শেখ মাতিন মোসাব্বির: এ কংক্রিটের শহরে এক নাগরিক কবি
প্রকাশিত : ২০:১৮, ৬ মার্চ ২০২২
প্রত্যেক কবির কবিতায় একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর থাকে। আর সেই কবি যদি হন পরিণত কবি, তাহলে তার সেই স্বাতন্ত্র্য বুঝে নিতে সচেতন পাঠক বা সমালোচকের কোনোই অসুবিধা হয় না।
প্রতিটি মানুষ যেমন ব্যক্তি হিসেবে ভিন্ন, তার চেহারা, তার রুচি ভিন্ন, তার কণ্ঠস্বর ভিন্ন, সেহেতু তার রচিত কবিতাও ভিন্ন হতে বাধ্য। শিল্পের বিচারে এবং কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন কবি’রা তাই যুগ যুগ ধরে রাজ করে যাচ্ছেন বাংলা কবিতায়।
আজকের আলোচ্য সূচিতে বিশেষ এক কবির কবিতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এই কবি পরিণত বয়সের কবি। এই কবি সবার থেকে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের অধিকারী। কারণ তিনি নবযৌবনের শুরুতে কবিতা লেখা শুরু করলেও, পরিণত বয়সে এসে তার আত্মজ কবিতাগুলোকে মলাটবদ্ধ করেছেন। আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘অনুভূতির অনুরণন’-এর কবি শেখ মাতিন মোসাব্বির।
শেখ মাতিন মোসাব্বির কবিতা লেখেন পরিণত শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে। কিন্তু তিনি রাজনীতির সঙ্গে পারিবারিক সূত্রে জড়িয়ে আছেন সেই বাল্যকাল থেকে। রাজনীতির ঘোরটোপে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে শেখ মাতিন মোসাব্বিরের কবি পরিচয় অনেককাল লুকিয়ে ছিল বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে। কবি পরিচয়ের বাইরে রাজনীতিক হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি।
শেখ মাতিন মোসাব্বিরের খুব কাছের মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানতেন না তার কবিতাচর্চার কথা। আসলে কবিতা হচ্ছে ছাইচাপা তুষের আগুনের মতো। কারও কারও ক্ষেত্রে আগ্নেয়গিরির আগুনের মতো— জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। শেখ মাতিন মোসাব্বিরের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে।
অনেককাল আগে থেকেই শেখ মাতিন মোসাব্বির নিভৃতে কবিতা লিখলেও গ্রন্থভুক্ত কবি হিসেবে তার সরব উপস্থিতি সম্প্রতিকালে বোদ্ধা মহলে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হিসেবে কাজ করেছে। তিনি এখন সবার কাছে একজন রাজনীতিকের পাশাপাশি কবি হিসেবেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন।
প্রকৃতপক্ষে কবি হিসেবে শেখ মাতিন মোসাব্বিরের এই গ্রন্থভুক্ত উত্তরণ অনেককেই কিছুটা বিস্মিত করেছে। আমি মনে করি, দেরিতে বিস্ফোরণ ঘটায় তা শেখ মাতিন মোসাব্বিরের জন্য শাপে-বর হয়েছে। তিনি পরিণত বয়সে যেহেতু তার কবিতার গ্রন্থভুক্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেহেতু আটঘাট বেঁধে এই পথে নামার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে অনেকগুলো বিষয় তাকে মাথায় রাখতে হয়েছে। তার প্রথম দিককার কবিতাগুলো পাঠ করা হলে ধাপে ধাপে পরিণত কবি শেখ মাতিন মোসাব্বিরের উত্তরণটি সহজেই চোখে পড়বে। শুধু শেখ মাতিন মোসাব্বিরের ক্ষেত্রেই নয়, সব কবির ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে— প্রথম দিককার কবিতাকে ছাপিয়ে পরিণত হয়ে ওঠেন কবি।
রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দের মতো কবিদের কথাই যদি ধরি, তাদেরও পরিণত বয়সের প্রাজ্ঞতা কি প্রথম বয়সের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যাবে? রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যাসংগীত’ এবং ‘প্রভাতসংগীত’-এর কবিতার সঙ্গে তার পরবর্তীকালের কবিতার তুলনা করা যাবে? অথবা জীবনানন্দ দাশের ‘ঝরাপালক’-এর মতো কাব্যগ্রন্থকে কি পরবর্তীকালের কাব্যগ্রন্থসমূহের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে? ‘ঝরাপালক’-এর পরবর্তীকালের কাব্যগ্রন্থগুলোর কবিতাগুলোর মধ্যে যে বিপ্লবাত্মক বাঁকবদল, তা বাংলা সাহিত্যে একটি বিস্ময়কর ঘটনা বলেই বোদ্ধা মহলকে স্বীকার করে নিতে হয়েছে। জীবনানন্দের বাঁকবদলের সেসব কবিতায় একজন পরিণত কবির আবির্ভাবের সম্ভাবনার বিদ্যুৎঝলক কারও দৃষ্টির অগোচর থাকেনি। এই আলোকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে কবিতার জগতে শেখ মাতিন মোসাব্বিরের পরিণত আবির্ভাবের সম্ভবনাও তার প্রথমদিকের কবিতায় আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি।
হে আমার মিছিলের সঙ্গীরা, আমার বন্ধুরা, আমার ভাইয়েরা
আমার জীবনের সূর্য যখন অস্তমিত হবে,
আমার প্রিয়তমার সাথে সাথে তোমরাও থেকো আমার পাশে।
দেখে নিও, আমার সূর্য সন্তানের মুখ চেয়ে
তৃপ্তি নিয়ে আমার না ফেরার দেশে চলে যাওয়া।
[সূর্য সন্তান, (অনুভূতির অনুরণন)]
এই কবিতা পড়ে কি মনে হচ্ছে না, একজন সম্ভবনাময় পরিণত কবির আবির্ভাবের আভাস আমরা টের পাচ্ছি? আসলে কবি এভাবেই সামনের দিকে এগিয়ে নিজের অন্তিমকালকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলেন। কবিতা যদি একজন কবির জীবনচর্চার আঁধার হয়, ধ্যানের বিষয় হয়, তাহলে সেই কবির পক্ষে ক্রমপরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া সাফল্যের সঙ্গেই সম্ভব। রাজনীতির পাশাপাশি যখন একজন কবি কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন তিনি অন্য কবিদের থেকে অনেক বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে ওঠেন। কবিরা যা দেখেন কল্পনায়, রাজনীতিবিদ তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকেন বলেই কল্পনা ও বাস্তবের মিশেলে একটি ঘনঘোর আবহ তৈরি করে কবিতাকে ঊচ্চ মার্গে পৌঁছে দেওয়া রাজনীতিবিদ কবিদের পক্ষে অনায়াসেই সম্ভব হয়। আর তাই তাদের কবিতা অনিবার্যভাবেই হয়ে ওঠে অন্তর্গতভাবে সুদূরপ্রসারী।
আমরা যদি অক্টাভিও পাজ কিংবা পাবলো নেরুদার কথা ভাবি, তাহলে দেখব— চেতনার অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্তিত্বের বিপুল আঁধার সঞ্জীবিত থাকলেও তাকে গভীর ও গূঢ়তর কবিতা করে তুলতে এই দু’জনের কারোরই কোনো কষ্ট হয়নি। যদিও অক্টাভিও পাজ একটি সময়ের পরাবাস্তব আন্দোলনের এক ধরনের মোহাবিষ্ট ধাঁধাঁর মধ্যে নিজের কবিতাকে সংশ্লিষ্ট করেছেন, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তার কবিতা যে মানবিকীকরণের এক ধরনের গূঢ় অহংকরের আঁধার হয়ে উঠেছে— এটি অস্বীকার করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। আর পাবলো নেরুদা তো ছিলেন রাজনীতিরই লোক। তার কবিতা রাজনীতির সংশ্লেষে অন্যদের কবিতার চেয়ে একটি গভীর তাৎপর্য নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে সমাদৃত হয়েছে— এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এত কথা বলার মূল কারণ— শেখ মাতিন মোসাব্বির তার কাব্যিক মনোভূমিতে নিজেকে যে ক্রমাগত সম্প্রসারিত ও পরিণত করে তুলেছেন, তা তার আলোচিত কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করলে সহজেই অনুমান করা যাবে। কয়েকটি কবিতাংশের উদাহরণ না টেনে পারছি না:
হঠাৎ একটি গোমড়ামুখ কাশফুলবলে,
আমি ছিলাম কাঁটাবনে, পরিবাগের খালের ধারে,
ধোলাইখাল মিলব্যারাক হয়ে বুড়িগঙ্গার তীরে।
আমি ছিলাম কামরাঙ্গীরচর, ঝাউচর থেকে
বসিলার বিশাল জলাশয়ের মাঝে।
নলখেগড়ি বন ছিল আমার সই,
টুনটুনি আর চখাচখির বাসা ছিল
আমাদের ঝোপঝাড় আর ডালে।
পাখির কলকাকলি আর মাছে ভরা জলাশয়,
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপহার ছিল শুধু তোমাদের জন্য।
তোমরা আবসনের নামে তা করেছ ধ্বংস।
এয়ারপোর্ট রোডের দুইধারে জলাশয়ের পাশে
আশুলিয়ার বিশাল প্রাকৃতিক জলাধারের পাশে ছিলাম,
ছিল নাম না জানা শত প্রজাতির মাছ আর ফুল,
শিল্পায়নের নামে তাও করেছ ধ্বংস।
আজ আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছ বালু নদীর পাড়ে,
শহরের বাইরে আজ আমরা টিকে আছি।
শুধু স্বীয় জীবনীশক্তিতে।
মনে রেখ, যেদিন আমরা আর থাকব না,
সেদিন তোমাদের শহরটা শকুনে ভরে যাবে।
[কাশফুলের আর্তনাদ, (অনুভূতির অনুরণন)]
কি অদ্ভুত মিল
মানুষ আর ফানুসে।
[ফানুস, (অনুভূতির অনুরণন)]
স্রষ্টার সাথে কখনো
স্রষ্টার বিরোধ হয় না।
[ধর্মতত্ত্ব, (অনুভূতির অনুরণন)]
পাহাড়ি হলে বৈসাবি উৎসবে,
সব জল তোমায় দিতাম।
ফুলশয্যা নয়,
আমাদের প্রথম হতো জলশয্যা।
[জলকেলি, (অনুভূতির অনুরণন)]
আবার দেখা হবে মঙ্গল শোভাযাত্রায়।
আবার দেখা হবে ভোরের স্নিগ্ধতায়।
আবার দেখা হবে বিজয়ের বেশে।
[প্রত্যাশা, (অনুভূতির অনুরণন)]
আমি সমব্যাথী,
আশ্রয়হীন আর হকারদের প্রতি,
ওদের জন্য মেঘলা দুপুর উপভোগ্য নয়!!
