ঢাকা, বুধবার   ০৯ অক্টোবর ২০২৪

ব্লাড ডোনেট ক্লাবের বিশেষ অতিথি 

রুহুল আমিন বাচ্চু

প্রকাশিত : ১৪:৪৯, ২০ ডিসেম্বর ২০২২

‘নানা, নানা তুমি সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছ?’

‘যাবে নাকি আমার সাথে সুহামনি?’

‘না, এখন যাবো না। নানা শোনো না, তোমাদের পুরান বাড়ির আমার নতুন বন্ধুদের সাথে মিলে জোলাভাতি খেলবো। না না এবার মিছেমিছি বালুর পোলাউ, আর শুকনো পাতার কোর্মা না, বলে, ‘হি হি করে হাসতে থাকে সুহা।’

‘শাহান একটা লাঠি নিয়ে তরবারির মতো করে সাঁই সাঁই ঘুরাচ্ছে। ঠিক কার্টুন ছবি লাড্ডুর মতো করে। নানার দিকে এবার তাকিয়ে বলে, ‘ওরা আমাদের দাওয়াত দিয়েছে।’

সুহা বলে, সকালে রামিসা ফারহা আর সাফা এসেছিল আম্মুর কাছ থেকে একশত টাকা নিয়ে গেছে। ওরা চিকেন বিরিয়ানী করবে, আমি পেঁয়াজ, শশা, ধনিয়াপাতা কাটবো। এক্ষুনি যেতে বলেছে।

‘বুঝেছি, কিন্তু আমার দাওয়াতটা বাদ পড়লো কেন? আমাকে বাদ দিয়ে ওরা জোলাভাতি করবে না-না তা হবে না। ওদের বল আমাকে দাওয়াত দিতে, নইলে সব ভুণ্ডুল করে দেব। হ্যাঁ, ভুণ্ডুল... শাহান দুপুরের পর থেকেই পাঞ্জাবির ওপর কটি পরে তৈরি। নানার কথা শুনে প্রশ্ন করে, ‘নানা ভুণ্ডুল যে বল্লে- এর অর্থ কী!’

সুহা নানার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নানা, সকালে তোমার ঘরের পিছনের বাগান থেকে লাকড়ি কুড়িয়েছি। জোলাভাতির লাকড়ি নাকি কুড়িয়ে নিতে হয়, তাহলে আসল জোলাভাতির মজা পাওয়া যায়। সাফা আমার সাথে ছিল। ও না গাছে চড়তে পারে। একদম উপরে উঠে যায়...

দূর থেকে মাইকে ঘোষণা করছে, ‘ভাইসব, ভাইসব, খিলপাড়া ব্লাডডোনেট ক্লাবের পঞ্চবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এক রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। স্থান-খিলপাড়া প্রাইমারি স্কুল মাঠ, সময় বিকেল চার ঘটিকা...

শাহান নানার পাঞ্জাবির কোনা টেনে ঝাঁকি মারে, ‘নানা, নানা, ভুণ্ডুল কাকে বলে- বল্লে না তো!’

‘আমি ফিরে আসি ,দেখবে ভুণ্ডুল কাকে বলে। আমার পুরানো বাড়িতে জোলাভাতি আর আমি দাওয়াত পাবো না তাই কী হয়?  একদম ভুণ্ডুল করে দেব সব।’

মাইকের ঘোষণা শুনে সুহা লাফিয়ে উঠে। ‘নানা, নানা তোমার নাম বল্লো যে, তুমি কি বিশেষ অতিথি? বাহ্ কি মজা, কি মজা! সুহা তার আম্মুকে ডাকে ‘আম্মু, আম্মু শুনেছ, নানা অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি। এবার নানু নানু হাঁক মারতেই, ‘নানু বল্লেন, তাতে আমার কি? আমাকে কোন দিন নিয়েছে না দেখিয়েছে উনি নাকি কোথায় কি করেন...।’

‘কি করি মানে! চিনলে না হে চিনলে না, মর্যাদা আর কাকে বলে। ঘরের বের হলে দু’দশজনে মান্য করে।’

‘বুঝি, বুঝি, দাড়ি পাকা হলে মানুষ এমনিতেই মান্য করে।’

‘ ঠিক বলনি, মানুষ যখন নিজেকে নিজে চিনতে পারে, তখনই অন্যেরা... যাক তোমাদের হলো?’
‘ দিচ্ছি,’ ‘নানুর গলার আওয়াজ শোনা যায় দোতলার ঘরে।’

সুহা, শাহান শোন, এই যে শুনলে খিলপাড়া ব্লাড ডোনেট ক্লাব। কি শাহান তুমি মনে হয় মাইকের ঘোষণা খেয়াল করনি- তাই না!।’

‘হ্যাঁ নানা, কি যেন কি বল্লো-’

তাহলে শোন মনোযোগ দিয়ে, ‘খিলপাড়া আমাদের গ্রামের নাম। আমাদের বাজারের নাম খিলপাড়া বাজার। সেই বাজারে, খিলপাড়া ব্লাড ডোনেট ক্লাব। ডোনেট মানে দান করা, ব্লাড ডোনেট মানে?’

সুহা চেঁচিয়ে উঠে বলে নানা আমি হাত তুলেছি, ‘রক্ত দান করা।’

‘ঠিক বলেছ সুহামনি। ওদের সদস্য সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। এ এলাকার ছেলে-মেয়ে, মানে ধর ছাত্রছাত্রী, কৃষক, রিক্সাওয়ালা মানে খেটে খাওয়া দিনমজুরও। কেউ অসুস্থ হলে রক্তের প্রয়োজন হলে ওরা বিনি টাকায় মানুষের জন্য রক্ত দান করে। কি মহৎ কাজ তাই না শাহান ভাইয়া?’

নানা ও বুঝবে না। আমি বুঝি অনেক বড় মহৎ কাজ। সুহার কথার প্রতিবাদ করে শাহান, ‘আমিও বুঝি মহৎ কাজ।’

ক্লাবের সদস্যরা রাস্তার পাশে তালগাছ, আমগাছ, কাঠগাছও লাগিয়েছে পুরো এলাকায়। ওরা মাদক মানে নেশা থেকে এলাকামুক্ত রেখেছে এবং নিজেরা শপথ করেছে কোন দিন মাদক নিবে না এমনকি সিগারেটও না।

হঠাৎ শাহান হাতের লাঠি হাঁকিয়ে দৌড়ে যায় বাগানে, সুহাও শাহানের পিছু পিছু ছুটে। দেখে শাহান একটা ব্যাঙকে লাঠিপেটা করার জন্য দৌড়াচ্ছে। নানা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দুজনের সামনে দাঁড়ান।

‘কি করছ নানাভাই ওটাকে মেরো না। ব্যাঙ আমাদের উপকারী বন্ধু। না না মেরোনা মেরোনা ভাইয়া।’

শাহান একটু রেগে আছে, বলে ওটা আমার সামনে দিয়ে লাফিয়ে গেল কেন! ওটাকে বাড়ি মেরে একদম মেরে ফেলবো, বেয়াদব-’ সুহা হি হি করে হেসে ওঠে। ‘কি বল্লে? ওটা কি শাহানকে চিনে, না নানাকে?’

‘শোন, ওটা আমাদের অনেক অনেক উপকার করে। নানা ওর মাথায় আদর করে কথাটি বলেন। সুহা হাসি থামিয়ে বলে, ওটা দেখতে খুব বিশ্রী। ব্যাঙ ঘেঙর ঘেঙ। ওটা কি করে উপকারি হয়?’

নানা বল্লেন, শোন সুহামনি তোমাদেরকে মশা দিনে-রাতে কামড়ায়?’

‘হ্যাঁ কামড়ায় তো। আজ সকালে নাশ্তার টেবিলের নীচে আমার পায়ে দুই তিনটা মশা কামড়ে দিয়েছে-’

‘আসলে মশাটাই বেয়াদব। তাইতো তোমরা দু’হাত দিয়ে থাপ্পড় লাগাও পিষে ফেল। ছোট প্রাণী হলেও খুব ভয়ানক। অনেক অনেক বিপজ্জনক অসুখ বয়ে আনে। এবার আসল কথা শোন, এই একটা ব্যাঙ প্রতিদিন তিন হাজার মশা বা মশার ডিম খায়। ক্ষতিকর নানান পোকা মাকড় খায়। আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা করে। এই যে পাখিগুলো দেখছ ওরাও পোকা মাকড় খায় বলেই আমরা ফল-ফলাদি, শস্য ঘরে তুলতে পারি।’

সুহার নানা হাঁক মেরে বলেন, ‘কই তোমাদের হলো?’

‘জ্বী বাবা আসছি-’

‘সুহার আম্মু ইয়া বড় একটা কাপড়ের ব্যাগ টেনে নিয়ে আসে বাইরে। সুহা, শাহান তো অবাক, আম্মু আবার এসব কি করছে। সুহা গাট্টিটা টেনে নাড়াতে পারে না নানার দিকে তাকায়-

‘বুঝেছি, জানতে চাইবে এখানে কী আছে কোথায় নিচ্ছি?’

এরি মধ্যে একটা অটো ঘরের সামনে চলে এসেছে নানাকে নিতে। অটোর ড্রাইভার গাট্টিটা টেনে তুলে নেয় গাড়িতে। নানা বলেন, শোন এখানে পুরাতন কাপড়, অবশ্য কিছু হাফ নতুনও আছে, বুঝেছ?

‘অর্ধেক বুঝেছি। কোথায় নিচ্ছ, কি করবে খোলাসা কর নানা? যেন সুহার হুকুম-

সুহা আবার বলে, ‘তুমি বাজারে বিক্রি করবে?’

‘নানা হেসে বলেন, হ্যাঁ বিক্রি করে তোমাদের জন্য জিলাপি আর রসমালাই নিয়ে আসবো।’

‘কি বল্লে? সত্যি? তুমি হকারি কর? নানু, নানা এসব কি বলছে?’

‘তোমার নানা খিলপাড়া হাটে এসব কাপড় বিক্রি করে তোমাদের জন্য গরম গরম বাতাসা নিয়ে আসবে, আর আমার জন্য এক বিড়াপান আর মুড়ির মোয়া, মচমচিয়ে খাব।’

‘আম্মু, এসব কি হচ্ছে? তুমি শেষমেষ নানাকে পুরাতন...’

‘সুহার আম্মু এবার ফিক্ করে হেসে উঠে। সুহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘তোমার নানা এসব কাপড় ব্লাডডোনেট ক্লাবের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিয়ে আসবে। গ্রামে অনেক  গরিব মানুষ আছে ওরা যার যার সাইজ মতো, পছন্দ মতো কাপড় বাছাই করে নিয়ে যাবে- কোনো টাকা দিতে হবে না।’

‘তাই বলো, আমি তো ভেবেছি এ গ্রামে কোনো গরিব মানুষ নেই।’

‘সুহার কথার জবাব দেয় তার নানু, ‘আছে আছে বাংলাদেশের সব গ্রামেই গরিব মানুষ আছে, কেউ হাত পাতে, কেউ অসহায়ত্ব গোপন করে। তাদের প্রতি আমাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে-’

‘তাহলে আমার কত্তো কাপড়, দু’তিনটা রেখে বাকিগুলো দিয়ে দাও আম্মু-’

আম্মু বলেন, ‘কয়েকটা দিয়েছি, শাহানের, তোমার আমার তোমার বাবার, আমার মা-বাবারও। তোমাদের নানা আরো কিছু নতুন কাপড় কিনে দিবেন, তোমার বাবাও টাকা দিয়ে গেছেন-’

‘তাই! এতো কিছু আমাকে জানাওনি কেন।

তোমার জমানো যে টাকা আমার কাছে ছিল তাও দিয়ে দিয়েছি, ভাবছি পরে তোমাকে দিয়ে দেব।’

‘না, না দিতে হবে না, ভালো করেছ মামনি।’ সুহা, ‘নানু, নানা, আম্মু দি গ্রেট’ বলতেই শাহান লাফাতে থাকে। নানার অটো শো শো করে এগিয়ে যায়।’

এএইচ


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি