শিক্ষার্থীর শুদ্ধাচার
প্রকাশিত : ১৮:৪২, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ভালো রেজাল্ট, ভালো ছাত্র, ভালো মানুষ। একজন সফল শিক্ষার্থীর এটাই বিশেষত্ব। সে শুধু ক্লাসে ১ম নয়, জীবনেও হবে ১ম। জীবনে ১ম হওয়ার অন্যতম প্রধান গুণ শুদ্ধাচার। শুদ্ধাচারের এ পর্বে জীবনে ১ম হওয়ার হাতেখড়ি হিসেবে ক্লাসে, শিক্ষক ও সহপাঠীর সঙ্গে, হোস্টেলে−সঠিক আচরণের কিছু সহজ নীতিমালা তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষার্থী হিসেবে শুদ্ধাচার
> ক্লাসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। ক্যাম্পাসে অবস্থানকালে আপনার পালনীয়-বর্জনীয়গুলো নিজ থেকেই অনুসরণ করুন।
> প্রতিষ্ঠান-নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরিধান করুন। পরিষ্কার ও পরিপাটি হয়ে ক্লাসে আসুন। ইউনিফর্ম নির্দিষ্ট না থাকলে ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে শালীন ও মানানসই পোশাক পরুন।
> জ্ঞানার্জন ও বাস্তব জীবনে সাফল্যের জন্যে নিজ আগ্রহ অনুসারে পাঠ্য বিষয় নির্বাচন করুন, হুজুগের বশে বা অন্যদের দেখাদেখি নয়।
> ‘ভালো প্রতিষ্ঠানে’ বা ‘ভালো বিষয়ে’ পড়তে না পারলে ছাত্রজীবন ব্যর্থ মনে করবেন না। সাময়িক ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়ে ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিন। পরিস্থিতিকে গ্রহণ করুন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
> নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদনাম করবেন না। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনাও করবেন না। এতে আপনার পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে।
> যত সীমাবদ্ধতাই থাকুক−নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সম্মান করুন, ভালবাসুন।
> নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে ব্রোশিউর, ওয়েবসাইট ও প্রসপেক্টাসের সাহায্য নিন।
> ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে ছুটির আবেদনপত্র জমা দিন। সবচেয়ে ভালো হয় আবেদনপত্র অগ্রিম জমা দিলে।
> শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাগ-অভিমান, ঝগড়া এবং সকল প্রকার রেষারেষি ও বিতর্ক এড়িয়ে চলুন।
> সহপাঠীরা পরস্পরের সাথে−বিশেষত বিপরীত লিঙ্গের সহপাঠীর সাথে মার্জিত আচরণ করুন।
> শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে নিজের কথা, আচরণ ও কাজের ব্যাপারে সচেতন থাকুন। আপনার সুনাম বা বদনাম প্রতিষ্ঠানের পরিচিতির ওপরেও প্রভাব ফেলে।
> টিউশন ফি-সহ যাবতীয় সময়মতো পরিশোধ করতে সচেষ্ট থাকুন। ক্যান্টিনে বাকিতে খাবার খাবেন না।
> নিজের পড়াশোনাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে শিক্ষার্থী জীবন থেকেই স্বাবলম্বী হতে চেষ্টা করুন। টিউশন শুরু করুন বা গঠনমূলক কোনো কাজে সম্পৃক্ত হোন।
> মা-বাবা, অভিভাবক, শিক্ষক, এডমিন−এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়া, ব্রাদার, গার্ড অর্থাৎ যাদের শ্রম, ঘাম ও ত্যাগের বিনিময়ে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছেন, সবসময় তাদের অবদানকে স্মরণে রাখুন। আপনার জীবনের অর্জন তাদের বিসর্জনেরই ফসল।
> প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুধু ডিগ্রি ও সার্টিফিকেটের মাঝে যেন সীমাবদ্ধ না থাকে; আপনার কথাবার্তা, আচার-আচরণ এবং কাজেও যেন থাকে এর প্রতিফলন।
> নিজের সাফল্যের সাথে সাথে জুনিয়রদেরও সাফল্যের পথ দেখানোকে নৈতিক দায়িত্ব মনে করুন।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে শুদ্ধাচার
> ক্লাসে নিয়মিত ও সময়মতো আসুন।
> ক্লাসে শিক্ষক প্রবেশ করলে দাঁড়িয়ে সালাম দিন। শিক্ষক আগে এসে থাকলে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করুন।
> শিক্ষকের সামনে চেয়ার বা বেঞ্চে গা এলিয়ে নয়, সোজা হয়ে বসুন।
> উদাসী হয়ে থাকবেন না, মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকের কথা শুনুন।
> ক্লাসরুমের দেয়াল চেয়ার ডেস্ক বা বোর্ডে ব্যঙ্গ করে কার্টুন আঁকা ও মন্তব্য লেখাসহ যে-কোনো ধরনের আঁকাআঁকি, কাটাকাটি করা থেকে বিরত থাকুন। চেয়ার বা বেঞ্চের ওপর কখনো দাঁড়াবেন না।
> ক্লাস চলাকালে ইশারায় ডাকাডাকি করা, ফিসফাস করে বা জোরে জোরে নিজেদের মধ্যে কথা বলা, কাগজ রুমাল বা কোনোকিছু ছোড়াছুড়ি করা থেকে বিরত থাকুন।
> ক্লাসে অন্য বই খুলে পড়া/ দেখা কিংবা খাতার নিচে গল্পের বই লুকিয়ে রেখে পড়া, আড়ালে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকা, কোনো খাবার বা চুইংগাম চিবানো থেকে বিরত থাকুন।
> শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে হলে একজন একজন করে বলুন, কয়েকজন একসঙ্গে নয়। কোনো প্রশ্ন থাকলে বা কিছু বলার আগে হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করুন। শিক্ষক অনুমতি দিলে তারপর বলুন।
> ভিন্নমত থাকলেও ক্লাসে বিতর্কে জড়াবেন না। অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে শিক্ষককে বিব্রত করবেন না।
> ক্লাস চলাকালে কিছু সময়ের জন্যে শিক্ষক বাইরে গেলেও শ্রেণিকক্ষে অবস্থান করুন। কথা বলা, আসন ছেড়ে ওঠাসহ কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকুন।
> নতুন শিক্ষককে তার প্রথম ক্লাস থেকেই আন্তরিকভাবে গ্রহণ করুন। আগের কোনো শিক্ষকের সাথে তুলনা করবেন না। তাকে নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার সময় দিন।
> শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তার চেয়ার বা টেবিলে বসা থেকে বিরত থাকুন। নিজেদের হাইবেঞ্চেও বসবেন না।
শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থী হিসেবে শুদ্ধাচার
> শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দাঁড়িয়ে দিন। পরীক্ষার হলে খাতা/ প্রশ্ন নেয়ার সময় দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে তা গ্রহণ করুন।
> এক শিক্ষকের সমালোচনা অন্য শিক্ষকের কাছে করবেন না। কোনো শিক্ষকের পড়া না বুঝলে যদি অন্য শিক্ষকের সহায়তা নিতে হয়, তখনো নেতিবাচক কিছু না বলে পড়া বুঝে নেয়াকেই প্রাধান্য দিন।
> শিক্ষকের কোনো আচরণে কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষোভ পুষে রাখবেন না। তাকে আড়ালে বকাবকি করা বা বন্ধুরা মিলে নাজেহাল করা থেকে বিরত থাকুন।
> শিক্ষকের আড়ালে তার কোনো আচরণ অভিনয় করে দেখানো, তাকে বিদ্রুপাত্মক নামে ডাকা অন্যায়। এ থেকে বিরত থাকুন।
> শুধু ক্লাসে নয়−যেখানেই শিক্ষকের সাথে দেখা হোক, তাকে সালাম দিন। বসে থাকলে উঠে দাঁড়ান। শিক্ষকের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে উল্টো পথ ধরবেন না বা আড়ালে চলে যাবেন না।
> পড়ালেখায় ভালো করাসহ ক্লাস পারফরমেন্স ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহশিক্ষা কার্যক্রমে পারদর্শিতা আপনাকে শিক্ষকের স্নেহভাজন হতে সাহায্য করবে।
> শিক্ষকের সহানুভূতি পেতে ও তার নজর কাড়তে উপহার-উপঢৌকন, গ্রুপিং-লবিং বা নেটওয়ার্কিং করা থেকে বিরত থাকুন।
> আপনার কোনো ভুল বা অন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করলে তা আপনার কল্যাণের জন্যেই করেছেন বলে মনে করুন। এ নিয়ে ক্ষোভ পোষণ করবেন না, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবেন না।
> বন্ধুবৎসল শিক্ষককে ‘ইয়ার দোস্ত’ মনে করে হাত ধরে টানাটানি করা ও হালকা রসিকতা করা থেকে বিরত থাকুন।
লাইব্রেরিতে শুদ্ধাচার
> পড়ার উদ্দেশ্য নিয়েই লাইব্রেরিতে প্রবেশ করুন। লাইব্রেরিতে থাকাকালে নিজের ও অন্যের পড়াকে নির্বিঘ্ন করার প্রতি আন্তরিক হোন।
> লাইব্রেরিতে প্রবেশ করার আগেই মোবাইল ফোন সুইচড অফ বা সাইলেন্ট মোডে রাখুন। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে এসে কথা বলুন।
> দরজা দিয়ে প্রবেশ করা থেকে শুরু করে হাঁটাচলা, শেলফ থেকে বই নেয়া, চেয়ার টেনে বসাসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ যথাসম্ভব নীরবে করার চেষ্টা করুন। লাইব্রেরির আশেপাশেও শব্দ করা থেকে বিরত থাকুন।
> জোরে বা গুনগুন করে নয়, নিঃশব্দে পড়ুন ও বইয়ের পাতা উল্টান।
> পড়তে পড়তে শিস দেয়া, চেয়ার বা টেবিলে তবলা বাজানো, কলম দিয়ে শব্দ করা, টেবিলে আঁকাআঁকি, গেমস খেলা বা গান শোনা, একে-ওকে দেখা থেকে বিরত থাকুন।
> একত্রে পড়ার সময় নারী-পুরুষ শোভনীয় দূরত্ব বজায় রাখুন।
> কাঙ্ক্ষিত বইয়ের নাম স্লিপে লিখে নিন। কোন বই কোন শেলফে আছে−প্রয়োজনে তা লাইব্রেরিয়ানের কাছ থেকে জেনে নিন।
> যে বইগুলো পড়বেন শুধু সেগুলোই শেলফ থেকে টেবিলে রাখুন। কতগুলো বই নিয়েছেন তার হিসাব রাখুন।
> শেলফ থেকে নেয়ার সময় খেয়াল রাখুন−কোনো বই যেন পড়ে না যায়। বইয়ে ধুলো থাকলে তা পরিষ্কারে প্রয়োজনে লাইব্রেরিয়ানের সাহায্য নিন।
> যে বই যেখান থেকে নিয়েছেন, প্রয়োজন শেষে সেখানেই নিজ দায়িত্বে রেখে আসুন কিংবা লাইব্রেরির নিয়ম অনুযায়ী টেবিলে বা নির্দিষ্ট স্থানে বইগুলো গুছিয়ে রাখুন।
> বিনা প্রয়োজনে নিজের ব্যাগ, ফাইল, খাতা বা আনুষঙ্গিক জিনিস রেখে চেয়ার-টেবিল দখল করে রাখবেন না। অন্যদেরও পড়ার সুযোগ দিন।
> কারো জন্যে জায়গা রেখে আরেকজনকে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না। আবার অন্যের সিটে রাখা বই সরিয়ে নিজে বসে পড়বেন না।
> পড়তে পড়তে পা দোলানোসহ এমন কোনো অঙ্গভঙ্গি করা থেকে বিরত থাকুন, যা পাশের কারো মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়।
> পাশের কারো সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে উচ্চস্বরে না বলে বা ইশারা-ইঙ্গিত না করে কাগজে লিখে দিন।
> লাইব্রেরি থেকে নেয়া বই যত্নের সাথে রাখুন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই জমা দিন।
> বইয়ের কোনো পৃষ্ঠা ছিঁড়বেন না, ভাঁজ করবেন না। যে পৃষ্ঠাগুলো আপনার প্রয়োজন তা লাইব্রেরিয়ানের অনুমতি নিয়ে ফটোকপি করে ফেরত দিন।
> না বলে লাইব্রেরির বই/ বইয়ের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে চলে আসা ও ফেরত না দেয়া গর্হিত অপরাধ। বই হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ দিন।
> বইয়ের প্রতি যত্নশীল হোন। লাইব্রেরি/ গ্রন্থাগারের বইয়ে কলম-পেন্সিল দিয়ে দাগানো, আন্ডারলাইন করা, নিজস্ব মন্তব্য লেখা থেকে বিরত থাকুন। খেয়াল রাখুন−সজোরে পাতা উল্টাতে গিয়ে বই যেন ছিঁড়ে না যায়।
> নোট নেয়ার প্রয়োজনে খাতা, কলম এবং অন্যান্য উপকরণ নিজের সাথে রাখুন।
> লাইব্রেরিতে বসে খাবার খাবেন না। লাইব্রেরি-সংলগ্ন বারান্দা, করিডোর ও সিঁড়িতে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকুন।
> হাঁচি-কাশি যথাসম্ভব নীরবে দিন, রুমাল ব্যবহার করুন।
> লাইব্রেরি কার্ড (থাকলে) সাথে রাখুন।
> ইচ্ছাকৃতভাবে বা খামখেয়ালি করে এক শেলফের বই অন্য শেলফে রাখবেন না। এতে বইটি খুঁজে পেতে অন্যদের অসুবিধা হতে পারে।
> লাইব্রেরি/ গ্রন্থাগারের নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলুন। অন্যদের আচরণে প্রভাবিত হয়ে নিজেও নিয়মভঙ্গ করবেন না।
> পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই আত্ম উন্নয়নমূলক বই, সফল জীবনী ও ক্লাসিক সাহিত্য পড়ুন। তবে এমন কিছু পড়া থেকে বিরত থাকুন যা আপনাকে বিভ্রান্ত ও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। বইয়ের জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তব জ্ঞান অর্জনে উদ্যোগী হোন।
এমএম//