ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

ছোট গল্প 

আজ মায়ের ছুটির দিন

তোতো হাসান

প্রকাশিত : ১৬:৩০, ১২ জুলাই ২০২০

মায়েদের যেন ক্লান্ত হতে নেই। ঘুমও আসতে নেই। এমনকি খিদেও পেতে নেয়। অসুখ বিসুখ করে কিনা তাই বা কে জানে! অন্তত এদেশের মায়েদের দেখে তেমনটাই মনে হওয়ার কথা। বছরের প্রতিটা মাস, প্রতিটা সপ্তাহ, প্রতিটা দিনই তাদেরকে নিরবে নিভৃতে কী যে ভীষণ দায়িত্ব পালন করতে হয়, তা আর কজনাই বা দেখে! আর ছুটি? সে আবার কী? এমন কখনো হয় নাকি? কি অবাক কাণ্ড! 

হ্যাঁ, এই রকমই এক অবাক কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে আজ। 
মিসেস জলিল অর্থাৎ রাশেদের মা, তার আজ ছুটির দিন। বত্রিশ বছরের সংসার নামক বিরামহীন এক মহা দায়িত্ব পালনের ফাঁকে, আজকের এই সম্পূর্ণ একটা দিনের, একটা ছুটি। 
আসলে হয়েছে কী, গতকাল রাতে যখন পরিবারের সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল, তার কিছুক্ষণ পর সোমা (রাশেদের নববিবাহিতা স্ত্রী) দেখলো তার শাশুড়ি একা একা চুপচাপ খেতে বসেছে। সোমা এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে মাস খানেক আগে। প্রথম থেকেই সে লক্ষ্য করেছে, তার শাশুড়ি একটু চুপচাপ। উনার উপস্থিতি যেন টেরই পাওয়া যায় না। অথচ এ বাড়িতে উনার ভূমিকা অপরিসীম। সবখানে সব কাজেই উনার ভূমিকা আছেই। তবে একটু নিভৃতে। প্রথম থেকেই এই মানুষটাকে সোমার খুব ভালো লেগে গেছে। সোমা তার নিজের মাকে হারিয়েছে ছোটবেলায়। শাশুড়ি হিসেবে এমন একজনকে পেয়ে সে মনে মনে বেশ খুশি অনুভব করে। অল্প দিনেই তাদের দুজনের মধ্যে বেশ সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে গেছে।

শাশুড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে, দেখলো বাঁ হাত দিয়ে জগ ধরে গ্লাসে পানি ঢালার চেষ্টা করছেন তার শাশুড়ি, কিন্তু ঠিক মত পারছেন না। কষ্ট হচ্ছে অথচ তাকেও কিছু বলছেন না। তার একটু মায়া লাগলো। সোমা জগটা নিয়ে পানি ঢেলে দিল। তারপর চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলো। দুজনের মধ্যে টুকিটাকি কথা হচ্ছিল। হঠাৎ সোমার মাথায় একটা চিন্তা এলো।‌ সে বলল-আচ্ছা মা , আপনি শেষ কবে বেড়াতে বের হয়েছেন?
 
তার শাশুড়ি একটু থমকে গেল। কিছুটা চিন্তা করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল। তারপর বলল তা তো ঠিক মনে করতে পারছি না, মা। সময় কোথায় বেড়ানোর!  
-ইচ্ছে করে না?
এখন আর করে না। তবে এক সময় করতো। তোমার শশুর তো জানোই কেমন মানুষ। অযথা ঘুরাঘুরি পছন্দ করেন না।
-মা, আপনার কখনো মনে হয় না, একটু নিজের মত করে সময় কাটাই। একটা দিন ছুটি নেই। 
শাশুড়ি-বিষম খেল। ছুটি! কী যে বলনা! আমি কী চাকরি করি? 
সোমা একটু হেসে বলল, চাকরিই তো। আচ্ছা কাল আপনি একটা ছুটির দিন কাটালে কেমন হয়, মা?
-সরল হাসি দিয়ে শাশুড়ি বললেন- কিভাবে? কাজকর্ম সব বাদ দিয়ে ঘুমাবো?
-না, তা কেন! আমি খুব সকালে উঠে নাস্তা বানিয়ে, দুপুরের রান্নাটা ও সেরে ফেলব। তারপর আমরা দুজন বের হব।
-বের হয়ে কী করব? 
-এখানে ওখানে ঘুরব ফিরবো। দুপুরে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে খাবো। তারপর বিকালে সিনেপ্লেক্সে সিনেমাও দেখতে যেতে পারি। কিছুদিন আগে বইমেলা শুরু হয়েছে, সেখানেও যেতে পারি।
শাশুড়ির অবাক ভাবটা এখনো আছে দেখে সোমা বলে উঠলো -আচ্ছা এখন এতো কথার দরকার নেই। কাল আপনার ছুটি। আমি আর আপনি ঘুরতে বের হবো। রাশেদকে আমি বলে রাখব। 
-তোমার শ্বশুর?
-বাবাকে রাশেদ ম্যানেজ করবে। আপনি এখন হাত ধুয়ে উঠে পড়ুন। টেবিল আমি গোছাচ্ছি।

সকাল বেলা ঘর থেকে বের হওয়ার আগে সোমা দেখলো তার শাশুড়ি সাধারণ একটা শাড়ি পরে, কেমন যেন আড়ষ্ঠ হয়ে বসে আছে। লাজুক চাহনিতে তাকাচ্ছে একটু একটু। কেমন বাচ্চা মেয়ের মতো লাগছে। সোমা মনে মনে হাসলো। তারপর শাশুড়ির হাত ধরে বলল-এই শাড়ি পরলে তো হবে না মা। চলুন আমার ঘরে। আমি আপনাকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেই। 

তার শাশুড়ি উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে জানতে চাইল-তোমার শ্বশুর আর রাশেদকে কি বলেছ? তা তো বললে না। তুমি যে কী শুরু করলে, কাল রাতে ভাবতে ভাবতে আমার ঘুমই হয়নি।
-মা, আপনাকে এত কিছু ভাবতে হবে না। আর উনাদের কী বলেছি সেটা না হয় পরেই শুনবেন। এখন জলদি আসুন তো। একটা মাত্র দিন, সময় নষ্ট করা যাবে না।

দুজন বাসা থেকে বের হয়ে ধানমণ্ডি লেকের উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠলো। এখন ফাল্গুন মাস। সোমা তার শাশুড়িকে হালকা গোলাপি রঙের একটা জামদানি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। আর নিজে পরেছে বাসন্তী রঙের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। দুজনেই একটু সাজগোজ করেছে। তার শাশুড়ির যেন সেই আড়ষ্ঠতা কাটছেই না। সোমা শাশুড়ির এক হাত ধরে রেখেছে।

লেক পাড়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই সোমা বুঝতে পারলো তার শাশুড়ির সেই আড়ষ্ঠতা কেটে যাচ্ছে। চোখে মুখে ঝলমলে হাঁসির আভা। কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠছেন। 
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে শাশুড়ি বলে উঠলেন, -বাহ্, এটাতো খুব ভালো জায়গা, বেশ ভালো লাগছে। বলেই একটু অবাক ভঙ্গিতে থেমে দাঁড়িয়ে, সোমার দিকে তাকালেন। সোমাও তাকালো। তারপর দুজনেই খিলখিল করে কিশোরীর মতো হেসে উঠলো। আসলে কথাগুলো একটু বেশিই জোরে বলেছেন। উনাকে এতো জোরে কথা বলতে কখনো দেখেনি সোমা। উনিও নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়েছেন। হয়তো এটা বিশেষ কিছু না। তবু এই ব্যপারটাই তাদের দুজনের কাছেই অনেক মজার মনে হলো। আজ দিনটাই অন্য রকম, আজ মনটাই অন্য রকম।

সারাদিন আরো দুয়েক জায়গায় ঘুরে ফিরে, একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে দুজন গেল বই মেলায়। মেলা থেকে দুয়েকটা বইও কিনলো। 
প্রায় সন্ধ্যা নামার মুখে দুজন হাওয়ায় মিঠাই কিনলো কয়েকটা। উচ্ছলতার সাথে একটু এলোমেলো ভাবে হাঁটছিল তারা। হঠাৎ এক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক এসে দাঁড়ালো সামনে। তার পেছনেই ক্যামেরা নিয়ে আর একজন। 

সোমার কাছে জানতে চাইলো এবারের বইমেলা কেমন মনে হচ্ছে? কী বই কিনলেন? মেলায় এসে আপনার অনুভূতি কী? 
সোমা এই সব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার শাশুড়িকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, উনি আমাদের মা। আজ বত্রিশ বছর পর প্রথম একদিনের একটা ছুটি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন। উনাকে জিজ্ঞেস করুন, উনার অনুভূতি কী? কেমন লাগছে? সাংবাদিক এর কাছ ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হলো।

সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাম্যান তার শাশুড়ির দিকে ক্যামেরা ধরলো। সোমা শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলল -মা, উনারা আপনার সাথে একটু কথা বলবেন। যা মনে আসে বলুন। সংকোচ এর কিছু নেই।
সোমা জানে যে, তার শাশুড়ি জানে না লাইভ টেলিকাস্ট কী। সোমা এও জানে যে, এই সময়ে রাশেদ ও তার শ্বশুর দুজনেই বাসায় বসে টিভি দেখে।
সাংবাদিক লোকটা প্রথমেই জানতে চাইলো, আপনার নামটা বলবেন? আজ আপনার কেমন লাগছে?

সোমা বুঝতে পারলো তার শাশুড়ি একটু ঘাবড়ে গেছে, তাই কাছে এসে একটা হাত ধরে দাঁড়াল। তারপর দেখলো, এক হাতে তার হাত, আর অন্য হাতে হাওয়ায় মিঠাই ধরে, বই মেলার হাজার লোকের মাঝে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলতে গিয়ে একটু থমকে গেলেন উনি। ঠোঁট দুটো মৃদুভাবে কাঁপছে। নিজের নাম কী বলবেন উনি? মিসেস জলিল? রাশেদের মা? নাকি তারও একটা ভুলতে বসা অজানা অন্য কোনো নাম আছে? 

তারপর সোমা তার হাতে একটু জোরালো চাপ অনুভব করল। শাশুড়ির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো উনার চোখ ছলছল করছে কিন্তু দৃষ্টিতে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে। একটু পরেই শুনতে পেল  উনি বলছেন আমার নাম, রাবেয়া বেগম। ডাক নাম, জুঁই। পর পর দুইবার বললেন, আমার নাম জুঁই। যেন শিশুর মত নিজের নাম প্রথম প্রথম বলতে শিখেছেন। তারপর একটু হেসে দিয়ে জোরে সরে আবারো বলে উঠলেন। -আমার নাম জুঁই, আজ আমার ছুটি। এই দুইটা সামান্য কথার যে কি অসামান্য গভীরতা আছে, তা হয়তো সবাই বুঝবে না, কিন্তু পাশে দাঁড়ানো সোমার চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরতে লাগলো। সাংবাদিক দুজনও বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো। আর কোন প্রশ্ন করতে পারলো না।

এমবি//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি