ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না

আসাদ মান্নান 

প্রকাশিত : ২২:০১, ৬ আগস্ট ২০২১

[অগ্রজের প্রয়াণে একটি এলিজি]
সে এক অদৃশ্য খুনি, বলা যায় ক্ল্যাসিক জল্লাদ;
সর্বক্ষণ ঘুরতে থাকে যত্রতত্র এখানে ওখানে,
তার হাতে দেয়া আছে অন্য জীব কিংবা জন্তু নয়
কেবল কর্তৃত্ববাদী মানুষের মৃত্যু পরোয়ানা!
জলে স্থলে অন্তরীক্ষ্যে এ কেমন আতঙ্ক সন্ত্রাস!
মানুষের দেহ থেকে দেহে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে
মরণ জীবাণু ; নিজেকে নিজের মতো প্রতিরক্ষা
দিতে হবে: আগে নিজে বাঁচো পরে অন্যকে বাঁচাও—
এমন উদ্ভট যুদ্ধের কৌশল নিয়ে গ্রামে গঞ্জে
ঘরে বাইরে অফিসে ব্যারাকে সর্বত্র যুদ্ধের রব;
সড়কে পুলিশ আছে সঙ্গ ঘোরে সৈনিকের দল—
ঘরে থাকো দূরে থাকো একা থেকে একা হয়ে যাও;
জানালার পর্দা তুলে মাঝেমধ্যে তাকাও আকাশে—
ওখানে নক্ষত্রবীথি তার পাশে স্বপ্নের কফিন।

২.
মানুষবিনাশী এই ভয়ঙ্কর হিংস্র ভাইরাস
ইতোমধ্যে তার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মূল শক্তি
দেখিয়ে দিয়েছে; অনায়াসে বিজয়ী বীরের মতো
ঘটিয়ে চলেছে দ্রুত পৃথিবীর প্রায় সব দেশে
এ নতুন ওহান ভাইরাস; এক নামে পরিচিত—
বিশ্বমারী ঘাতক করোনা; দিন যায় মাস যায়—
সমূলে বিনাশ হবে এরকম লক্ষ্মণ দেখি না,
কখনো বাতাস থেকে অক্সিজেন হাওয়া হয়ে যায়।
কী করে করোনা জানে জীবনের প্রথম চাহিদা
অক্সিজেন নিতে যদি ব্যর্থ হয় মানব সন্তান
তবে যে নিঃশ্বাসহীন কবরেই দেহ চলে যাবে;
ইতোমধ্যে বহু লোক—ধনী বা নির্ধন নির্বিশেষে
করোনা পীড়িত হয়ে যমের দুয়ারে পৌঁছে গেছে—
হাসপাতালে রোগী নিয়ে ঝগড়া করে স্বজন-সেবিকা।

৩.
ঘড়ির ডায়ালে বসে স্থবিরতা বরফে ঘুমায়,
আমার আসে না ঘুম, গত রাতে ঘুমোতে পারিনি।
দুর্বিনীত করোনাকে বাগে আনতে সরকারি নির্দেশ
যখন ঘোষিত হয় তখন সবাই গৃহবন্দি
জীবনে জাবর কাটে; আমিও উদ্বেগে উৎকণ্ঠায়
ভোরের ভেতরে খুঁজি কত দূরে আলোর ফোয়ারা—
সমুদ্রে ঝড়ের আগে পাল তোলা নৌকা বেয়ে যাবো!
এক দূই তিন চার গুণতে গুণতে দিন গুনতে থাকি।
করোনা বিস্তার রোধে সারা দেশ যখন প্রস্তুত,
লকডাউনে টানা হলো বিধি আর নিষেধের বেড়ি
তখনই সংবাদ পাই সহোদর হাফেজ নুর-উস
ছফা নেই—আমাদের বাবার মতন কালেমায়ে
শাহাদাৎ পড়তে পড়তে মহান আল্লার ডাকে সব
মায়ার বন্ধন ছেড়ে চলে গেছে মা-বাবার কাছে
(ইন্নালিল্লাহে ওইন্নাইলাহে রাজেউন—নিশ্চয়ই তিনি
প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না—আমার দাদাকে
প্রতিশ্রুত জান্নাতে রাখবেন)।

৪.
এমন দুর্ভাগ্য যেন আর কারো জীবনে না-ঘটে,
যেমন শিকার আমি দুর্বিষহ দৈব অভিশাপে।
শুনেছি মায়ের কাছে—বহু বার কেঁদে কেঁদে তিনি
বলেছেন তাঁর জীবনের প্রথম শোকের কথা:
আমারও জন্মের বহু আগে ভীতিকর মহামারী
কলেরায় মায়ের নাড়ির ধন, প্রথম সন্তান;
মছু ভাই মারা যায়; সে-সময় একান্ত কাছের
স্বজনেরা ছাড়া আর অন্য কেউ পাশে তো ছিল না!
আমাদের জেঠামনি প্রয়াত আতর আলী হাজি
আরবি আতর মেখে গল্পে শোনা আমার না-দেখা
ভাইকে কবর দেন তাঁর বাবা অর্থাৎ আমার
দাদা কালামিয়া মালাদার, যিনি আমার জন্মের
বহু পূর্বে মারা যান সাপের কামড়ে, তার পাশে;
ওলা বিবি সবংশে শিকার করে আমার মামাকে।

৫.
এবার মায়ের পাশে ভাইটাকে শোয়ানো হয়েছে;
সবাই আছেন কাছে—ছেলে-মেয়ে, প্রিয় প্রতিবেশী—
সবার ওপরে তার বুকে গাঁথা কোরানের আলো,
খোদার ফেরেস্তা তাকে লাঠিহীন প্রকৃত গন্তব্যে
পরম মর্যাদা দিয়ে নিয়ে যাবে, আমার বিশ্বাস;
প্রশান্তির দীর্ঘ ঘুমে মৌনতায় ঘুমোচ্ছেন দাদা
যেমন মায়ের কোলে শুয়ে আছে নিরাপদ শিশু;
কফিন চলেছে উড়ে—পিছে কত শত লোক যায়!
শরীরে সৌরভ মেখে গৌরবের স্মৃতি চিহ্ন রেখে
খোদার অতিথি হয়ে চলে যাচ্ছে নূর-উস ছফা,
বুবু আর আমি শুধু তার ওই অন্তিম যাত্রায়
অংশ না- নিয়েই দূরে—দূর থেকে বিলাপ করেছি—
যে বুকে কোরান জ্বলে ওই বুক আগুনে কি পোড়ে?
আমার চোখের জলে নরকের অগ্নি নিভে যায়।

৬.
এ কেমন অক্ষমতা কেউ তার জবাব জানে না!
এত অসহায় আমি কোনোদিন নিজেকে ভাবিনি,
সুদূর কৈশোর থেকে ভালোবেসে আপন স্বভাবে
বিপন্ন মানুষ দেখলে সেবা নিয়ে আমি ছুটি গেছি ;
চোখে ভাসছে সত্তুরের সেই ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস,
বঙ্গোপসাগর পাড়ে অগুনিত লাশের মিছিল—
দক্ষিণে কালির চরে কত কত লাওয়ারিশ লাশ
দাফন কাফন ছাড়া নিখোঁজ রয়েছে প্রিয় জন।
শবাকীর্ণ সন্দ্বীপের উপদ্রুত দীর্ণ উপকূলে
খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই অনাত্মীয় মৃতদের দেহ;
অদূরে শিয়াল কাঁদে—কুকুরের দারুণ উল্লাস;
দিগন্ত চৌচির করে এই সত্য উচ্চারিত হয়—
নদীর ওপারে আছে জীবনের শেষ চাওয়া-পাওয়া;
মরে গেলে মানুষের আর কোনো স্বজন থাকে না।

৭.
গোত্রমিত্র পরিজন লুপ্ত হয় সমাজকাতারে
সামাজিক দায় থেকে সবাই সবার পাশে থাকে,
প্রকৃত মানুষ হাত রাখে অচেনা মউতের মুখে
দুঃসময়ে এ হাতে অনেক লাশ দাফন করেছি
কবরে রেখেছি কত বিকৃত বিবস্ত্র নরনারী।
অথচ এমন এক দুঃসময়ে আপন ভাইয়ের
জীবনের শেষ দৃশ্যে আমি নেই—এমন নিয়তি,
কী আর করার আছে নিয়তির নিয়ম না-মেনে!
আমার হিসাবে প্রভু! যদি কিছু নেকি জমা থাকে
তা থেকে ভাইয়ের নামে কিছু আমি লিখে দিতে চাই,
বাকিটা মায়ের জন্য—সঙ্গে বাবা যৌথ দাবিদার;
আমার নগন্য আর্জি পাঠালাম তোমার অফিসে;
কবুল না হলে দ্যাখো পুড়ে যাবে হিসাবের খাতা:
প্রজারা বিশ্বস্ত থাকলে রাজা নাকি নিরাপদ থাকে।

৮.
আমি তো সামান্য বান্দা; সারাক্ষণ তোমার সেবায়
নিজেকে রেখেছি রত, এমন ভাবি না; তবে ঠিক
নিরাকার তোমাকে এমন রূপে ধারণ করেছি
আমি একা কিন্তু একা নই; আমার রক্তের মধ্যে
ধারণ করেছি আমি সমুদ্রের উত্তরাধিকার
নিখিলের ধ্যানচক্র, কুয়াশার সমূহ বিনাশ,
আমার মায়ের মতো ভালোবাসি গোলাপের হাসি
বাঘের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া হরিণীর প্রেম।
আমার ভেতর দিয়ে বহমান অনন্ত কালের
নদীর ধারাকে তুমি যদি অন্যদিকে, অন্যখানে
নিয়ে যেতে চাও, তবে নাও—আমার আপত্তি নেই
যা কিছু তোমার ইচ্ছে যখন তখন করতে পারো;
তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবার শক্তি আছে কার?
সুন্দরের আমি অন্ধ সেবাদাস—তোমার পূজারী।

৯.
সমস্ত সৃষ্টির মূল শূন্যতার তুমি অধিশ্বর;
রাজা আসে রাজা যায় স্হায়ী শুধু তোমার আসন।
তোমাকে পাওয়ার জন্য মুনি ঋষি গাউস কুতুব
বুকে যে আগুন জ্বালে আমি তার উত্তাপ কুড়াই।
তুমি তাই ডিক্টেটর ক্ষমতার একক মালিক!
অনেক হয়েছে খেলা; ফাউলের শাস্তি লাল কার্ড
অনেক দেখালে প্রভু! আর কত—এবার থামাও,
আমাকে তোমার নামে যদি বলো শত কোটি বার
সেজদা দিতে তাও দেবো, শুধু বিশ্বব্যাপী চলমান
দুর্বীনিত জীবাণু যুদ্ধের সমাপ্তির পর্দা টানো;
না-টানলে বিনষ্ট হবে বিশ্বাসের বেহেস্তি আঙুর।
করোনার দুঃসময়ে যারা আজ প্রয়াত হয়েছে
তাদের হিসাবে যদি পাপ বলে কিছু লেখা থাকে
পাপটাকে মুছে দিয়ে নিজ গুণে পুণ্য লিখে দাও।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি