অসমাপ্ত প্রয়াস
প্রকাশিত : ১৩:০১, ১২ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৩:০২, ১২ আগস্ট ২০২০
অনিন্দিতা দাস
১
বিনোদিনী অপেক্ষায় আছেন। বৌটার আজ প্রসব ব্যাথা উঠেছে। সে বারান্দায় দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে, ঘরে নাতনি মণিকে বসিয়ে রেখেছে বৌ এর পাহারায়। কিন্তু সেই বেচারিও ঘুমে ঢুলছে। এদিকে তার সেঝমেয়ে কমলাও নেই বাসায়। পালা দেখতে গিয়েছে। এই এক উদ্ভট শখ তার, যে পালাই আসুক না কেন দেখা চাইই। কীইবা আর করবে, অল্প বয়সে বিধবা হয়ে একমাত্র মেয়ে নিয়ে ছোট ভাইয়ের সংসারে উঠেছে। ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি; তারও বা কী এমন বয়স ছিল যখন অমরের বাবা তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। ভবেশ ১২ আর অমর তখন ৫ বছরের শিশু। কত সংগ্রাম করে পার করেছেন সেই সময়টা তিনি। মানুষ করেছেন সন্তানদের, বিয়ে দিয়েছেন মেয়েদের। ভবেশ এখন জলপাইগুড়িতে একটা চা-বাগানের বড় বাবু; সেখানেই বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে থাকে, আর অমর ডাক হরকরা। আজ সেই অমরের বউয়েরই বাচ্চা আসতে যাচ্ছে, যদিও প্রথম বাচ্চা না এর আগে আরও দুটো মেয়ে হয়েছে ; এরমধ্যে মেঝটার সাথে যমজ আরেকটা ছিল কিন্তু ঈশ্বর তা নিয়ে নিয়েছেন। অজানা এক উতকন্ঠায় বিনোদিনীর নিশ্বাসআটকে আসতে চাইছে আজ যেন, মেয়েটা এখন থাকলে তিনি বাঁচতেন। বৌটার কষ্ট হচ্ছে বেশ। নাহ, আর বসে থেকে কাজ নেই, তিনি উঠে ঘরে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন ‘ও বৌমা অনেক কষ্ট হচ্ছে? আর একটু ধৈর্য ধরো মা।তোমার ননদের আক্কেলখানা দেখেছো, অ্যা? ঘরে পোয়াতি ভাই-বউটার এখন তখন অবস্থা, আর মহারানী চললেন পালা দেখতে, না তো কী সম্রাট অশোকের পালা।কী কান্ডজ্ঞান বাবারে বাবা!বলিহারী, তা আবার বললে তো যা মুখ ছুটাবে তার সামনে কাকপক্ষীও বাড়ির চালে বসতে পারবেনা।’ বলেই তিনি তার নাতনীকে গরম জল আনতে বললেন। সব অপেক্ষা আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই চারদিকে কেঁপে উঠলো সদ্যজাতের কান্নায়, জানান দি্লো সে তার আগমন। এসময় আরেকজনও কাঁদছিলো, কিন্তু তাঁর কান্নার আসল মর্ম কেউই বুঝলোনা। এর মাঝে অবশ্য তার মেয়ে এসে কাপড় ছেড়ে তাকে সাহায্য করেছে। সে ভাবলো মা হয়তো তার ছোটছেলের ঘরের প্রথম পুত্রসন্তান হওয়ার খুশীতে কাঁদছেন। সেই খুশীতো আছেই, কিন্তু তা ছাপিয়েও যে আরো একটা খুশী কাজ করছে তার তা কেউ বুঝতে পারছে না। বহু বছর আগে যে মানুষটার সাথে সাতপাঁকে বেধেছিলেন নিজেকে, যে কিনা স্বার্থপরের মতন তাকে মাঝ সমুদ্রে রেখে ড্যাং ড্যাং করতে করতে পাড়ি জমালেন স্বর্গে। কদিন আগে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বললেন ‘বিনু, তোমাকে একা রেখে চলে এসেছি বলে অনেক অভিমান করে আছ বুঝি! জানি কত কষ্টে তোমাকে এই সংসারটাকে সামলাতে হয়েছে। সম্বল বলতে বাড়িটা ছাড়া তো আর কিছুই ছিল না। যাইহোক, তুমি তোমার দায়িত্ব ঠিক ঠাকই পালন করেছ। তবে কিনা তোমাদের ছেড়ে থাকতে আমারও ভিষণ কষ্ট হয়, আমি তোমাদের কাছে আসছি আবার, অমরের ছেলে হয়ে’ বলেই মহাশয় উধাও হয়ে গেলেন। পরের দিন বিনোদিনী অসাড় হয়ে রইলেন, কোন কাজে যেন হাত সরে না, মেয়ে বার বার শুধোয় ‘মা তোমার হয়েছেটা কি বলো তো, আজ কোন খেয়ালে আছ তুমি? কোন কাজেই তোমার মন নেই’ বৌটাও ঘোমটার ফাক দিয়ে ভীতু উৎসুক চোখে তাকায়, কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস জুটিয়ে উঠতে পারে না। বৌটাকে বেশ শাসনেই রাখেন তিনি। কঠোর তিনি হতে চান না কিন্তু একটু কঠোর না হলেও তো সংসার চলে না। বড় লোকের মেয়ে, দরাজ হাত তার। কিন্তু এ সংসারে অতো দরাজ হাত হলে তো চলবে না বাপু। ছেলেটার রক্ত জল করা টাকায় চলে। কী খেয়ে না খেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠায়। সেদিনের পর থেকে পোয়াতি বৌটার খেয়াল নেয়া শুরু করেন তিনি। আর অজানা এক উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন পার করতে থাকেন। সে কি সত্যিই তার কথা রাখবে না কি আবার তাকে ধোকা দেবে। কিন্তু না এবার উনি উনার কথা রেখেছেন, ফিরেছেন তার রেখে যাওয়া সংসারে এক নতুন রূপে, নতুন শরীরে। আজ কী আর বিনোদিনীর খুশী রাখার জায়গা আছে! তাই তো কিছু খুশী চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
২
কমলা সেদিনই ঘোষণা দিলেন যে ভাইপোর নাম হবে অশোক; সম্রাট অশোকের নামে। হয়ে গেল, বিনোদিনী ভাবলেন মনে মনে পালা দেখে এসে সেই নামই দিলো। মেয়ে আপন মনে বলতে লাগলো ‘দেখো মা, ছেলে আমাদের সম্রাটই হবে। টাকার দিক থেকে না হোক মনের দিক থেকে সে রাজা-বাদশাদের মতনই উদার হবে’ বিনোদিনী বললেন, কেন ‘তোর বাবা কী কম উদার ছিলেন না কি? কত মানুষের বিনে পয়সায় চিকিৎসা করেছেন, তার নাতি তো তার মতনই হবে। এতে আবার নামের কী গুন শুনি?’ মেয়ে কিছু না বলে শুধু মুখ টিপে হাসল। বিনোদিনী নাতির অনেক যত্ন করেন, ভাল করে তেল মাখিয়ে স্নান করা কাঠ-কয়লার আগুনে গা সেঁকে দেন। আর মনে মনে বলেন, ‘পেয়েছি আপনাকে, এবার চোখে চোখে রাখবো। দেখি এবার কীভাবে আমাকে ফাকি দেন। আমার মুখাগ্নী আপনাকেই করতে হবে। এ থেকে মুক্তি নেই’
আতুড়্ ঘরে শুয়ে শুয়ে গৌরি দেখে তার শাশুড়ি কত মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছেন নাতির দিকে আর মিটি মিটি হাসছেন, এ যেন এক নতুন মানুষ, যাকে এর আগে কখনও সে দেখেনি। মনে মনে ভাবে আহা সবসময়ই যদি মানুষটা এমনটাই থাকতেন। সেই দশবছর বয়সে গৌরী এই বাড়ির বৌ হয়ে এসেছে এখন তার পনের চলছে। পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে সে। এক চৈতপূজোর মেলায় তাদের গ্রামে গিয়েছিল নমিতার বাবা, আর সেও এসেছিল বাড়ির পাশের মেলায়। এই চোখে পড়ে যায় অমরের। তারপরেই বিয়ে। যদিও এই বাড়ির বৌ হয়ে আসার কথা তার না। তাদের বংশ সহায় সম্পত্তির সাথে এদের কিছুই মেলে না কিন্তু বাবা মারা যাওয়ায় তার মামারা এই বিয়ে দিলো। গৌরীর বাবা ছিলেন জমিদারের উজির। অনেক জমি-জমা টাকা-পয়সার মালিক ছিলেন, কিন্তু মারা যাওয়ার পর তার সম্বন্ধি সব মেরে খেলো। আর গৌরীর দাদাটাও তেমন উড়নচণ্ডি, কেবল টাকা ওড়াবার ধান্দা। কীভাবে বাবার সম্পত্ত বাড়াবে সেই চিন্তা নেই, বরং উলটোটা করেই চলেছে। নমিতার বাবাতো তার নাম শুনতেই পারে না, কিন্তু গৌরির তো মায়ের পেটের দাদা, সে আর মুখ ফিরিয়ে নেয় কীভবে? তার এক দিদি আছে, তার কোলকাতায় বিয়ে হয়েছে। সে সেখেনেই স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছে। অনেক আদরের দুলালী ছিল গৌরী, তিন ভাইবোনের মধ্যে ছোট সে। কোনদিন কোন কাজ করেনি বাড়িতে। বড় মাছ ছাড়া ভাত খায়নি। ছোটমাছ তার দুই চোখের বিষ। মিষ্টি খেতে সে খুবই পছন্দ করে। টক কোন জিনিস তার সহ্য হয় না। সে ফল হোক আর চাটনিই হোক, তা হতে হবে কড়া মিষ্টি। গৌরী অতীত থেকে ফিরে নিজের ছেলের দিকে তাকায় ঠাকুমার কোলে সে হাত-পা নেড়ে খেলছে। অশোকের বড় নমিতা আর সবিতা তার দুই মেয়ে আছে তার। ছেলেটার দিকে তাকালেই চোখটা জুড়িয়ে যায় তার। ঘর আলো করা রূপ তার। গৌরী চোখ ফিরিয়ে নেয়, না জানি ছেলেকে তারই নজর লেগে যায়, পরে ছেলের আঙ্গুলে একটা কামড় দিয়ে দিতে হবে, মনে মনে ভবে সে।
লেখক: অনিন্দিতা দাস, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং উদ্যোক্তা, ঐতিহ্যের ঝাঁপি (অনলাইন শপ)।
একে//