হুমায়ূন বিশেষজ্ঞ
প্রকাশিত : ১৮:২৭, ১৬ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২১:৫২, ২৪ নভেম্বর ২০১৭
আমাদের মশিউর ভাইকে শুধু ‘হুমায়ূনভক্ত’ বলেই বাক্য শেষ করা যাবে না। শেষ করলে সেটা হবে অন্যায়, অবিচার। সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে কী করতে হবে? ‘হুমায়ূনভক্ত’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ‘হুমায়ূনবিশেষজ্ঞ’ও বলতে হবে। এটা তার জোরালো দাবি। আর আমরা তার এই মামাবাড়ির আবদার টাইপের দাবি পূরণ করে আসছি ম্যালাদিন ধরে। তবে এই দাবি পূরণ করতে গিয়ে যা বুঝলাম তার সারমর্ম হচ্ছে, তিনি হুমায়ূনভক্তও নন, হুমায়ূনগবেষকও নন, হুমায়ূনবিশেষজ্ঞও নন। তিনি আসলে হুমায়ূনসমালোচক।
মশিউর ভাইয়ের সমালোচনার লক্ষবস্তু হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের কিছু বই। বইগুলো তিনি নিজের টাকা দিয়ে কিনেছেন, এমনটা ভুল করেও ভাবা যাবে না। হয় এগুলো বন্ধুদের কাছ থেকে এনে মেরে দিয়েছেন, না হয় এর-ওর কাছ থেকে গিফট পেয়েছেন। আর এই বইগুলোকেই যখন-তখন সহ্য করতে হচ্ছে তার সমালোচনার যন্ত্রণা। আমাদের একজন তো একদিন তাকে বলেই বসল হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে এই আজগুবি সমালোচনার দায়ে আপনাকে তিনি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়তেন।
মশিউর ভাইয়ের সমালোচনার একটা বিশেষ স্টাইল আছে। স্টাইলটা মোটেই সুবিধার কোনো স্টাইল নয়। তবু এই স্টাইলটাকে তিনি চাপার জোরে ‘স্বকীয়তা’ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। তো স্টাইলটা হচ্ছে, তিনি বইয়ের লেখা নিয়ে সমালোচনা করেন না। সমালোচনা করেন বইয়ের নাম নিয়ে। আসলে লেখা নিয়ে সমালোচনা করতে হলে তো পুরো বইটা পড়ে তবেই সমালোচনা করতে হবে। তার হাতে অত সময় কই? তাই নামের উপর দিয়েই কাজ চালিয়ে দেন। সাপও মরল, আবার লাঠিও আস্ত থাকল।
সেদিন ‘সবাই গেছে বনে’ বইয়ের নামটি নিয়ে একদম সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিলেন মশিউর ভাই। বললেন, তোমরাই বলো, সবাই যাওয়ার মতো বন কি এখন দেশে আছে? মানু সব বন ধংস করে ফেলেছে না? তবু বাদ দিলাম সেসব কথা। ধরলাম বনে গেলোই। কিন্তু সবাই বনে চলে গেলে বাড়িটা একেবারে খালি হয়ে গেল না? বাড়ি খালি রেখে সবার বনে যাওয়াটা কি ঠিক হলো? বাড়ির দারোয়ানটা অন্তত গেটে রেখে যেতে পারত! আমরা বললাম, দারোয়ান রেখে যায়নি, এমনটা কি কোথাও বলা আছে?
মশিউর ভাই বললেন, আলাদা করে বলা থাকতে হবে কেন? ‘সবাই গেছে বনে’ নামটা শুনে কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে দারোয়ানকেও প্যান্ট-শার্ট পরিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। এটা ঠিক নয়। কখন বাড়িতে চোর ডাকাত ঢোকে! উফ! নিজের বাড়ির প্রতি কেন যে মানুষের এই দায়িত্ববোধটুকু নেই! সবাই বনে যাওয়ার আগে দরজায় যে তালাটি মেরেছে, সেটি নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। মেড ইন চায়না তালা মেরে থাকলে কিন্তু সেটা খোলা চোরের জন্য ওয়ান টুর ব্যাপার।
‘হিমু এখন রিমান্ডে’ নামটি নিয়ে বলতে গেলে নাক সিটকিয়েছেন মশিউর ভাই। তার বক্তব্য- এটা একটা কথা হলো? তিনি এতো বড় লেখক, তার উপন্যাসের নায়ককে রিমান্ডে নেওয়া হলো অথচ তিনি কোনো পদক্ষেপই নিলেন না। আরে বাবা, তার কি উচিত ছিল না হিমুকে রিমান্ডে নেওয়ার আগেই তাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করা? তিনি তো থানায় একটা ফোন করলেই হিমুকে ছেড়ে দিত। ফোনের কলরেটও তো বেশি না। নাহ্, হিমুর প্রতি এই অবহেলা মেনে নেওয়া যায় না। অন্তত আমার মতো সচেতনরা তো মেনে নিতে পারেই না।
‘মেঘ বলেছে যাবো যাবো’ বইয়ের নাম নিয়েও তার সমালোচনার শেষ নেই। তার কড়া জিজ্ঞাসা-
মেঘ কোথায় যাবে? মেঘের কি শ্বশুরবাড়ি আছে যে বেড়াতে যাবে? নাকি খালুর বাড়িতে বেড়াতে যাবে? আর মেঘ নাকি বলেছে যাবো যাবো। মেঘের ভাবটা এমন যেন সে যেতে চাচ্ছে কিন্তু ব্যস্ততার জন্য যেতে পারছে না। মেঘের আবার ব্যস্ততা কিসের শুনি! মেঘ কি নয়টা-পাঁচটা অফিস করে? নাকি নিজের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালায়? তাহলে কিসের ব্যস্ততা মেঘের? বিষয়টা খতিয়ে দেখা উচিত না?