মেঘলা আকাশ আর ঝুম বৃষ্টি
ওদের জন্য সীমাহীন কষ্ট ও জীবন যুদ্ধ।
[মেঘলা দুপুর, (অনুভূতির অনুরণন)]
নূর হোসেন, বাবুল, ফাত্তাহর রক্তের দায়,
আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় অহর্নিশ।
স্মরণে আসে, আরো সহযোদ্ধাদের কথা,
অকালে অপঘাতে যাদের হারিয়েছি।
[শ্রদ্ধা ও ক্ষমা, (অনুভূতির অনুরণন)]
এ ধরনের কবিতা লিখতে গিয়ে কবি হিসেবে রাজনীতিক শেখ মাতিন মোসাব্বিরের তেমন কোনো দ্বৈরথ তৈরি হয়নি। তার আত্মদর্শন কিংবা তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় সাধন করে তিনি কবিতাকে একটি গভীর ও গূঢ়তর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে সাঙ্গীকৃত করতে পেরেছেন। কবি হিসেবে এখানেই তার ভিন্নতা ও সার্থকতা। শেখ মাতিন মোসাব্বিরের কবিতাকে বুঝতে গেলে ব্যক্তি শেখ মাতিন মোসাব্বিরকেও বোঝার দরকার আছে। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন, ‘কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে’, কিন্তু আমার মনে হয় কবির কবিতাকে সূক্ষ্মভাবে বোঝার জন্য কবির ‘জীবনচরিত’ বোঝাও খুবই প্রাসঙ্গিক।
শেখ মাতিন মোসাব্বিরের ‘অনুভূতির অনুরণন’-এ বিস্মিত হয়েছি এই জন্য যে তিনি তার কবিতার পরিণতির জন্য যে ক’টি অনিবার্য সত্য পূরণ করা জরুরি, তা খুব সাহসের সঙ্গে পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে কবিতার রহস্যময়তা, দর্শন, ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের নিপুণ এবং যথাযথ ব্যবহার কখনো কখনো তার কবিতাকে শক্তিশালী সৃষ্টি হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।
কবিতা লেখার সময় আধুনিক কবিতার যে দাবি, তা পূরণের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছেন তিনি। সেটি চেতনার দিক থেকে যেমন সত্য, ঠিক তেমনি কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও সত্য। শেখ মাতিন মোসাব্বির খুব সতর্কভাবে বাংলা কবিতার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পরিভ্রমণ করেছেন। শেখ মাতিন মোসাব্বিরের এই পর্যটনপ্রিয় পরিভ্রণে সতর্কভাবে তার সঙ্গী হয়েছেন— রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে কিংবা বিনয়ের মতো বাংলা কবিতার রাজ পরিব্রাজকেরা।
শেখ মাতিন মোসাব্বিরের কবিতা নিয়ে সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনার ইচ্ছা থাকলেও সময়হীনতার কারণে সেটি সম্ভব হলো না। এ নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইল। তবে যেটুকু আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি তাতে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়— শেখ মাতিন মোসাব্বির মলাটবদ্ধ কবি হিসেবে যখন এবং যেখান থেকেই যাত্রা শুরু করে থাকুন না কেন, তাতে কিছুই আসে যায় না। বাংলা কবিতার আলপথ যে তার জন্য ক্রমশ রাজপথ হয়ে উঠেছে, এ ব্যাপারে বোদ্ধা মহলের কোনো সন্দেহ নেই। শেখ মাতিন মোসাব্বিরের কবিতা বাংলা কবিতার ভিন্ন পথে বিস্তৃত এক নতুন নগর। শেখ মাতিন মোসাব্বির এ কংক্রিটের শহরে এক নাগরিক কবি।
এসি