কর্মক্ষেত্রে শুদ্ধাচার
প্রকাশিত : ১৫:৪৮, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
কর্মজীবীদের সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয় কর্মক্ষেত্রে। বস সহকর্মী সহযোগী প্রতিযোগী অধস্তন অভ্যাগত সেবাপ্রার্থী পরিচিত অপরিচিত−বহু মানুষের সাথে প্রতিদিন আলাপ-আলোচনা ও লেনদেন করতে হয়। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, সুন্দর আচরণ, কুশলী ও হৃদ্যতাপূর্ণ সংযোগায়নের ওপরই নির্ভর করে আপনার কর্মজীবনের সাফল্য।
আর অঢেল অর্থ উপার্জন বা অন্যকে ডিঙিয়ে সামনে এগোনোই ক্যারিয়ারের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়; বরং মেধাকে সেবায় রূপান্তরিত করে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাওয়াই হোক আপনার কর্মজীবনের ব্রত।
এ পর্বে রয়েছে কর্মক্ষেত্রে সার্বিকভাবে করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ে দিক-নির্দেশনা। স্থানকালপাত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তরিকভাবে এ নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করুন। কর্মক্ষেত্রে আপনি হয়ে উঠবেন নির্ভরযোগ্য ও সফল।
ক্যারিয়ারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি
> প্রতিষ্ঠানে নিজের কাজকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করুন।
> দায়িত্ব নিতে শিখুন। কাজকে ভালবাসুন। কাজের সুযোগ পেলে মন থেকে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।
> আপনাকে কাজ দেয়া হলে যদি আপনি বিরক্ত হন, তাহলে এমন সময় আসবে, যখন কাজ আর আপনার কাছে আসবে না। কাজকে যে ভালবাসে, কাজ তার কাছেই আসে।
> কর্মক্ষেত্রে কখনো বিরক্তি, বিরসভাব ও হতাশ চেহারায় থাকবেন না। বিরক্তিভাব কাজের বরকত নষ্ট করে দেয়। যত সমস্যা বা চ্যালেঞ্জই আসুক ইতিবাচক ও হাসিখুশি থাকুন।
> পেশাগত সাফল্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে অপরিহার্য নয়, সহায়ক মনে করুন।
> কোথাও ইন্টারভিউ দিতে গেলে পূর্বতন কর্মস্থল সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না।
> উপার্জনের উৎস সৎ ও শ্রমলব্ধ হলে কোনো কাজকেই হেয় মনে করবেন না।
> বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভাবতেই ব্যস্ত থাকবেন না। কাজ ফেলে রেখে এ নিয়ে সহকর্মীদের সাথে সমালোচনা-পর্যালোচনা করবেন না। নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। বর্তমান প্রতিষ্ঠান আপনার মূল্যায়ন করতে না পারলেও প্রাকৃতিকভাবে আপনি পুরস্কৃত হবেনই।
> কেরানি মানসিকতায় ভুগবেন না। ব্যবস্থাপকীয় দৃষ্টিভঙ্গি লালন করুন।
> যথাযথ প্রয়াস না চালিয়ে ‘কাজ হয়ে যাবে, সমস্যা নেই’−এ ধরনের বাক্য ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করুন।
> মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আপনার কাজে কোনো ধরনের ভুল হলে গোপন করবেন না। আপনি বুঝতে পারার সাথে সাথেই পদস্থকে জানান। এতে ভুল সংশোধনের জন্যে পদক্ষেপ নেয়া সহজ হবে।
> অন্যের ব্যর্থতাকে নয়, সাফল্যকে অনুসরণ করুন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতার মুখে অন্য সহকর্মীর উদাহরণ দেবেন না যে, ‘এই ভুল তো অন্যেরাও করে, শুধু আমাকে বলছেন কেন?’
> অল্প সময়ে এত কাজ কীভাবে করব−এ মানসিকতা পরিহার করুন। অপর্যাপ্ত সময়কে প্রতিবন্ধক মনে করবেন না। সময়কে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগান। এটিই সাফল্যের অন্যতম সূত্র।
> নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোকে নিজের কাজ ও আমানত মনে করুন।
> উপরি আয়/ বাড়তি সুবিধা পেতে অন্যায়ভাবে ফাইল/ বিল বা কাজ আটকে রাখবেন না। নৈতিক মানদণ্ডে সৎ থাকলে প্রাকৃতিকভাবে আপনি পুরস্কৃত হবেন। মনে রাখুন, নিজের কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করাই প্রকৃত দেশপ্রেম।
কর্মক্ষেত্রে অনুসরণীয়
> নির্ধারিত সময়ের কমপক্ষে পাঁচ মিনিট আগেই কর্মস্থলে উপস্থিত হোন।
> বাইরে অফিসিয়াল কোনো কাজ না থাকলে অফিসে প্রবেশের ও অফিস থেকে বের হওয়ার নির্দিষ্ট সময় অনুসরণ করুন।
> মধ্যাহ্ন বিরতিতে বেশি সময় নেয়া, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া প্রায়শই অফিস শুরুর পরে আসা, নির্ধারিত সময়ের আগে অফিস ত্যাগ করা−এ ধরনের আচরণ বর্জন করুন।
> নির্দিষ্ট বিরতির সময় ছাড়া ব্যক্তিগত কাজে অফিসের বাইরে যাবেন না। কোথাও গেলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন।
> প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট চাকরিবিধি জেনে নিন ও মেনে চলুন।
> সহকর্মীর ই-মেইল, এসএমএস বা চিঠিপত্রের প্রত্যুত্তরে তৎপর হোন। ফোনে আপনাকে না পেলে প্রথম সুযোগেই কল ব্যাক করুন।
> অফিসের কাজে হলেও দীর্ঘক্ষণ ধরে ফোনালাপ এড়িয়ে চলুন। এ-ক্ষেত্রে ফোন ও ই-মেইল ব্যবহারের শুদ্ধাচারগুলো মেনে চলুন।
> জরুরি কাজের সময় অন্য ডিপার্টমেন্ট বা টিমের কেউ কোনো সাহায্য চাইলে তা করার আগে আপনার লিডারের অনুমতি নিন।
> অন্য ডিপার্টমেন্ট বা টিমের কারো সহযোগিতা আপনার প্রয়োজন হলে আগে তার টিম লিডারের সাথে কথা বলুন।
> অন্য ডিপার্টমেন্ট বা টিমের কারো সহযোগিতা আপনার প্রয়োজন হলে আগে ফোনে/ সরাসরি কথা বলে সময় চেয়ে নিন। তাদের জরুরি কর্মমুহূর্তে আচমকা হাজির হয়ে কাজ ধরিয়ে দেবেন না/ কাজের কথা শুরু করবেন না।
> সঠিক তথ্য-উপাত্তের জন্যে প্রত্যক্ষ উৎস বা মূল দায়িত্বশীলের সাথে যোগাযোগ করুন।
> চাকরি ছাড়তে হলে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী আগেই কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন।
পোশাক-পরিচ্ছদ
> অফিসে নির্দিষ্ট ড্রেস কোড অনুসরণ করুন। ড্রেস কোড না থাকলেও নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, মার্জিত, ভদ্র ও রুচিসম্মতভাবে উপস্থাপন করুন। মাথার চুল পরিপাটি রাখুন।
> কর্মক্ষেত্রের ধরন অনুযায়ী মানানসই শালীন পোশাক পরিধান করুন। কেননা আপনার পোশাক শুধু আপনাকেই নয়, তা আপনার প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকেও তুলে ধরে।
> অফিসে আইডি কার্ড যথাসম্ভব দৃশ্যমানভাবে ধারণ করুন।
> হাঁটার সময় বেশি শব্দ হয় এমন জুতো ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। কড়া ঘ্রাণের সুগন্ধির চেয়ে হালকা সুগন্ধি ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
> সহকর্মীর পোশাক ও সাজসজ্জা নিয়ে আপত্তিকর/ বিব্রতকর মন্তব্য করবেন না।
কর্মকৌশল
> নিজের ডেস্ক এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও গুছিয়ে রাখার অভ্যাস করুন।
> নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সর্বোত্তমভাবে সম্পন্ন করতে হবে−এ মনোভাব নিয়ে কাজ করুন। অহেতুক কাজ জমিয়ে রাখলে তা একসঙ্গে করতে গিয়ে আপনাকেই হিমশিম খেতে হবে।
> কাজ অনেক কিন্তু সময় কম, এমন হলে কাজগুলোকে ‘জরুরি’ ও ‘গুরুত্বপূর্ণ’−দুটি তালিকায় আলাদা করুন। জরুরি কাজ আগে শেষ করুন। তারপর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নিয়ে ভাবুন।
> কোনো কাজ না জানলে সেটা সহজভাবে স্বীকার করুন। কীভাবে কাজটি করতে হবে তা অভিজ্ঞদের কাছ থেকে নিঃসংকোচে জেনে নিন।
> যে প্রতিষ্ঠানে বা ডিপার্টমেন্টে কাজ করছেন তার হালনাগাদ তথ্যসমূহ জেনে নিন।
> কোনো কাজ করতে ব্যর্থ হলে অজুহাত দেবেন না। নিজের ভুল বা অক্ষমতা স্বীকার করে নিন এবং তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করুন।
> নিজের মধ্যে দীর্ঘসূত্রিতা ও কাজে অবহেলা অনুভব করলে প্রয়োজনে কর্মপ্রেমী ও নির্ভরযোগ্য কারো পরামর্শ নিন। নতুন উদ্যমে শুরু করুন।
> প্রশান্ত মনে, ঠাণ্ডা মাথায় সম্ভাব্য সবদিক বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিন। প্রয়োজনে নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ ধ্যান/ মেডিটেশন করুন।
> জরুরি এসাইনমেন্ট ও হাতের কাজ শেষ করে অফিস ত্যাগ করুন। কোনো কাজ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় রেখে যেতে হলে পরদিন প্রথম সুযোগেই তা নিয়ে বসুন।
> যোগাযোগ রাখুন, সংযোগায়ন করুন। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ/ উপদেশ এবং সহকর্মীদের পরামর্শ আপনার কাজকে সমৃদ্ধ করবে।
> ভাষা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করুন। মাতৃভাষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দুয়েকটি ভাষাও আয়ত্ত করুন।
> টিমওয়ার্কে আপনি প্রধান হলে টিম মেম্বারদের অবদানকে তুলে ধরুন এবং তাদেরকেও সাফল্যের অংশীদার করুন।
> টিমওয়ার্ক বা দলগত কাজে দলের অংশ হিসেবে কাজ করুন। এজন্যে দলের অন্য সদস্যদের চিন্তা, ধ্যানধারণার নেতিবাচক বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে কাজের লক্ষ্য নিয়ে ভাবুন এবং সেভাবে কাজ করুন।
> টিমওয়ার্কের ক্ষেত্রে ‘এটা তো আমি করি নি’ বা ‘আমার করার কথা নয়’−এ ধরনের কথা বলে দায় এড়াবেন না।
> টিমওয়ার্কে শুধু নিজের ভালোলাগাকেই প্রাধান্য দেয়া/ ‘আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আর কেউ বুঝছে না’−এমন চিন্তাভাবনাকে প্রশ্রয় দেবেন না।
> চাকরি এবং ব্যবসা একসাথে করতে যাবেন না। নিজের সমস্ত মেধা শ্রম সময় ও মনোযোগ ঢেলে দিন যে-কোনো একটি পেশায়।
> পেশা ও পরিবারের মধ্যে সুসমন্বয় করুন। কোনো একটির প্রতি অবহেলা আপনাকে অনেক পিছিয়ে দেবে।
> অফিসকে বাসায় বা বাসাকে অফিসে নিয়ে আসবেন না। পেশাগত বা পারিবারিক দুশ্চিন্তা ও সমস্যা একটি যেন অপরটির শান্তিকে বিঘ্নিত না করে।
মিটিংয়ে
> মিটিংয়ের আগে হোমওয়ার্ক করুন। কাগজ-কলম সঙ্গে রাখুন যাতে অন্যের কাছে চাইতে না হয়।
> মিটিং শুরুর আগেই উপস্থিত হোন। পরে এসে নিজে বিব্রত হবেন না, অন্যদের মনোযোগেও বিঘ্ন ঘটাবেন না।
> অফিসিয়াল মিটিংয়ে আপনার পদ-পদবি ও অবস্থান অনুসারে নির্দিষ্ট আসনে বসুন।
> মিটিং/ কনফারেন্সে প্রধান কর্মকর্তা বা অতিথি আসন গ্রহণের সময় দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করুন।
> মিটিংয়ে তালিকাভুক্ত নন, এমন কারো সাথে মিটিংয়ের খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ করবেন না। যে সিদ্ধান্তগুলো সবার জ্ঞাতার্থে থাকে, শুধু সেটুকু বলুন।
> মিটিংয়ের বিষয়াদি নিয়ে সমালোচনায় মুখর হবেন না। যৌক্তিক কোনো মতামত থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানান।
এমএম//