প্রায় প্রতিটা নাম নিয়ে সমালোচনা করেই মশিউর ভাই আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন। আমাদের কাছে এই প্রশ্নগুলো বিসিএসের ভাইভা বোর্ডের প্রশ্নের চেয়েও কঠিন মনে হয়। আর তিনি সেটা অনুমান করতে পারেন আমাদের হাবভাব দেখেই। এটাও অনুমান করতে পারেন, আমরা তাকে জবরদস্ত জ্ঞানী মনে করছি। মনে করছি, তার মতো জ্ঞানী সচরাচর জন্মায় না। আমাদের এই মনে করাটাকে পাকাপোক্ত করতে তিনি আবার ফিরে যান সমালোচনায়। টেনে আনেন ‘হিমুর মধ্য দুপুর’ নামটিকে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে মোড়লের ভঙ্গিতে বসতে বসতে মশিউর ভাই বলেন, আমি বুঝতে পারছি না হিমুর প্রতি কেন এমন অবিচার করা হলো। মধ্য দুপুর মানে বোঝো? ঠাঠা রোদ। ছাতা মাথায় দিয়ে বাইরে বের হলেও চান্দি গরম হয়ে যায়। অথচ লেখক এই মধ্য দুপুরেও হিমুকে বাইরে বের করে দিয়েছেন ছাতা-টাতা ছাড়াই। তোমরা বইটার প্রচ্ছদের দিকে তাকাও। তাকালেই দেখবে হিমুর মাথায় কোনো ছাতা নেই। কেন, একটা ছাতা কিনতে আর কয় টাকাই বা লাগে! এখন আশি-পঁচাশি টাকায়ই কত ভালো ছাতা পাওয়া যায়! নতুন ছাতা তিনি না হয় না-ই কিনলেন। তার বাসায় তো নিশ্চয়ই পুরনো ছাতা ছিল। ফেরত দেওয়ার শর্তে হিমুকে একটা ছাতা দিলে কী হতো?
আবারও সেই বিসিএসের ভাইভা বোর্ডের প্রশ্ন। আমরা মাথা নত করে ফেলি। কিন্তু এইটুকু নততে খুশি হন না মশিউর ভাই। তিনি চান আমাদের মাথা নত হতে হতে একেবারে মাটিতে গিয়ে বাড়ি খাক। আর সেই ইচ্ছেতেই তিনি পরবর্তী প্রশ্নের ক্ষেত্র তৈরির জন্য চলে যান পরবর্তী সমালোচনায়। তার এবারের টার্গেট ‘দারুচিনি দ্বীপ’। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তিনি মুখটা পানসে বানিয়ে বললেন, মাংস আমিষ জাতীয় খাদ্য। কিন্তু সেই মাংস আমরা মাসে কয়দিন খাই?
আমরা বললাম, আপনিই বলেন। মশিউর ভাই বললেন, মাসে আমরা মাংস খাই একদিন বা দুইদিন। তাহলে আমরা দারুচিনি দ্বীপ দিয়ে করবোটা কী! দারুচিনি হচ্ছে গরমমসলা। এটা নিয়ে মাংস রান্না করে। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নিয়ে না লিখে তিনি কাঁচা মরিচ দ্বীপ কিংবা গোলআলু দ্বীপ নিয়ে লিখতে পারতেন। কারণ, এই জিনিসগুলো আমাদের প্রতিদিন কাজে লাগে। সব খাবারে দিতে হয়। কাঁচা মরিচ দিয়ে আলুভর্তা বানিয়ে তো আমি রোজ খাই। কাঁচা মরিচে কিন্তু ভিটামিনও বেশি। ঠিক কিনা?
ভাইভা বোর্ডের এই প্রশ্নটা মনে হয় একটু সহজই হলো। আর এই সুযোগে আমাদের মুখপোড়া তৈমুর বলে উঠল, ভাই, আপনি যে বললেন কাঁচামরিচ আর গোলআলু নাকি সব খাবারে দিতে হয়, কথাটা কিন্তু ঠিক না। মনে করুন আপনার বাসায় লাচ্ছা সেমাই কিংবা পায়েস রান্না করল। সেখানে কি আপনি কাঁচা মরিচ আর গোলআলু দেবেন? দেওয়াটা কি উচিত হবে? তবু যদি দিয়েই ফেলেন, আপনার পরিবারের সদস্যরা কি ঘুষি মারার জন্য আপনার দিকে তেড়ে আসবে না?
প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন আসবে, এটা বোধ হয় ভাবতে পারেননি মশিউর ভাই। তাই তিনি একটা পরিপূর্ণ ঢোক গিলে বললেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ কথার মধ্যে আরেকটা অপ্রাসঙ্গিক কথা ঢুকিয়ে দেওয়া খুবই অন্যায়। তোমরা ছোট মানুষ, জ্ঞান বুদ্ধি কম। কী আর বলবো। তবে ‘কী আর বলবো’ বললেও বলার বিষয় খুঁজে পেতে দেরি হলো না তার। তিনি কথা বলতে শুরু করলেন হুমায়ূন আহমেদের সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘কোথাও কেউ নেই’ নিয়ে। যা নাটক হিসেবেও প্রচারিত হয়েছে টিভিতে।
মশিউর ভাই ‘কোথাও কেউ নেই’ এর সমালোচনা করতে গিয়ে বললেন, সেই প্রাগৈতিহাসিক আমলের পরিবেশ নিয়ে কথা বললে তো চলবে না। সেই আমলে না হয় জনসংখ্যা কম ছিল, তাই কোথাও কেউ ছিল না। কিন্তু এখন সেই পরিবেশ নেই। এখন সব জায়গায় মানুষ গিজগিজ করে। ধরে নিলাম উপন্যাসটা অনেক আগের লেখা। আগে লেখা তো কী হয়েছে? রি-প্রিন্ট করার সময় নামটা পাল্টে দিলেই হতো। ‘কোথাও কেউ নেই’ এর পরিবর্তে লেখা যেত ‘সব জায়গায়ই কেউ না কেউ আছে’। এছাড়া...
মশিউর ভাইয়ের কথার গতিটা থামিয়ে দিয়ে সজীব বলল, কিন্তু ভাই, এই উপন্যাসে তো জনসংখ্যা নিয়ে কথা বলা হয়নি। তাহলে এই ধরনের নাম কেন দেওয়া হবে? এছাড়া আপনি এর আগে আরো যেসব সমালোচনা করলেন, সেগুলোও তো কেবল নাম নিয়ে। বইয়ের ভেতরে কী আছে সেটা না জেনে শুধু নাম নিয়ে মন্তব্য করাটা কি ঠিক? এবার খুব ভালোভাবেই ক্ষেপে গেলেন মশিউর ভাই- এই মিয়া, আমি কি তোমাদের মতো ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে চলি? আমাকে পুরো জিনিস পড়তে হবে কেন? আমার মতো জ্ঞানীর জন্য ইশারাই কাফি।
মশিউর ভাইয়ের এই হুম্বিতুম্বি দেখে আমি বললাম, ঠিকই বলেছেন ভাই, আপনার মতো জিনিয়াস লোককে পুরো বই পড়ে সমালোচনা করতে হবে কেন! তবে একটা অনুরোধ ভাই, আপনার এই জ্ঞানগর্ভ সমালোচনা যাতে পুরো জাতি পড়তে পারে, তাই চাচ্ছিলাম সমালোচনাগুলো কোনো পত্রিকায় ছেপে দিতে। দেবো নাকি? মশিউর ভাই এবার গলার স্বর নামিয়ে বললেন, পত্রিকায় আমার সমালোচনা ছাপা হলে কি সেটা হুমায়ূন আহমেদের ভক্তদের চোখে পড়বে? আমি বললাম, কেন বলেন তো?
মশিউর ভাই বললেন, না মানে তাদের চোখে পড়লে উল্টাপাল্টা সমালোচনা করার অপরাধে তারা আমার খবর করে দিতে পারে তো! আমি বললাম, তাহলে ধরে নেন তাদের চোখে পড়বে না। মনে করেন তারা বাসয় পত্রিকাই রাখে না। মশিউর ভাই বললেন, তাহলে ছাপতে পারো। তবে সমালোচনার জন্য তো বিল নিশ্চয়ই হয়? বলে দিও বিলটা যাতে ক্যাশে দেয়। ঠিক আছে?
লেখক : ইকবাল খন্দকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। এ পর্যন্ত তার ৫৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি তিনি নিয়মিত পত্রিকায় লিখছেন। আগামী বইমেলায়ও তার কয়েকটি বই প্রকাশিত হবে।
/ডিডি/