সুস্বাস্থ্যই জীবন
প্রকাশিত : ১৪:০৭, ৫ নভেম্বর ২০২৩
সুস্বাস্থ্যই জীবন। সুস্বাস্থ্যের গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা সবসময় সবকালেই অনুভব করেছে মানুষ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এটি আরো বেশি করে অনুভূত হচ্ছে, কারণ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশ আর বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতির পথ ধরে আমাদের জীবন আগের চেয়ে অনেক সহজ আর গতিশীল হয়ে উঠেছে সত্যি, কিন্তু আক্রান্ত হয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য- শারীরিক মানসিক আত্মিক এমনকি সামাজিক দিক থেকেও।
আর, সার্বিক মনোদৈহিক সুস্থতা ও আনন্দময় দিনযাপনের জন্যে চাই সুস্থ জীবনদৃষ্টি ও জীবনের সবক্ষেত্রে সমন্বয়। কারণ, শরীর ভালো থাকলে যেমন মন ভালো থাকে, তেমনি প্রশান্ত মন নিশ্চিতভাবেই বাড়িয়ে দেয় দেহের শক্তি আর উদ্যম। তাই বলা যায়, এ সবগুলো অনুষঙ্গকেই যিনি যতটা ভালোভাবে সমন্বয় করতে পারেন, তিনিই পারেন ততটা সুস্থ জীবনযাপন করতে।
আপনি হয়তো আপনার পুরনো সেলফোন সেটটি বদলে উচ্চপ্রযুক্তির আইফোন কেনার কথা ভাবছেন, কম্পিউটারে ব্যবহার করছেন বাজারে সদ্য আসা নতুন সফটওয়্যারটি। আপনার ওয়ারড্রোব প্রতি মৌসুমেই বোঝাই হচ্ছে নিত্যনূতন কাপড়ে কিংবা কয়েক বছর পর পর বদলে ফেলছেন গাড়ির মডেল। কিন্তু এর পাশাপাশি নিজেকেও এগিয়ে রাখছেন তো?
এজন্যে খুব যে কঠিন কোনো কসরত করতে হবে তা নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনে কিছু সহজ সূত্র প্রয়োগ করেই আপনি পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে পারেন সুস্বাস্থ্য, প্রাচুর্য ও সাফল্যের পথে—যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আপনাকে নিয়ে যাবে আত্মনির্মাণের অনন্য ভুবনে। আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ এসব তথ্য ও প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে আপনিও পারেন নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে—
বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষের গড় আয়ু যা-ই হোক, জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে আমরা একে সত্যিই বাড়াতে পারি। একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতির ধারায় গবেষকরা এখন বলছেন, বার্ধক্যকে পিছু হটিয়ে দেড়শ বছর পর্যন্ত আমরা থাকতে পারি চিরতরুণ!
‘দি ট্রুথ এবাউট এজিং’ বইয়ের লেখক ড. জর্জ এস রথ-এর ভাষায়, ‘বয়সজনিত অসুস্থতাগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা অনায়াসেই উপভোগ করতে পারি একটি আনন্দময় দীর্ঘজীবন।’ এজন্যে কিছু উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি—মেদস্থূলতা কমান, তাতে হরেক রকম রোগ-বালাইয়ের বিরুদ্ধে একটি শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে আপনার দেহে। আর দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস থাকা চাই আপনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। ফলে ধীর হয়ে পড়বে আপনার বার্ধক্যের গতি। আপনি ঠেকিয়ে দিতে পারবেন বার্ধক্যের আগ্রাসন। খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণের ফলে আপনার তারুণ্যই যে কেবল দীর্ঘায়িত হবে তা নয়, উপরন্তু নানান দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি থেকেও আপনি মুক্ত থাকবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ইঁদুরের খাবারে ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও বয়সজনিত মেদস্থূলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক কম।
মানুষের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটিই ঘটে থাকে, বলেন লুইজিয়ানার বায়ো-মেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের প্রফেসর ড. এরিক র্যাভুসন। প্রতিদিনের খাবারে অন্তত শতকরা ২৫ ভাগ ক্যালরি নিয়ন্ত্রণকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়, এটুকু যারা কমাতে সক্ষম হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে জেনেটিক অসুখগুলোতে ভোগার হার অনেকখানিই কমে গেছে। এছাড়াও আপনার খাবারটা হতে হবে স্বল্প চিনি ও স্বল্প চর্বিযুক্ত এবং অবশ্যই পুষ্টিসমৃদ্ধ, আর তাতে আধিক্য থাকবে আঁশ-জাতীয় শাক-সব্জি, সালাদ ও ফলমূলের।
সামাজিক হোন। পরিবার বন্ধু আত্মীয় সহকর্মী ও প্রতিবেশী—সবার সাথেই গড়ে তুলুন একটি সহযোগিতাপূর্ণ সামাজিক সুসম্পর্ক। বিজ্ঞানীদের মতে, শুধু এর মাধ্যমেই আপনি ঠেকিয়ে দিতে পারেন টেনশনজনিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে সৃষ্ট হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা। টিভির সামনে বসে উদ্দেশ্যহীনভাবে চ্যানেল ঘুরিয়ে অলস সময় কাটানোর চেয়ে মেতে উঠুন কোনো নির্মল আনন্দে। বাড়ির পোষা বিড়ালটার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিন। এতে স্বাভাবিক থাকবে আপনার রক্তচাপ, শ্লথ হবে বার্ধক্যের গতি।
গতিশীল হোন। আপনি অনেকদিন বাঁচবেন। কবির ভাষায়, ‘গতিতে জীবন মম, স্থিতিতে মরণ।’ আনন্দময় গতিশীলতার জন্যে নিয়মিত ব্যায়াম করুন। প্রতিদিনের হালকা ব্যায়াম আপনার অকারণ আলস্য ও বিষাদ দূরে ঠেলে দেয়, জীবনকে প্রকৃত অর্থেই করে তোলে গতিময় ও আনন্দপূর্ণ। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটুন, সপ্তাহে অন্তত চার/ পাঁচ দিন। সুস্বাস্থ্যের জন্যে এটি দারুণ উপকারী।
একটি ভালো ঘুম আপনাকে সারাদিন রাখবে প্রাণোচ্ছল ও উৎফুল্ল, আপনার প্রতিদিনের কাজগুলো হয়ে উঠবে আরো সুন্দর। কিন্তু অতিরিক্ত ওজন, ক্যাফেইন, নিকোটিন, এলকোহল তৃপ্তিময় ঘুমের পথে অন্তরায়। ঘুমানোর আগে ভারী খাবার কিংবা ভারী ব্যায়ামও ঘুমহীনতার জন্যে সমানভাবে দায়ী। আর প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো ও জেগে ওঠার অভ্যাস করুন।
ঘুমানোর আগে লিখে ফেলুন মনের যত ভয়, দুশ্চিন্তা ও পরের দিনের কাজগুলো নিয়ে যত চাপ বা আশঙ্কা। ভেতর থেকে বেরিয়ে যেতে দিন এসব। বিছানায় বসে হালকা যোগাসনের মাধ্যমে শিথিল করে নিন হাত-পা, ঘাড়, কাঁধসহ শরীরের সব পেশি। তাতে সুনিদ্রার পথ হবে সুগম। আর দিনের বেলায় ঘন ঘন হাই তোলার বিরক্তিকর অভ্যেসটির জন্যে ব্রেনের অক্সিজেন স্বল্পতাকেই দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। এ থেকে মুক্তি পেতে তারা নিয়মিত গভীরভাবে বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
আজকের দিনে আপনার আয়ের পথকে আরো বিস্তৃত ও বহুমুখী করতে আপনি খুব সহজেই নানা পদক্ষেপ নিতে পারেন। খুব জোরেশোরে কিংবা বড় করে কিছু শুরু করার প্রয়োজন নেই। এজন্যে প্রয়োজন শুধু যোগাযোগ-দক্ষতা, যা আপনার জানাশোনার পরিধি অর্থাৎ নেটওয়ার্কটিকে আরো বিস্তৃত করে তুলবে। তাই আজই শুরু করুন, যা আছে তা-ই নিয়ে শুরু করুন।
এছাড়াও আপনার দক্ষতা, আগ্রহ ও সৃজনশীলতা অনুযায়ী আপনি নিজেকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রাখতে পারেন। কাজ করতে পারেন কোনো একজন পেশাজীবীর সহযোগী হয়ে। হতে পারেন একজন ডাক্তার অথবা আইনজ্ঞের সহকারী কিংবা করতে পারেন ওয়েব ডিজাইনিং-এর মতো কাজ। মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেবা কিংবা পরামর্শ দিতে পারেন। ইউরোপ আমেরিকায় দিন দিন এসব পেশা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এগুলো কোনো গৎবাঁধা চাকরি নয় বটে, কিন্তু এতে আপনার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে এবং প্রাচুর্য আসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
প্রচলিত পেশার বাইরে যারা বিভিন্ন ধরনের কাজে দক্ষ, সেটিকেই তারা কাজে লাগাতে পারেন সফলতা ও প্রাচুর্যের সিঁড়ি হিসেবে। মালয়েশিয়ার সাধারণ এক কিশোর ডেভিড ল্যাইয়ের যখন ১০ বছর বয়স, তখন থেকেই সে টেলিভিশনে অবাক বিস্ময়ে দেখতো ডেভিড কপারফিল্ডের জাদু।
ল্যাইয়ের ভাষায়, ‘এভাবে হাজারো মানুষের সামনে মঞ্চে জাদু দেখানোটা আমাকে ভীষণ মুুগ্ধ ও রোমাঞ্চিত করতো।’ এর প্রতি আগ্রহের কারণে মাইন্ড রিডিং ও জাদুর চর্চা শুরু করেন ল্যাই। নিরন্তর চেষ্টা আর কঠোর অনুশীলনে স্বভাবতই এতে তার দক্ষতার বিকাশ ঘটে।
মালয়েশিয়া ম্যাজিক ফেলোশিপের সদস্য ২১ বছর বয়সের ল্যাই এখন বড় বড় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে জাদু প্রদর্শন করেন। এবং প্রতিটি অনুষ্ঠান থেকেই তার আয়ের অংকটা থাকে বেশ মোটা। আর এ সাফল্যের পেছনে ছিলো তার আগ্রহ, নিষ্ঠা ও অন্যান্য জাদুশিল্পীদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করে একটি সংগঠন গড়ে তোলা। নিজের দক্ষতাকে সবার সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি এগিয়ে গেছেন সফলতার পথে। নিজের জীবন-অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের প্রতি ল্যাইয়ের পরামর্শ—‘একজন ভালো শিক্ষকের সাথে থেকে কঠোর পরিশ্রম কর, সাফল্যের দেখা তুমি পাবেই।’
সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, উচ্চ আইকিউ সম্পন্ন মানুষ তুলনামূলক সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর অধিকারী হন। তারা অন্যদের চেয়ে যেকোনো কিছু দ্রুত শিখতে পারেন এবং যেকোনো সাফল্যের জন্যে ঝুঁকিও নিতে পারেন স্বচ্ছন্দে। বিজ্ঞানীদের মতে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে এদের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কমে যায় অনেকখানি।
সচেতন প্রচেষ্টা ও নিয়মিত কিছু মানসিক অনুশীলনের মাধ্যমে আপনিও কিন্তু বাড়াতে পারেন আপনার আইকিউ। যেমন, সারাদিনের অন্তত ১০টি কাজের তালিকা করুন মনে মনে, তারপর চোখ বন্ধ করে ভাবুন কোনটার পর কোনটা আছে তালিকায়। পাঁচ নম্বরে রেখেছেন কোনটি কিংবা অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর কোন কাজটি করবেন বলে ভেবেছিলেন। এভাবে দ্বিতীয় তালিকায় কাজের সংখ্যা ২০ পর্যন্ত বাড়ান। কিংবা চেয়ারে আরাম করে বসুন, এবার মনে মনে পুরো ঘর জুড়ে পায়চারি করে দেখুন—কোথায় কী আছে। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ অবলোকন করুন। মনের চোখে বোঝার চেষ্টা করুন। এরপর একটি কাল্পনিক ট্রে-তে ঘরের এসব জিনিসপত্র থেকে যেকোনো ১২টি জিনিস তুলে নিয়ে সাজান।
এছাড়াও ব্রেনের কার্যক্ষমতাকে ঝালাই করে নিতে মেতে উঠুন শব্দ ও সংখ্যার খেলায়। বিভিন্ন পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে দেয়া সংখ্যার ধাঁধা কিংবা শব্দজটের সমাধান নিয়ে ভাবুন। প্রতিদিন একটি নতুন শব্দ শিখুন, এ দিয়ে সারাদিনে বিভিন্ন সময় কয়েকটি বাক্য তৈরি করুন। এসব অভ্যাস আপনার দ্রুত বোঝার ক্ষমতাকে বাড়াবে। আইকিউ বাড়ার সাথে সাথে আপনার সচেতনতাবোধ ও স্মৃতিশক্তি হয়ে উঠবে আরো প্রখর, আরো সুসংহত। আপনি দিন দিন হয়ে উঠবেন কর্মতৎপর ও কুশলী।
এখানেই শেষ নয়, অপেক্ষা করছে আরো বিস্ময়। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ড. মার্ক লিথ্গো। তিনি বলেন, যখন আমি নিউরো-ফিজিওলজিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করি তখন বিশ্বাস করা হতো যে, মানুষের হাড়ের মতোই মস্তিষ্কও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, উপযুক্ত তথ্য ও জ্ঞানের প্রভাবে স্মৃতিশক্তির পাশাপাশি মস্তিষ্কের নিউরোনগুলো উদ্দীপ্ত হয়, সৃষ্টি হতে পারে নতুন ডেনড্রাইট। সোজা কথা, মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। লিথ্গো বিশ্বাস করেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মস্তিষ্ক নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করতে সক্ষম, এমনকি এক সপ্তাহের মধ্যেও। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে সফল হওয়ার জন্যে ড. মার্ক লিথ্গো পরিচালিত ‘গেট স্মার্টার ইন এ উইক’ কর্মশালায় নিয়মিত মনের ব্যায়াম অনুশীলনের পাশাপাশি তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন সুষম খাবার গ্রহণ, যোগ ব্যায়াম ও মেডিটেশনকে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ এসব তথ্য, জ্ঞান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মস্তিষ্ককে শাণিত করে তুলতে পারেন আপনিও। হয়ে উঠতে পারেন সুখ সুস্বাস্থ্য সাফল্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী।
এমএম//