বঙ্গনীড়
প্রকাশিত : ২০:৫৬, ১ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১৭:০৭, ৮ আগস্ট ২০২১
যখন আমি এ কবিতাটি লিখছি
তখন মসজিদ থেকে
এক ভীতিকর দুঃসময়ে
আজানের ধ্বনি ভেসে আসছেঃ
মনে পড়লো সেই পঁয়তাল্লিশ বছর আগে
আগস্টের পনের তারিখ!
ঠিক এসময়ে
মাতৃগামী ঘাতকের দল
বাঙালির গৌরবের
আমাদের সৌরভের
অবিনাশী আলোর বাড়িকে
কী নির্মম রক্তস্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছে--
মুহূর্তেই ওই বাড়িটাকে তারা পরিণত করে
কী অসহ্য হত্যাযজ্ঞের লীলাক্ষেত্র!
দেখতে দেখতে
দিন যায় মাস যায় বছরও যাচ্ছে
সময় বহিয়া যায় -- মুজিব অমর,
তাঁর আত্মা থেকে
দুঃখিনী বাংলার ঘরে ঘরে
মহাকাল ব্যাপ্ত এক চিরন্তন
মহামানবের জন্ম হয়,
যার কোনো মৃত্যু নেই --
লয় কিংবা ক্ষয় নেই ;
লাল সবুজের পতাকা জড়িয় গায়ে
প্রত্যেক মুহূর্তে তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠছেন
বিশাল সমাধি নয়,
নয় কিন্তু
বিন্দু বিন্দু নক্ষত্রমণ্ডল--
বাঙালির হৃদয়মণ্ডলে
পিতা তিনি জীবিত, অম্লান;
আমাদের প্রতি বর্গ ইঞ্চি
মাটির উপর তিনি দাঁড়িয়ে আছেন--
উপরে আকাশ
সম্মুখে পাহাড় নদী সমুদ্রের অশান্ত গর্জন
অবারিত শস্য ক্ষেত চারিদিকে তুমুল উত্থান
কিন্তু বাড়িটা কোথায়? সে-বাড়িটা!
ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে ছোট্ট আঙিনা সমেত
যে- বাড়িটা ছিলো
নিপীড়িত বাঙালির শক্তি ও সাহসের অক্ষয় মিনার।
সে-বাড়ি এখন আর কোনো বাড়ি নয়
শুধু এক শোকাচ্ছন্ন স্মৃতিজাদুঘর।
তা হলে কি যে মুজিব জাতিপিতা
নিয়ত প্রবল সত্যে চিরঞ্জীব তাঁর কোনো নিবাস থাকবে না!
তিনি পিতা ঘুমোচ্ছেন মা-বাবার কোলে ;
আর পাশে অদৃশ্যে ঘুমিয়ে আছে প্রিয় স্বপ্নগুলো--
যে বাড়িতে ঘুমোচ্ছেন বঙ্গপিতা,
সে- বাড়ির নাম কি তবে বঙ্গভবন?
কিন্ত পঞ্চাশ বছর ধরে এ নামে যে ভবন রয়েছে
ওটা রাষ্ট্রপতির দপ্তর এবং নিবাস!
তবে কী জাতির পিতা এখন যে বাড়িতে আছেন
সে- বাড়ি বেনামি পরিচয়ে নামহীন রয়ে যাবে!
২.
যে দিন পিতাকে ওরা সমাহিত করে
মূলত সেদিন থেকে ওই বাড়ির বদলে
পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে আমি মনে মনে
একটি বাড়ির নাম খুঁজছিঃ
কখনো ভুলিনি, কিছুতেই ভুলতে পারি না;
মনে আছে অভিশপ্ত
সেই কালো রাত্রির সুবেহসাদেকে
দুর্বিনীত আস্ফালনে যখন খুনিরা
জাতির পিতাকে তাঁর নিজের বাড়িতে হত্যা করে--
কোনোরূপ প্রতিরোধ ব্যতিরেকে
পুরুষ-নারী ও শিশু নির্বিশেষে
নির্বিচারে গণহত্যা চালায় পশুরা
তখন কোথাও প্রতিবাদে চিৎকার করেনি কেউ ;
বাকরুদ্ধ জনগণ!
প্রতিরোধী শক্তি ও সাহস বুকে
সম্মুখে আসেনি --
সব ভীরু কাপুরুষ ইঁদুরের গর্তে ঢুকে পড়ে;
অবরুদ্ধ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাই আমি --
আমার নিখিল জুড়ে নেমে আসে গাঢ় অমানিশা।
অন্যদিকে অজপাড়া ঐ টুঙ্গিপাড়ায়
পিতাকে চরম অবজ্ঞায় তুচ্ছতায়
আহা! তোপধ্বনি ছাড়া সমাহিত করা হয়;
কোথাও ক্রন্দন নেই অন্তরের বন্ধন ছিল না
সারা দেশ জুড়ে নেমে আসে
কবরের থমথমে স্তব্ধ নির্জনতা ;
তখন আমার মনে হয়
লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে পাওয়া এই বাংলাদেশ
পরিণত হয়ে গেছে চোখের পলকে
জনকের রক্ত খেকো গোরস্তানে !
জাতির পিতাকে হারানোর বেদনার বিষে নীল
হতবাক এক উন্মত্ত কিশোর, যে তখনও
কবিতায় পোক্ত হয়ে নামধাম কুড়োতে পারেনি।
১৬ আগস্ট ১৯৭৫
কার্ফিও আক্রান্ত রাতে
রাগে ক্রোধে প্রতিবাদে
সে- কিশোর হাতে নেয় কাঠের পেন্সিল,
অন্ধকারে মোমের আলোয়
লিখে ফেলে তার প্রতিবাদী প্রথম কবিতা--
' সহসা আগুন জ্বলে যমুনার জলে'।
কবিতাটা দীর্ঘ বটে -- আজ আর পুরো মনে নেই;
তবে শেষ স্তবকের কয়েকটি স্মরণীয় পঙক্তি
আমি মাঝে মাঝে
কখনো সরবে, কখনো বা মনে মনে
উচ্চারণ করে থাকি, অনেকেই করে করে থাকে--
"স্বদেশী কুত্তার পিঠে বিদেশি শকুন
বেশ্যার ছেলের হাতে ইতিহাস খুন
আগুন লেগেছে তাই যমুনার জলে
আগে আগে হনুমান রাম পিছে চলে
সীতাকে হরণ করে রাক্ষস রাবণ
টুঙ্গিপাড়ায় হবে বঙ্গভবন। "
দেখতে দেখতে
পঁয়তাল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে
দেখি বঙ্গভবনের পাশে আছে নগরভবন
যাকে বলা যায়
পাথরে পাথর মিলে তৈরি করে পাথর নিবাস
ইট পাথরের মিলনের কী যে মনিযোগ!
যেখানে হৃদয় নেই, হৃদয়ের গন্ধ পাওয়া ভার
সেখানে হৃদয়বান বাঙালির মহামতি পিতা
কী করে থাকবেন!
কিশোর এখন আর সে-কিশোর নেই
খেলা শেষ বেলা প্রায় ডুবো ডুবো
এবার যাবার পালা--
টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বঙ্গভবনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে
আজ সেই কিশোরের পঁয়তাল্লিশ বছর কেটে গেছে;
পরিপক্ক বয়সে এসেই তার মনে হলো
ঐ নগরভবনের পাশে
বঙ্গভবন যে নামে পরিচিত সে- নামেই থাক
মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান নাগরিক
নগরভবনের পাশে তাঁর রাষ্ট্রীয় নিবাস
খুবই মর্যাদাপূ্র্ণ এ ভবনে মহামান্য থাকছেন,
তিনিই থাকুন -- আমি আর আপত্তি করি না;
তবে সবিনয়ে তাঁর কাছে একটা আর্জি পেশ করি--
জাতির পিতার জন্য
একটি নিবাস দিন -- চাই তাঁর অক্ষয় ঠিকানা;
পৈত্রিক বাড়িতে তিনি ঘুমোচ্ছেন
ঘুমোবেন অনন্ত অনন্তকাল
শান্তি আর প্রশান্তির
পরম আশ্রমে পিতা
ঘুমোচ্ছেন এ বাড়িতে,তাই
সোজা কথা-- এক দফা এক দাবি--
এ বাড়িকে বলা হোক,
বাড়ি বা ভবন নয়-- বঙ্গনীড়... বঙ্গনীড়... বঙ্গনীড় ।