ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৬ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

ফিটনেস কি শুধুই দেহের?

ডা. মনিরুজ্জামান

প্রকাশিত : ১৩:১৩, ৩ জানুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ১৫:৩৩, ৩ জানুয়ারি ২০২৩

Ekushey Television Ltd.

ফিটনেস বলতে বেশিরভাগ মানুষই শারীরিক ফিটনেসকে বোঝে। কিন্তু শারীরিক ফিটনেস আসলে টোটাল ফিটনেসের চার উপাদানের একটি। বাকিগুলো হলো- মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক ফিটনেস। এই চারটি মিলেই একজন মানুষ হন টোটালি ফিট।

শারীরিক ফিটনেসের জন্যে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন নিয়মিত দমচর্চা। কল্পনা করুন, আপনার সামনে বাতাসভর্তি একটা পেয়ালা। পেয়ালার বাতাসকে চার ভাগে ভাগ করে নিন। এবারে নাক দিয়ে হু করে একভাগ দম টেনে নিন। তারপর একে একে আরো তিনভাগ। কল্পনা করুন পুরো বুকটা ফুলে উঠেছে। এবারে মুখ দিয়ে ফু করে ছাড়ুন। প্রথমে একভাগ, তারপর ধীরে ধীরে আরো তিনভাগ। কল্পনা করুন দম ছাড়তে ছাড়তে বুকের ফোলাটা একদম নেমে গেছে। এভাবে দিনে কয়েকবার দম চর্চা করলে, আপনি নিজেই অবাক হবেন আপনার প্রাণবন্ততা দেখে। 

ডা. মনিরুজ্জামান

প্রাকৃতিক ও তাজা খাবার খান। বর্জন করুন ফাস্ট ফুড, প্রসেসড ফুড ও চিনি। গবেষকদের মতে দেশের ৭০ ভাগ মৃত্যুই এখন হচ্ছে হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগগুলোতে। আর এর প্রধান কারণ খাবার। ফাস্টফুড যে কত ক্ষতিকর হতে পারে দেহের জন্যে তার একটি গবেষণা করেছেন লন্ডনের কিংস কলেজের প্রফেসর টিম স্পেকটার তার ছেলেকে নিয়ে। ছেলেকে তিনি টানা ১০ দিন শুধু ফাস্টফুড আর ড্রিংকস খেতে বলেন। বার্গার, চিকেন নাগেটস থেকে শুরু করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং যতরকম প্রসেসড ফুড। বলেন বিল তিনি দেবেন। ছেলেও খাওয়া শুরু করল। তিনদিন পর সে খুব ল্যাথারজিক বা অবসন্ন বোধ করা শুরু করল। বন্ধুরা বলতে লাগল- টমের চুলে নাকি একটু একটু পাক ধরেছে। সবচেয়ে খারাপ হয়েছিল তার পেটের মাইক্রোবায়োম বা অণুজীবের অবস্থা।

আমাদের পেটে প্রায় ১৪০০ ধরনের উপকারি ব্যাকটিরিয়া বা মাইক্রোবায়োম আছে যাদের কাজ হলো খাবার হজম থেকে শুরু করে দেহে কী পরিমাণ ফ্যাট জমা থাকবে বা বার্ন হবে, রক্তের দূষণ কতটা নিয়ন্ত্রিত হবে, লিভার বা কিডনি কীভাবে নিরাপদ থাকবে- ইত্যাদি বহুতর বিষয় নির্ধারণ করা।

টিম স্পেকটারের ছেলের স্টুল পরীক্ষা করে দেখা গেল তার পেটের ৪০% মাইক্রোবায়োমই ধ্বংস হয়ে গেছে টানা ১০ দিন এই ফাস্ট ফুড খাওয়ার ফলে। লন্ডনের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রিটিশ গাট প্রজেক্ট যৌথভাবে এই ফলাফল জানায়। শুধু তাই না, খাবার বা ফুড মানুষের ব্রেনকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি জন্মের আগে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায়ও!

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ফিলিস জাকা ২৩ হাজার মা-কে নিয়ে একটা গবেষণা করেছেন। যেখানে তিনি দেখেছেন গর্ভাবস্থায় যেসব মায়েরা জাংক ফুড, প্রসেসড ফুড, ফিজি ড্রিংকস এবং সল্টি স্ন্যাকস যেমন- চিপস, কেক, বিস্কিট ইত্যাদি খেয়েছেন তাদের সন্তানেরা বেশ মেজাজী, অস্থির আর আক্রমণাত্মক হয়েছে সেসব বাচ্চাদের তুলনায় যাদের মায়েরা গর্ভাবস্থায় বেশি বেশি প্রাকৃতিক ও তাজা খাবার খেয়েছেন হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার ও প্রসেসড ফুডের বদলে। এমনকি বিষণ্নতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং দুঃস্বপ্নে ভোগার মতো সমস্যাও দেখা গেছে এই শিশুদের মধ্যে।

সাদা চালের পরিবর্তে বেছে নিন লাল চাল। খেতে পারেন সজনে পাতা গুঁড়ো- পাশ্চাত্যে যা মরিঙ্গা হিসেবে পরিচিত। আর কাঁঠালের বিচি-এতই সুলভ যে আমরা কোনো গুরুত্বই দিই না। অথচ বিজ্ঞানীরা বলেন, কাঁঠালের বিচি হলো খনিজ ও ভিটামিনের ভাণ্ডার! 

ইয়োগার গুরুত্ব তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আর কোয়ান্টাম ইয়োগা হচ্ছে ইয়োগারও সর্বাধুনিক সংস্করণ! এই কোয়ান্টাম ইয়োগার একটি আসন বঙ্গাসন যা চর্চা করে আপনি পেতে পারেন বহুমুখী উপকার! মেঝেতে বা ম্যাটে হাঁটু থেকে পা ভাঁজ করে বসুন। পায়ের পেশীর সাথে ঊরুর পেশী লেগে থাকবে এবং নিতম্ব মেঝে স্পর্শ করবে না। শরীরের উপরের অংশ সামনের দিকে বেশি না-ঝুঁকিয়ে মেরুদণ্ড যথাসম্ভব টান টান রাখার চেষ্টা করুন। পায়ের আঙুলগুলো মেঝেতে লেগে থাকবে, ভর থাকবে পায়ের গোড়ালিতে। দু’পায়ের মাঝে ফাঁকা থাকবে এক হাত বা যতটুকু আরামদায়ক হয় ততটুকু। হাত দুটো থাকবে হাঁটু ঘিরে অথবা হাঁটুর ওপরে। শরীরের ভর ছেড়ে দিতে হবে। এই অবস্থায় স্থির থাকুন। ব্যাস, হয়ে গেল বঙ্গাসন!

মানসিক ফিটনেসের অধিকারী মানুষ আসলে প্রশান্ত বিশ্বাসী সাহসী ও সমমর্মী একজন মানুষ। আর এ ফিটনেস গড়ে তোলার সবচেয়ে কার্যকর প্রক্রিয়া হলো মেডিটেশন। মেডিটেশনকে বলা যেতে পারে ব্রেনের ব্যায়াম। নিউরোসায়েন্টিস্টরা বিস্তারিত পরীক্ষানিরীক্ষা করে বলেছেন- দৌড়ালে যেমন মানুষের পায়ের পেশির শক্তি বাড়ে, দমচর্চা করলে যেরকম ফুসফুসের শক্তি বাড়ে, সাঁতার কাটলে কাঁধ এবং হাতের শক্তি বাড়ে, একইভাবে নিয়মিত মেডিটেশন করলে ব্রেনের সিঙ্গুলেট কর্টেক্সে গ্রে ম্যাটার বাড়ে। যা একজন মানুষকে গভীর মনোযোগ দেয়ার সামর্থ্য বাড়ায়। যখন একজন মানুষ নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা করেন তখন তার ভেতরে করতে পারার শক্তি জাগ্রত হয়। তার আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। তার ভাবনায় দানা বাঁধতে থাকে- আমি পারি আমি করব। এবং যখন মনে এই ভাবনা দানা বাঁধে তখন তার ব্রেন সেই লক্ষ্যেই কাজ করতে শুরু করে। পাশাপাশি, অন্যের প্রতি মমতাসহ সকল মানবিক গুণ অর্জন করাও মানসিক ফিটনেসের প্রমাণ।

সোশ্যাল ফিটনেসের জন্যে দরকার সকলের সাথে মেলামেশা করার সক্ষমতা অর্জন। loneliness is a growing health epidemic- একাকিত্ব হতে যাচ্ছে আগামীর স্বাস্থ্য মহামারি। বলছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা সার্জন জেনারেল ডক্টর বিবেকমূর্তি।

একাকিত্ব ও দুর্বল সামাজিক যোগাযোগের এত বিরূপ প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর যে দিনে ১৫টি সিগারেট খেলে যে পরিমাণ আয়ু কমে, একাকিত্বে ভুগলে আপনার আয়ু ততটাই কমতে পারে। আর এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ সাম্প্রতিক করোনা মহামারি কাল। জীবাণুর প্রকোপে যত না মানুষ কাবু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কাবু হয়েছে প্রিয়জনের মমতা, প্রিয়জনের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে। সোশাল ফিটনেসের জন্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, বাড়াতে হবে বাস্তব জীবনে সামাজিক যোগাযোগ। আর করতে হবে অভিবাদন, কুশল, সম্ভাষণ ও সালামের চর্চা।

একাকিত্ব মহামারি থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে ধনী দেশগুলো এখন অভিনব সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, খরচ করছে কোটি কোটি ডলার। ইংল্যান্ড ‘মিনিস্টার ফর লোনলিনেস’ নিয়োগ করেছে। মার্কিন সেনাবাহিনী ফিজিক্যাল ফিটনেসের পাশাপাশি সৈনিকদের সোশাল ফিটনেস বাড়াতে করাচ্ছে ওয়ার্কশপ। সম্প্রতি আমেরিকায় একটি মিডিয়া ক্যাম্পেইন বেশ জনপ্রিয় হয়েছে- ‘Just say hello!’ পরিচিত হোক বা অপরিচিত, যার সাথেই দেখা হবে তাকেই ‘হ্যালো’ বলো!
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কগনিটিভ এন্ড নিউরোসায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক জন কাসিওপ্পো ২০ বছর ধরে নিঃসঙ্গতা নিয়ে গবেষণা করছেন।

তিনি বলেন, “পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে হ্যালো বলার অভ্যাস তোমার সোশাল মাসল বাড়াবে!” 

এই সবগুলো ফিটনেস অর্জনের পরও ফিটনেট প্রয়াস অপূর্ণ থেকে যাব যদি না আত্মিক ফিটনেসের পথে আপনি না এগোন। মানুষ জন্মগতভাবেই উপাসনা করতে চায়, প্রার্থনা করতে চায়। চায় উচ্চতর কারো কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে। নিজ নিজ ধর্ম আন্তরিকভাবে পালনের মাধ্যমেই মানুষ খুঁজে নিতে পারে তার এই আত্মিক ফিটনেসকে। নৈতিকতা, শুদ্ধাচারের অনুশীলন তার ভেতরে সঞ্চার করে শুকরিয়া আর প্রশান্তির এমন এক স্ফূরণ, বাস্তব জীবনের কোনোকিছুই যাকে নষ্ট করতে পারে না। 

এই চার ফিটনেস নিয়ে সচেতন হতে পারলেই আমরা ধীরে ধীরে টোটাল ফিটনেসের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো। আর সুস্থ দেহ, প্রশান্ত মন, কর্মব্যস্ত সুখী জীবন উপভোগ করবো।

লেখক: কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব’র কো-অর্ডিনেটর। 

এএইচএস
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি