ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১০ অক্টোবর ২০২৪

শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন

রুহুল আমিন বাচ্চু

প্রকাশিত : ১২:০৯, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২

সুহা সকাল থেকেই মায়ের নির্দেশে ডাইনিং টেবিলে খাতা-কলম নিয়ে ভ্রমণ কাহিনী লিখছে। আম্মু হিসেব করে বল্লেন ‘আমার বাবার বাড়ি এসেছ আজ দশ দিন।’ সুহা কলম তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কি বল্লে আম্মু, তোমার বাবার বাড়ি? তোমার বাবার বাড়ি বলছ কেন? এটা তোমার বাড়ি না?’ সুহার কথায় অভিমান ঝরে পড়ছে।

মা টেবিলে গ্লাস সাজাতে সাজাতে বলে ‘হ্যাঁ তাইতো ভুল বলেছি। আমার বাবার বাড়ি মানে তো আমার বাড়ি। তাইতো সুহা চট করে দাঁড়িয়ে বলে, না লিখবো না আগে সরি বল, আর আর কখনো এমনি এমনি বলবে না।’ সুহার আম্মু সুহার মাথায় চুমু খেতে খেতে বলেন, ‘সরি মা মনি। আর ভুল হবে না। তো দশ দিন হলো আমাদের বাড়ি বেড়াচ্ছ নানান জায়গায় গিয়েছ নানার সাথে, তোমার এসব নিয়ে লেখা কদ্দুর হলো? দেখি দেখি-’

সুহা লেখার খাতাটা সরিয়ে ফেলে বলে, ‘আগে শেষ করতে দাও। এখন দেখলে তুমি কাটা-কুটি করবে, বলবে এটা বাদ পড়েছে, ওটা এভাবে লিখছ কেন!’ বাহিরে নানার গলার আওয়াজ শোনা যায়, ‘কালু তুই পুরান বাড়ি ঘুরে আয়, যারা যারা যাবে একটা লিস্ট বানিয়ে আনবি।’

নানার গলার আওয়াজ শুনে সুহা আর শাহান বেরিয়ে আসে। নানা হাত কোদাল রেখে গামছা দিয়ে মুখ মুছে একগাদা কুমড়ো ফুল সিঁড়িতে রেখে হাঁক মারেন, কই কোথায় গেলে?

নানু রান্না ঘর থেকে জবাব দেন, ‘আসছি।’ নানা এবার সুহা-শাহানের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কি হে নাতিন-নাতি তোমাদের আজকের প্রোগ্রাম কি? সুহা দু’কদম এগিয়ে যায় নানার দিকে, বলে এসব কিসের ফুল এনেছ তুমি?

‘শাহানকে জিজ্ঞেস কর ও বলতে পারবে।’ শাহান একটু ভেবে চিন্তে বলে, ‘এগুলো শাপলা ফুল, ওদের নানি এরি মধ্যে ফুলগুলো তুলে নিয়ে বলেন, ‘হলো না শাহান এগুলো কুমড়ো ফুল। মাছের ডিম দিয়ে এগুলো রান্না করবো। দারুণ মজা হবে।’

নানা এবার সুহার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বল বল জলদি বল এখন কটা বাজে আর আজ কয় তারিখ?
সুহা চট চট জবাব দেয় ‘দশটা বাজে দশ তারিখ।’

‘ঠিক আছে, রোদ উঠেছে ফুল ফুটেছে তোমরা গোসল সেরে তৈরি হয়ে নাও আজ বিশেষ এক জায়গায় তোমাদের নিয়ে যাব।

শাহনতো লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে, বিশেষ জায়গায়? ‘কোথায় নানা বলোনা সুহা অভিমান করে বলে, নানাতো বলে না, কোন দিন বলে না, বলে গেলেই দেখবে। আজ আগে আগে না বল্লে, কোথাও যাব না বলে দিলাম।’

‘বুঝেছি, আগে পুকুর ঘাটে এসো ঐ দেখ বাড়ির ছোটরা পুকুরপাড়ে জড়ো হয়েছে।’ সুহা শাহানতো মোটামুটি এ কয়দিনে সাঁতার শিখে ফেলেছে?’

‘আজ কিন্তু মাঝ পুকুরে গিয়ে সাঁতরে আসবে। শীত শীত বল্লে চলবে না।’

‘মাঝ পুকুর? হ্যাঁ পারবো তবে শাহান পারবে না ওতো কলাগাছ ধরে তিন চার হাত দূরে যেতে পারে।’

পুকুর পাড়ে বাড়ির ছোটদের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। নানা সুহা, শাহানকে নিয়ে হাজির। ওদের শোরগোল কিচির মিচির ফিস্ ফাসে পরিণত হয়। ওদের কারো হাতে লুঙ্গি, কারো মাথায় গামছা-পায়জামা, ওড়না প্যাঁচানো সবাই উদ্গ্রীব হয়ে আছে। নানা ওদের কাছাকাছি আসতেই ওরা হুররে বলে চিৎকার জুড়ে দেয়। নানা ওদের থামিয়ে বলেন, ‘আজ ডিসেম্বরের দশ তারিখ। তোমরা অনেকেই বইতে পড়েছ বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন-এর জীবন কাহিনী। তিনি তো আমাদের জেলার লোক, মানে সোনাইমুড়ি উপজেলার অর্থাৎ আমাদের পাশাপাশি উপজেলার। আমাদের গৌরব সে বীর সন্তান। ১৯৭১ সালে ১০ ডিসেম্বর তিনি যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমরা আজ তার জন্মস্থান বাঘাপাড়া দেউটি গ্রামে যাব তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।’

সুহা একটু ভেবে চিন্তে বলে, নানা বইতে পড়েছি তাঁকে খুলনায় রূপসা নদীর পাড়ে দাফন করা হয়েছে। সেখানেই তাঁর কবর।’

নানা হেসে বলেন, ‘আমার নাত্নি সুহা ঠিকই বলেছে। তবে আমরা যাব তাঁর গ্রাম দেখতে, সেখানে রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার রয়েছে, তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের দেখবো, কথা বলবো, পাঠাগারের পাশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর দেখবো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে তোমরা, গ্রন্থাগারে অনেক বই দেখতে পারবে।’

বাড়ির ছোটরা হৈ চৈ করে ওঠে। নানা বলেন, ‘তোমরা সবাই যাবে। তোমাদের জানতে হবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না জানলে তোমাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকবে, স্বাধীন দেশে জন্ম নিয়েছ অথচ স্বাধীনতার ইতিহাস জানবেনা তা কি করে হয়’?

নানা একটু থেমে আবার বলেন, তোমরা দুপুরের খাবার খেয়ে জোহর নামাজবাদ অর্থাৎ বেলা দুইটার মধ্যে ‘এখানে হাজির থাকবে। একটা মাইক্রো ভাড়া নিয়েছি তোমাদের জন্য।’

বাচ্চারা আবার হৈ হৈ জুড়ে দেয়, তালি দিতে দিতে বলে, ‘মজা হবে, খুব মজা।’

নানা আবার বলেন, সুন্দর পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে আসবে। আর একটা কথা তোমাদের মা-বাবাকে অবশ্যই বলে আসবে।

ওরা, ‘ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার’ বলে, নানার ইশারা পেয়ে পুকুরে ঝঁপিয়ে পড়ে।

গোসল সেরে সুহার নানা কাঁধের গামছা রোদে শুকাতে দেন। সুহা শাহান আগেই ফিরে এসে শীত রোদ পোহাচ্ছে উঠানে। সুহার আম্মু ওদের ভেজা কাপড় রশিতে ঝুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘বাবা এতোগুলো ছেলে-মেয়ে আপনি একা সামলাবেন কি করে?’

‘তাইতো এতোটা ভাবিনি, হ্যাঁ বুঝেছি- তোমাকে যেতে হবে আমাদের সাথে।’

সুহার কানে কথাটা যেতেই সে লাফিয়ে ওঠে, আম্মু তুমিও যাবে, খুব মজা হবে নানুকেও নিয়ে নাও না-’

‘তোমার নানু? এ ঘর ছেড়ে কোথাও যেতে যে মানা! তাঁর হাস-মুরগি কে দেখবে? কে খাওয়াবে ওদের? যদি ঘর থেকে এটা ওটা খোঁয়া যায়? কেউ যদি ঘরটাই তুলে নিয়ে যায়! কত যে ভাবনা তাঁর।’

নানার কথা শুনে নানি শাক কুটতে কুটতে বলেন, সুহা তোমার নানাতো পাড়া মাতিয়ে বেড়ান। ঘর পাহারা দেয় কে? হাঁড়ি-পাতিল মাজা-ঘষা, রান্না-বান্না সবইতো আমাকে করতে হয়। তিনি আবার অন্য কারো হাতের রান্না খান না। সপ্তাহে চার দিন যে ঘুরে ঘুরে দাওয়াত খান, বলি কার হাতের রান্না!’

নানা, নানুর কথা না শোনার ভান করে আস্তে দোতলায় উঠে যান। সুহার আম্মুকে ইশারায় তৈরি হতে বলেন।

ঠিক একটা পঞ্চাশে মাসুদের কালো রঙের মাইক্রোটা কাচারির সামনে এসে থামে। বাড়ির ছেলে-মেয়েদের কেউ কেউ আড়াল থেকে লক্ষ্য করে। গাড়ির হর্ন শুনে বাকিরাও ছুটে এসে জড়ো হয় মাইক্রোকে ঘিরে।

মাইক্রোটি ওদের নিয়ে খিলপাড়া বাজার হয়ে নয়নপুর পেরিয়ে কড়িহাটি বাজারের উপর দিয়ে দেউটি পৌঁছে যায়। এরপর পাকা রাস্তা ছেড়ে পাঁচশ মিটার দক্ষিণে ইটাবিছানো রাস্তা দিয়ে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘরের সামনে থামে।

প্রথমেই চোখে পড়ে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন-এর সিরামিক দিয়ে তৈরি দৃষ্টিনন্দন ম্যুরাল। সুন্দর গেট পার হয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওরা ঢুকে যায় লাইব্রেরিতে। শত শত বইয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, মাঝখানে বেঞ্চ আর পড়ার টেবিল, পশ্চিম পাশে বিশাল এলাকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শত শত ছবি। বঙ্গবন্ধুর বিভিন্নস্থানে ভাষণের ছবি, জনতার উল্লাস, রণাঙ্গনের সাদা-কালো রঙিন ছবি, নীচে ছবির ক্যাপশন। সুহার আম্মু ওদেরকে ছবির কথা বলে, যুদ্ধের কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একখণ্ড নিয়ে ওদের পড়ে শোনায়।

রণাঙ্গনে ওদের বীরত্বের কথা শোনায়, আহত নিহতদের আত্মদানের কথা শোনায়। ওদের মুখে কোনো কথা নেই, পিনপতন নীরবতা। কেউ মন খারাপ করে আছে, কারো চোখে পানি। হু হু করে কেঁদে ওঠে আমেনা, ও জানে যুদ্ধে ওর দাদা শহীদ হয়েছেন একাত্তর সালে।

শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন-এর ম্যুরালের পাশে দাঁড়িয়ে সুহার আম্মু ওদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদস্য হিসেবে এ বীরশ্রেষ্ঠ পোশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি চট্টগ্রাম পাকিস্তানি নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে পালিয়ে যান, শুরুতেই নিজ বাড়ির আশপাশের ছাত্র, যুবক ও আধা-সামরিক বাহিনীর লোকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দেন। কিছুদিন পর তিনি ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা সেক্টরে মেজর শফীউল্লাহর অধীনে ২নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার-১ হিসেবে যশোহর পাকিস্তান সেনানিবাস দখলের পর মোংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌঘাঁটি পিএনএস তিতুমির দখল করতে গিয়ে পাক বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে আহত হন। আহত অবস্থায় নদী তীরে পৌঁছা মাত্র অপেক্ষমাণ রাজাকারেরা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

সুহার আম্মুর চোখে পানি দেখে ছেলে-মেয়েরা হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। সিঁড়িতে দাঁড়ানো নানার  চোখের পানিও নীরবে গড়িয়ে পড়ে। সুহার আম্মু কাঁদতে কাঁদতে পড়েন তাঁর বীরত্বপূর্ণ অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ মরণোত্তর সম্মানে ভূষিত করে। আজ আমরা এ বীর সন্তানের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ্ যেন তাঁকে বেহেশতবাসী করেন।

এএইচ


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি