আমরা অসুস্থ হই কেন?
প্রকাশিত : ১৯:৪৯, ১৫ আগস্ট ২০১৯
সৃষ্টি জগতের প্রতিটি প্রাণি অসুস্থ হয়। আমরাও এর বাহিরে নই। তাই অসুস্থতা একটা সাধারণ ক্রিয়া হিসেবেই আমাদের কাছে পরিচিত। কেননা, কম-বেশি আমরা সবাই অসুস্থতায়ভোগী। কিন্তু কেন আমরা অসুস্থ হই? এর উত্তর খুঁজতে যুগের পর যুগ দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
অনেক সময় ভিন্নরকম মত দিলেও, কেউই এর মূল রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেননি। আদি যুগে মানুষ রোগের ধরণ ও চিকিৎসায় শুধু আপেক্ষিক জ্ঞান ও ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই স্থির থাকতো। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এ অবস্থা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে আমরা আসলে কেন অসুস্থ হই।
মানবদেহ অপূর্ব সৃষ্টি হলেও বহতা নদীর মতই মানবদেহের প্রতিটি পরমাণূ পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ওকরিজ ল্যাবরেটরিতে রেডিও আইসোটোপ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে যে, মানবদেহের ৯৮% পরমাণু প্রতিবছর পরিবর্তিত হয়। আর এই পরিবর্তন নিয়ন্ত্রিত হয় ডিএনএ-তে বিদ্যমান জেনেটিক কোড দ্বারা, মন-দেহ প্রক্রিয়ার কোয়ান্টাম লেভেল থেকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানবদেহের শতকরা ৯৮ ভাগ পদার্থ প্রতিবছর পরিবর্তিত হওয়ার পরও রোগ-বিশেষত ক্রনিক রোগ থেকে যায় কিভাবে?
এর উত্তর একটাই। বস্তু পরিবর্তিত হচ্ছে কিন্তু তথ্য অর্থাৎ ডিএনএ-র প্রোগ্রামিং অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে। তাই নতুন পদার্থও পুরনো তথ্য দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। তাই পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্যে প্রয়োজন মন-দেহ নিয়ন্ত্রণকারী তথ্যভাণ্ডারের পুনর্বিন্যাস। (To change the print out of the body, you must learn to rewrite the software of mind) তথ্যের পুনর্বিন্যাস হলেই মানবদেহ নিজেই নিজেকে রোগমুক্ত করতে পারে। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, মন সেরা ডাক্তার আর মানবদেহ সবচেয়ে সেরা ফার্মেসী’। যে-কোনো ওষুধ কোম্পানীর চেয়ে মানবদেহ বেশি ভালোভাবে পেইনকিলার, ট্রাঙ্কুইলাইজার, এন্টিবায়োটিক ইত্যাদি তৈরি করতে এবং সঠিক মাত্রায় সঠিক সময় ব্যবহার করতে পারে।
রোগের মূল কারণ মানসিক
মনের শক্তিকে ব্যবহার করে রোগ নিরাময় সম্ভব হবে কেন? ওষুধ যা নিরাময় করতে ব্যর্থ হয়েছে, সে রোগ মনের শক্তি দিয়ে কীভাবে নিরাময় হতে পারে? এর জবাব একদিক থেকে বেশি জটিল আবার অন্যদিক থেকে সহজ। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর এখন স্বীকার করতে শুরু করেছেন যে, রোগের কারণ যেমন দৈহিক হতে পারে, তেমনি হতে পারে মানসিক। বহু জটিল রোগ, এমনকি ক্যান্সারের কারণও হতে পারে মানসিক।
মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর দেখিয়েছেন যে, হৃদরোগের কারণ প্রধানত মানসিক। তিনি বলেছেন, কোলেস্টেরল বা চর্বি জাতীয় পদার্থ জমে করোনারি আর্টারিকে প্রায় ব্লক করে ফেললেই যে হার্ট এটাক হবে এমন কোনো কথা নেই। কোরিয়ার যুদ্ধের সময় রণক্ষেত্রে নিহত সৈনিকদের শতকরা ৭০ জনেরই আর্টারি চর্বি জমে প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে (চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে অ্যাডভান্সড স্টেজ অফ অ্যাথেরোসক্লেরোসিস) এবং দ্রুত হার্ট এটাকের পথে এগুচ্ছে। এদের মধ্যে ১৯ বছর বয়ষ্ক তরুণ সৈনিকও ছিল। ডা. ক্রিচটন প্রশ্ন তোলেন, তরুণ আর্টারিগুলো এভাবে চর্বি জমে বন্ধ হওয়ার পরও সাধারণভাবে মধ্য বয়সে এসে কেন হৃদরোগের আক্রমণ ঘটে?
যদি শুধু করোনারি আর্টারিতে চর্বি জমাটাই হৃদরোগের কারণ হতো তাহলে তো এই তরুণ সৈনিকদেরও মৃত্যু গুলির আঘাতে নয় হৃদরোগেই হতো। আবার দেখা গেছে আর্টারির ৮৫% বন্ধ অবস্থা নিয়েও একজন ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছে; আবার একেবারে পরিষ্কার আর্টারি নিয়েও অপর একজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান এবং ডা. রে রোজেনম্যান দীর্ঘ গবেষণার পর দেখান যে, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনপদ্ধতির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।
হার্ভার্ডের ফিজিওলজিস্ট ওয়াল্টার ক্যানন ১০০ বছর আগেই গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন মন যখন ভাবাবেগজনিত চাপ বা উৎকণ্ঠার সম্মুখীন হয় তখন শরীর নানাভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। রক্তে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান নিঃসরণের পাশাপাশি হৃদকম্পন বেড়ে যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়, মলাশয়ের তৎপরতা বাড়ে, মূত্রাশয় সহজে সঙ্কুচিত হয়। ডা. হার্বার্ট বেনসন এবং ডা. এডমন্ড জ্যাকবসন এই টেনশন বা উৎকণ্ঠার কারণে সৃষ্ট রোগের দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছেন। এই তালিকায় রয়েছে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, অনিদ্রা, বাতব্যথা, বিষণ্নতা বদমেজাজ, গ্যাস্ট্রিক আলসার, ডায়রিয়া, বহুমূত্র, ঘাড়ে ব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা ইত্যাদি। ড. জোসেফ মার্কোলা তার টোটাল হেলথ প্রোগ্রাম বইয়ে দেখিয়েছেন, প্রতিবছর শুধু আমেরিকাতেই স্ট্রেসঘটিত শারীরিক, মানসিক জটিলতার কারণে ৩০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়।
রোগ ও অসুস্থতা থেকে মুক্তির জন্যে প্রথম প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবন চেতনার পরিবর্তন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, শতকরা ৭০ ভাগ রোগের কারণই হচ্ছে মানসিক। অর্থাৎ কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনার মানসিক প্রতিক্রিয়াই ৭০ ভাগ রোগ সৃষ্টির কারণ। শতকরা ২০ ভাগ রোগের কারণ হচ্ছে ইনফেকশন, ভাইরাস আক্রমণ, ভুল খাদ্য গ্রহণ ও ব্যায়াম না করা। শতকরা ১০ ভাগ রোগের কারণ হচ্ছে দৈহিক আঘাত, ওষুধ ও অপারেশনের প্রতিক্রিয়া। তাই শতকরা ৭০ ভাগ রোগই শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সুস্থ জীবনদৃষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে নিরাময় হতে পারে। অন্যান্য রোগ নিরাময়েও ওষুধ ও সার্জারির পাশাপাশি সুস্থ জীবনদৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আই/এনএম