সন্তানের স্মার্টফোনের নেশা কাটানোর উপায়
প্রকাশিত : ১৭:০০, ২৩ মে ২০২৩
জার্মানির হামবুর্গে শিশুরা কয়েকবছর আগে মিছিল নিয়ে নেমেছিল রাস্তায়। এসময় তারা স্লোগান তোলে, 'আমরা আজ পথে, কারণ আমাদের বাবা-মায়ের চোখ মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে।' বাবা-মায়ের অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তির প্রতিবাদে তাদের এই মিছিল অভিভাবকদের টনক নাড়ানোরই ইঙ্গিত দেয়।
তাই আপনি যদি আপনার সন্তানের স্মার্টফোনের নেশা কাটানোর উপায় খুঁজতে যান তাহলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হলো আপনাকে স্মার্টফোনে সময় কমিয়ে সময় দিতে হবে আপনার সন্তানকে।
বিষয়টি ঠিক এরকম- টিভির সাউন্ড মিউট করা অবস্থায় আপনি যেমন একজন উপস্থাপকের শুধু ঠোট নড়তে দেখবেন, উপস্থাপকের কথা যেমন আপনার কানে প্রবেশ করবে না, ঠিক একইভাবে আপনার সন্তানকে যতই আপনি মোবাইল থেকে দূরে থাকতে বলবেন, আপনার কথাগুলো সন্তানের কাছে ঠিক টিভির মিউট করা ক্যারেক্টারের মতোই মনে হবে, যদি আপনি নিজে স্মার্টফোন বেশি বেশি ব্যবহার করেন।
অর্থাৎ সন্তানরা স্বভাবতই তাদের বাবা-মাকে অনুকরণ করে বেশি।
সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে বিস্ময়কর কিছু তথ্য। বর্তমানে একজন মানুষের ‘স্ক্রিন টাইম’ দিনে গড়ে প্রায় ৭ ঘণ্টা! ২৪ ঘণ্টায় মানুষ ফোন স্পর্শ করে গড়ে ২,৬১৭ বার!
একজন মানুষ সারাদিনে যতক্ষণ সজাগ থাকে, তার ৪৪ ভাগ সময়ই কোনো না কোনো স্ক্রিনের সামনে থাকে! স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বছরের মোট ৭৫ দিন কেটে যাচ্ছে!
এই অবস্থা থেকে মুক্ত নয় শিশুরাও। কারণ তারা তাদের বাবা-মাকেই অনুসরণ করে। আর ৯ বছরের একটি শিশু মোবাইল ফোনে ব্যয় করে ২ ঘণ্টারও বেশি!
মাদ্রাজ আইআইটির লিডারশিপ কোচ ও মনোবিজ্ঞানী বিদ্যা রাগুর মতে, সন্তানের স্মার্টফোনের নেশা কাটানোকে একটি যুদ্ধ হিসেবে নিতে হবে। আর এই যুদ্ধটি মোকাবেলা করার জন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে যা করতে হবে তা হলো, ব্যাট হাতে মাঠে নেমে যেতে হবে, কারণ আপনি জানেন না কখন বল আপনাকে আঘাত করতে পারে। যাতে প্যারেন্টসরা তাদের এই ব্যাটিং স্কিলটি শক্ত-পোক্ত করতে পারে।
অবশ্য বাস্তবে এই ব্যাটটি ঠিক ক্রিকেট ব্যাট নয়। এটি হলো চারটি সহজ পদক্ষেপ যা আপনার সন্তানের স্মার্টফোনের নেশা কাটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। যাকে বিদ্যা রাগু বলেছেন, ব্যাটস (BATS) স্টেপস।
তাহলে কী আছে ব্যাটস স্টেপস এ, আসুন দেখে নেয়া যাক...
এখানে B মানে Boredom (একঘেয়েমিতা), A মানে Alternatives (বিকল্প ব্যবস্থা), T মানে Time (সময়) এবং S মানে Support & Surroundings (সহযোগিতা ও পারিপার্শ্বিকতা)।
১. Boredom (একঘেয়েমিতা)
বাসায় শিশু থাকলে আজকাল একটি কথা ‘কমন’ পড়তে পারে আপনারও। কিছুক্ষণ পরপর এসে বলবে সে ‘বোর’ হচ্ছে। আর তারপরের আবদারই থাকে স্মার্টফোন ব্যবহারের। সারা দিন নাওয়া-খাওয়া ফেলে গেম বা ভিডিও দেখেই পার হয়ে যাচ্ছে সময়।
তাই ছবি আঁকা বা ক্র্যাফটিং শিশুর কল্পনার জগৎ আরও উন্মুক্ত করতে হাতে তুলে দিতে পারেন রং আর তুলি। কৌটার রং, রং পেনসিল, আর্ট পেপার, ইজেল কিনে দিন তাকে।
মুঠোফোনে গেম বা ভিডিও থেকে তার চোখ ফিরিয়ে আনুন সাদা কাগজে। যেখানে নিজের কল্পনার জগৎ তৈরি করবে শিশু। তার আঁকা ছবির প্রশংসা করুন, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করুন।
শেখাতে পারেন কাগজ দিয়ে নানা রকম খেলনা বা উপকরণ বানানোর কৌশল।
সারাদিন পাঠ্যবই পড়ার চাপে শিশু যেন বই দেখলেই দৌড়ে না পালায়। তাকে কিছুটা সময় দিন নিজের পছন্দমতো বই পড়তে।
কমিকস, রহস্য-রোমাঞ্চ, ভূতের গল্পের মতো নানা ধরনের বই পড়তে ভালবাসে শিশুরা। নতুন বই কিনে তাকে বই পড়ায় উৎসাহ দিতে পারেন।
অনেক শিশুই এখন রান্না করতে ভালবাসে। জুস বানানো, কেক বা কুকিজের মতো বেকিং আইটেমও শেখাতে পারেন সন্তানকে। বেশি ছোট হলে টুকটাক রান্নার কাজে সাহায্যকারী হিসেবে তাকে সঙ্গে নিতে পারেন।
শুরুতে রান্নার উপকরণ নিয়ে আলোচনা, শাকসবজি ধোয়া, তার নিজের রুটি নিজেকে রোল করতে দেওয়ার মতো কাজ দিতে পারেন।
২. Alternatives (বিকল্প ব্যবস্থা)
সন্তানকে স্মার্টফোনের পরিবর্তে বিকল্প বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে নাচ, গান বা আবৃত্তির মতো সাংস্কৃতিক পরিবেশে আগ্রহী করতে পারেন। তবে কোনোটাই বেশি চাপ দিয়ে শেখানোর দরকার নেই, বরং তার যেদিকে আগ্রহ, সেদিকে উৎসাহ দিন।
কেউ হয়তো ঘুঙুরের তাল ভালবাসবে, কেউ চাইবে হারমোনিয়ামে বসে সুর-তালের খেলায় মজতে।
তাই শিশুকে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত রাখুন বাড়িতে। এতে সে আনন্দ খুঁজে পাবে।
আপনার সন্তানকে খেলাচ্ছলে নিরীক্ষার দিকে উৎসাহিত করতে পারেন।
বয়স বুঝে তাকে দূরবীন, অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা ছোট কোনো রিসাইকেল করা যায় এমন উপকরণ সরবরাহ করতে পারেন।
এরপর সেসব কীভাবে কাজ করে, সেটা দেখিয়ে দিন। শিশুরা সাধারণত উদ্ভাবনী বিষয়গুলোতে উৎসুক হয়ে থাকে। এতে খেলাচ্ছলে সে পরবর্তী জীবনে বিজ্ঞানী বা উদ্ভাবনী কাজে আগ্রহী হতে পারে।
৩. Time (সময়)
বাসায় বসে নানা রকম পাজল মেলানোর উপকরণ কিনে দিতে পারেন শিশুকে। রুবিকস কিউব মেলানোর জন্যে উৎসাহ দিতে পারেন। বয়স কম হলে ছবির পাজল মেলাতে দিতে পারেন।
লুডু, ক্যারম, দাবার মতো বেশ কিছু খেলা আছে, যা বাসায় সময় কাটানোর জন্য ভালো। সন্তানকে এসব খেলাধুলায় উৎসাহ দিতে পারেন।
দাবার চাল শিশুর বুদ্ধি বিকাশে সহায়ক হবে। লুডু বা ক্যারম খেলতে খেলতে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বাড়তে থাকবে।
নানা রকম ধাঁধা, দেশ বা রাজধানীর নামবিষয়ক খেলাও খেলতে পারেন সন্তানদের নিয়ে। এতে মজা করে পয়েন্ট অর্জনের ওপর উপহার থাকতে পারে তাদের জন্য।
প্রতিটি মায়েরই সন্তানের ওপর থাকা সাধারণ অভিযোগ হলো- ঘর না গোছানো। ঘর গোছানোর অভ্যাসে গড়ে তোলার এর থেকে ভালো সময় আর হয় না।
তাদের পুরনো কাপড় আলাদা করাতে পারেন তাদেরকে দিয়েই, যা সুবিধাবঞ্চিতদের দান করা যেতে পারে।
নিজের ঘরটা জীবাণুমুক্ত করার দায়িত্ব দিতে পারেন তাদের ঘাড়েই, সম্ভব হলে পুরো বাসা।
৪. Support & Surroundings (সহযোগিতা ও পারিপার্শ্বিকতা)
সন্তানকে তার প্রতিটি কাজে তাকে গাইড করা, কাজটি কীভাবে করতে হবে তা দেখিয়ে দেয়া। যেমন- স্কুলের হোমওয়ার্ক এ সহযোগিতা করা।
ঘরের খুঁটিনাটি কাজ জানা উচিৎ কিশোর-কিশোরীদেরও। যেমন- বিদ্যুতের ‘মেইন সুইস’ বন্ধ ও চালু করা, লাইট বদলানো, সাধারণ ক্ষত ড্রেসিং করা, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় ভারি বৈদ্যুতিক যন্ত্র বন্ধ রাখা, অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র চালানো ইত্যাদি। ডায়বেটিস মাপা, প্রেশার মাপা, নাড়ি মাপা, ‘সিপিআর’ ইত্যাদিও শেখানো যেতে পারে।
পারিবারিক আর্থিক সাহায্যের ছায়া থেকে বেরিয়ে সব সন্তানকেই একদিন সংগ্রামের পথ বেছে নিতে হবে। তবে সেদিন যেন সে হোঁচট না খায় এবং আপনার কষ্টার্জিত অর্থ যেন অপচয় না হয় সেই লক্ষ্যে তাদের শেখাতে পারেন অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা।
আমাদের করণীয়
> স্মার্টফোন ব্যবহারে পরিমিতি আনতে হবে। পেশাগত বা শিক্ষাগত প্রয়োজনে যদি ফেসবুক ব্যবহার করতে হয় স্মার্টফোনের পরিবর্তে ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ ব্যবহার করুন।
> বয়স ১৮-এর আগে সন্তানের হাতে স্মার্টফোন দেবেন না। মমতা দিয়ে বোঝান স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক।
> সন্তানকে পরিবারের অংশ হিসেবে বড় করুন।
> ভার্চুয়াল যোগাযোগের পরিবর্তে বাস্তবে সামাজিক যোগাযোগ বাড়ান।
> ডিজিটাল ডায়েট ও ডিজিটাল ফাস্টিং করুন।
একটি শিডিউল তৈরি করুন, যখন আপনি ও আপনার সন্তান সচেতনভাবে সব ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস বা গ্যাজেট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন, তা হোক স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা আইপ্যাড।
এমএম/