপনার ঘুমের সঠিক পরিমাণ নির্ভর করে আপনার জীবনযাত্রা ও বয়সের ওপর। গবেষকরা বলেন, স্বাভাবিকভাবে দিনে প্রয়োজন গড়ে ছয় ঘণ্টা ঘুম।
নিয়মিত ব্যায়াম, ওষুধের চেয়েও কার্যকর
ব্যায়ামের সাথে মনোদৈহিক সুস্থতার সুসম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। বলা হচ্ছে, এ-সংক্রান্ত গবেষণায় বিপ্লব ঘটে গেছে। আর তার ফলে মনের সুস্থতার জন্যে শারীরিক পরিশ্রমের গুরুত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করছেন মনোবিদরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক মেডিকেল স্কুলের গবেষক মিশেল ব্যাবিয়াক ও তার সহযোগীরা এ-সম্পর্কিত একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। এ গবেষণায় তীব্র বিষণ্ণতাক্রান্ত ১৫৬ জন রোগীকে নির্বাচন করা হয়- যারা বহুদিন ধরে অনিদ্রা ও ক্ষুধামন্দায় ভুগছিলেন, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও পেয়ে বসেছিল তাদের।
১৫৬ জনকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করেন গবেষকরা। প্রথম গ্রুপকে সপ্তাহে তিন দিন আধঘণ্টা করে হালকা ব্যায়ামের পরামর্শ দেয়া হয়। দ্বিতীয় গ্রুপকে দেয়া হয় বিষণ্ণতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রচলিত ওষুধ। তৃতীয় গ্রুপকে ব্যায়াম এবং ওষুধ দুয়েরই পরামর্শ দেয়া হয়।
চার মাস পর পাওয়া গেল অভূতপূর্ব ফলাফল। তিনটি গ্রুপের মধ্যে শতকরা ৬০ জনেরই অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। প্রমাণিত হলো, বিষণ্ণতা প্রতিকারে ব্যায়াম ওষুধের মতোই কার্যকর।
না, এখানেই শেষ নয়। সুস্থ হওয়া রোগীদের ছয় মাস পর ফলো-আপ করলেন ব্যাবিয়াক। রিপোর্টে দেখা গেল, যারা ওষুধ সেবন করেছিলেন তাদের শতকরা ৩৮ জন এবং যারা ব্যায়াম ও ওষুধ দুয়েরই সাহায্য নিয়েছেন তাদের শতকরা ৩১ জন পুনরায় বিষণ্ণতাক্রান্ত হয়েছেন। আর যারা শুধু ব্যায়াম করেছেন তাদের পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার হার মাত্র শতকরা ৯ ভাগ।
উপসংহারে বলা হয়, বিষণ্ণতা রোধে ওষুধের চেয়েও ব্যায়াম দীর্ঘমেয়াদে অধিকতর কার্যকরী। গবেষকরা বলছেন, হাজারো গবেষণায় এটি এখন প্রমাণিত যে, আমাদের মনোদৈহিক সুস্থতার জন্যে ব্যায়াম দারুণভাবে উপকারী এবং বিষণ্ণতা রোধে এটি সর্বোত্তম পন্থা।
মেডিটেশন আপনাকে সুখী করে
আমাদের সার্বিক সুস্থতার জন্যে মেডিটেশন এক পরীক্ষিত পদ্ধতি। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর বিজ্ঞানীরা রায় দিচ্ছেন, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা থেকে রেহাই পেতে মেডিটেশন অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সহযোগে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তারা বুঝতে সমর্থ হয়েছেন নিয়মিত মেডিটেশন চর্চাকারীদের মস্তিষ্কের গঠন ও গতিপ্রকৃতি।
মানবমস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স। এর বাম দিকটি যাদের বেশি সক্রিয় তারা সুখী। ডান দিকটি বেশি সক্রিয় যাদের তারা কিছুটা মনমরা, বিষণ্ণতা। ইইজি ও এমআরআই-এর সাহায্যে নিয়মিত মেডিটেশন চর্চাকারীদের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের বাম দিকটি বেশি সক্রিয়। তারা ইতিবাচকতায় উদ্দীপ্ত এবং নেতিবাচক আবেগের মুখে ততটাই দৃঢ়, অটল।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, মেডিটেশনের সুফল পেতে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের মতো এটি সারাদিন চর্চা করতে হবে তা নয়, দিনে ১৫ মিনিট ধ্যানচর্চাও এনে দিতে পারে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন।
রক্তের শর্করা-মান রাখুন নিয়ন্ত্রণে
বিষণ্ণতা রোধে রক্তের শর্করা-মান নিয়ন্ত্রণ একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। রক্তের শর্করা-মান কমে গেলেও মনের আকাশে জমতে পারে বিষণ্ণতার কালো মেঘ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শরীর আর মন পরস্পর গভীরভাবে সংযুক্ত। একটি বিকল হলে পিছু নেয় অন্যটিও।
সাধারণত রক্তে শর্করা-ধস (Low Blood Sugar) নেমে আসে শর্করা-তুঙ্গতার (High Blood Sugar) পথ ধরেই। তাই রক্তে শর্করার পরিমাণ অতিরিক্ত বাড়তে না দেয়াটাই হবে শর্করা-ধস ঠেকানোর মোক্ষম উপায়। এজন্যে একবারেই বেশি নয়, বরং একই পরিমাণ শর্করা সারাদিনে খেতে হবে ভাগ ভাগ করে। সাথে প্রোটিন ও ফ্যাটের পাশাপাশি চাই আঁশজাতীয় খাবার (প্রতি এক হাজার ক্যালরিতে ন্যূনতম ১২ গ্রাম)।
খুঁজে নিন আনন্দের কাজ
আপনার পছন্দের কিংবা ভালোলাগার কাজ কোনটি, সবচেয়ে ভালো জানেন তা আপনিই। সে কাজে ডুবে গেলে দুশ্চিন্তা ক্লেদ কষ্টের কোনো অনুভূতিই স্পর্শ করে না আপনাকে। আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন আপনি। এমন কাজে সময় দিন। আনন্দময় সময় কাটান। আপনি ভালো থাকবেন। বিষণ্ণতার স্মৃতি থাকবে অনেক দূরে।
তাই আপনার পছন্দের কাজটি খুঁজে বের করা জরুরি, যে কাজের আনন্দ কখনো ফুরিয়ে যায় না। হতে পারে তা ছবি আঁকা, লেখা, খেলাধুলা কিংবা আত্ম উন্নয়নমূলক কাজে সময় ব্যয় এবং মানুষের জন্যে কাজ করা।
একা নয়, থাকুন একসাথে
মহীয়সী মাদার তেরেসার কথা হলো, ‘একাকিত্ব আর মমতাহীনতার অনুভূতিই সবচেয়ে ভয়াবহ দারিদ্র্য।’ বলা যায়, সেই দারিদ্র্যেই ভুগছে আধুনিক মানুষ। এত পণ্যের অবিরাম প্রাচুর্য, কিন্তু বাড়ছে স্বজনহীন মমতাহীন নিঃসঙ্গ দিনযাপনের ঘটনা।
আজকের পৃথিবীতে বিষণ্ণতার হার বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ এটিই, বলছেন গবেষকরা। সামাজিক সম্পর্কগুলোতে তো বটেই, চিড় ধরেছে পারিবারিক সম্পর্কের উষ্ণতায়ও। অতিরিক্ত চাপ, টিভি আর হরেক রকম প্রযুক্তি ভীষণভাবে প্রভাবিত করছে আমাদের প্রিয় সম্পর্কগুলোকে।
অথচ বন্ধু স্বজন প্রতিবেশীদের সাথে হাসি-আনন্দে সময় কাটানোকে স্বাস্থ্যকর সামাজিক পথ্য (Healthy Social Medicine) হিসেবে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, ‘নিঃসঙ্গ মানুষের ওপরই বিষণ্ণতার আক্রমণ বেশি। আবার বিষণ্ণতা পেয়ে বসে যাদের, তারাও একাকীই থাকতে চান। এতে বিষণ্ণতা বাড়ে বৈ সারে না।’
তাই পরিবারের সাথে সময় কাটান, বন্ধু আত্মীয় পরিজনদের সুখ-দুঃখের সাথী হোন। মমতা দিন। একা নয়, থাকুন একসাথে। পরিবারের সাথে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের সাথে। সবার সাথে। সবার পাশে। সবাইকে নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান। পরার্থে কিছু করুন। বিষণ্ণতা আপনার ধারেকাছে ঘেঁষার সুযোগই পাবে না!
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে জনপ্রিয় সেই আফ্রিকান প্রবাদটির কথা- ‘যদি তুমি দ্রুত যেতে চাও তবে একা যাও, আর যদি বহুদূর এগিয়ে যেতে চাও তাহলে সবাইকে সাথে নিয়ে যাও।’
উল্লেখ্য, পৃথিবীতে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালিত হচ্ছে ২১ মে। বাংলাদেশে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস উপলক্ষে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এদেশে মেডিটেশন চর্চার ইতিহাসে গত ৩০ বছর ধরে এককভাবে নেতৃত্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ভালো মানুষ ভালো দেশ স্বর্গভূমি বাংলাদেশ’। সারাবিশ্বে যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিষণ্ণতাসহ সবরকম মানসিক রোগের প্রকোপ, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হ্রাস পাচ্ছে সবদিক থেকে সুস্থ ও ভালো মানুষের সংখ্যা। মানসিক সকল রোগের মোক্ষম দাওয়া হলো মেডিটেশন।
লেখক: কনসালটেন্ট, সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্ট, ইউনাইটেড হসপিটাল।
এসএ/