ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৩ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

কুয়াশাকাল

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৫২, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১১:৩৩, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

(১)

২০১৭’র ডিসেম্বর মাস। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক গান, শ্লোগান ও উৎসবকে ছাপিয়ে একটা টানা শৈত্যপ্রবাহ গিলতে থাকে বাংলাদেশকে। রাত নামার পর রাস্তায় হাঁটলে আজকাল একটা লাইন মাথায় ঘোরে- ‘শহরে নামছে প্লাটুন প্লাটুন শীত’। কার লেখা কবিতার লাইন তা ভাবতে ভাবতেই ভাবনার ল্যাজ ধরে আসে প্রশ্ন- এই যে প্লাটুন প্লাটুন শীত নামছে, এরা কই থেকে আসে, ক্যান্টনমেন্ট? সেই ক্যান্টনমেন্ট আবার কই? কিছু ক্যান্টনমেন্ট আছে শহর থেকে খানিক বাইরে, গ্রামমত এলাকায়। কিছু আবার শহরের হৃৎপিণ্ডের ঠিক মধ্যিখানে। সেইখানে ঘাপটি মেরে থাকে প্লাটুন প্লাটুন শীত? যখন উপর মহলের নির্দেশ পায়, কেবল তখনই তারা ছেয়ে ফেলে পুরো শহর? ওই সময়টা সান্ধ্য আইনের মতো। তখন রাত নামলে শহরবাসী পারতপক্ষে বাইরে বের হতে চায় না। কিন্তু গ্রামে? সেখানে তো প্রতিদিনই প্লাটুন প্লাটুন শীত, প্রতিদিনই সান্ধ্য আইন, প্রতিদিনই কার্ফু। কবির নাম খুঁজতে গিয়ে শহর এবং গ্রাম, ক্যান্টনমেন্ট এবং কার্ফু বিষয়ক অগণতান্ত্রিক এক জটিলতার ভিতর নিমজ্জিত হই আমি।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে এই কার্ফু, মানে সান্ধ্য আইন, মানে শৈত্যপ্রবাহ চলবে আরও চারদিন। আমি তাদের কথার অর্ধেক বিশ্বাস করে বাকি অর্ধেক মগজ থেকে ফেলে দেই। ধরে নেই, শৈত্যপ্রবাহ চলবে দুইদিন ধরে। তারপর কী হবে এজন্য আবারও তাদের শরণাপন্ন হব, এবং আবারও তাদের কথার অর্ধেক রেখে বাকি অর্ধেক ফেলে দিব। কেননা, আমি দেখেছি, আমাদের এখানে যেকোনো প্রকার বিবৃতির (রাষ্ট্রিক/প্রাতিষ্ঠানিক/সাংগঠনিক)উপরে অর্ধেক বিশ্বাস এবং অর্ধেক অবিশ্বাসের জ্যামিতি স্থাপন করলে জীবনের চলরেখা সরল হয়। তাদের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস কখনও কখনও আমাকে এমন কিম্ভুত সত্যের মুখোমুখি করেছে যে তাতে আমাকে থেমে যেতে হয়েছে, কিছুদিনের জন্য হলেও। আবার তাদের কথা শতভাগ অবিশ্বাস করলেও জীবন হয়ে ওঠে নিরালম্ব। তাই আমার মধ্যবিত্ত চেতনা, খুঁজে খুঁজে বের করেছে অর্ধেক সত্য বিশ্বাস করার এই সহজ আর মাঝারি পথ।

পেটে দুটা-চারটা খাবার দেই। চিড়া আর নাড়ু আর পানি। নাড়ু এসেছে বাড়ি থেকে, মায়ের কাছ থেকে, দুই-চারদিন আগে। শরীর শান্ত হলে মনকে সঙ্গে নিয়ে বসি পড়ার টেবিলে। সবুজ কাগজে মোড়ানো টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকি বেশ খানিকক্ষণ। হাত বাড়িয়ে বুকশেলফের বইগুলো স্পর্শ করি। কাকে নেব, এই চিন্তা করে হাত বাড়িয়ে দিলেও বইগুলোর স্পর্শ আমাকে তাদের সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ভাবি, বাল্মীকি ফ্রয়েড রাসেল ইলিয়াস আর শহিদুল জহির, কেমন আছে তারা এই হিমযুগের মত সুদীর্ঘ শৈত্যপ্রবাহকালে? তাদেরকে খুব বন্দী আর অক্ষম লাগে। তাদের চিন্তা, শিল্প আর জীবনকে আমার চার তাকের বাঁশের শেলফের নির্ঘুম চৌকিদার মনে হয়। চার তাক আর চার পায়া আমার বাঁশের শেলফ। আর সরাসরি সামনের দেয়ালেই একটা চারফুট বাই দুই ফুট বাংলাদেশের মানচিত্র। ভাবি, দেশের কি পায়া আছে? যদি থাকে, কয়টা? দুই, নাকি চার?  এইসব পিঁপড়ার সারির মত সার বেধে চলা অসংখ্য মনে-হওয়া আমাকে টেবিলে বসিয়ে রাখে অনেক মিনিট। হয়ত অনেক ঘণ্টা। দাঁতভাঙ্গা করাতের মতো এসব মিনিট আর ঘণ্টা আমার চারপাশের দেয়াল কাটতে থাকে। কাটতে থাকে গায়ে শিরশির ধরানো অসহ্য এক শব্দ করে।

বাঁশের বুকশেলফ, সবুজ টেবিল, চারদেয়াল আর দেয়ালের ওপাশের শীতের মার্চপাস্ট সেই এবড়োথেবড়ো করাতে কাটা শেষ হলে দেখি, একটা পত্রিকা মেঝেতে পড়ে আছে। সেখানে অর্ধেক পাতাজুড়ে হাসছে এক উজ্জ্বল রমণী। সেই রমণীর একহাত কোমড়ে, আরেক হাতে মদির ইশারা। কেমন আবেদনময় সেই ইশারা! রমণীর নিচে লেখা ‘শীঘ্রই আসছে’। কী আসছে, কেন আসছে তা আর কিছুই লেখা নেই। তার ইশারাময় হাতের ঠিক উপরে একটা কলামজুড়ে একটা খবরের শিরোনাম চোখে পড়ে, ‘পালাতে পারলেন না সুবোধ’। মেঝেতে পড়ে থাকা এই পত্রিকা তুলে নিয়ে আমাকে পাঠ করতে হয় না খবরটা। যেন খুব অনায়াসলব্ধ এই খবর, যেন খবরের প্রতিটা শব্দ পাঠ ছাড়াই অনুভূত হয়। এ অনুভব এমন, যেন কোনো পাঠকারী আমাকে সব পড়ে শোনায়। আর চলচ্চিত্রের মতই সব কিছু দৃশ্যমান হয়। যেন আমি ঘটনার এক দর্শক।

আমি দেখি, সুবোধ নামের এক ব্যক্তি গভীর মনোযোগের সঙ্গে চারপাশটা দেখতে দেখতে হাঁটে। সে হাঁটে জনাকীর্ণ ফুটপাত ধরে। খানিক বাদে সন্ধ্যা নামে। রাত হয়। চারপাশে তীব্র আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু সেই আলোকে গিলতে গিলতে মৃদু করে ফেলে কুয়াশা। সুবোধ মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায়। আমি দেখি, সে দেখে, কুয়াশার সঙ্গে মিশে আছে হালকা লালচে রঙ এক আকাশ। আনন্দ, বেদনা এবং তারকাহীন এক আকাশ। হঠাৎ খেয়াল হয়, সুবোধ হাঁটছে কোনো একটা রেলিং এর ওপর দিয়ে। কিসের রেলিং? ব্রিজ? সামনে তাকিয়ে এর আবার শাখা-প্রশাখা দেখা যায়। ব্রিজের কি শাখা-প্রশাখা থাকে? ফ্লাইওভার হতে পারে। কুড়িল-মহাখালী-মেয়র হানিফ-খিলগাঁও কোনো একটা। সে রেলিং বরাবর হাঁটতে হাঁটতে ফ্লাইওভারের সঙ্গেই ওপরে উঠতে থাকে। তারপাশে সাদা কারের সারি অসুস্থ বিড়ালের মত একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে গড়গড় করতে থাকে। এইসব অসুস্থ গড়গড়, মানে একসার সাদা বিড়াল, মানে আটকে থাকাসাদা প্রাইভেটকারের সারি দেখে মনে হয়, হয়ত এটা মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। সে ডানে তাকায়। দেখে, সাদা বিড়ালগুলো অসুস্থ হতে হতে মরে যাচ্ছে। বামে তাকায়। দেখে, অসংখ্য বহুতল ভবনের মগজহীন করোটিকেঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠছে হিম যুগের অনন্ত কুয়াশা জাল। নিচে তাকায়। দেখে, একটা রাস্তা। যে রাস্তায় অনেক মানুষ হাঁটছে। সে ভাবে, জীবন মানে পায়ে ভর দিয়ে পথ হাঁটা। যে জীবন থেমে থাকতে থাকতে ঘায়ে পচন ধরে মরে যাচ্ছে, সুবোধভাবে, তার থেকে তার মুক্তি চাই। সুবোধ ফ্লাইওভার থেকে নিচের রাস্তায়, যে রাস্তায় অসংখ্য মানুষ পিঁপড়ার মতো হাঁটছে, লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু লাফ দেবার পর দেখা যায়, রাস্তার মানুষজন তাকে ঘিরে জট পাকাচ্ছে। কেউ কেউ তারস্বরে বলছে, একে হাসপাতালে নেন। কেউ বলে, হালায় সুইসাইড করবার লাগছিল! এই কথা শুনে সুবোধ আঁতকে ওঠে। তার দুই পা ভেঙ্গে গেছে। বাম পাশের হাঁটুর নিচের হাড় বাইরে বের হয়ে এসেছে এবং গলগল করে রক্ত ঝরছে। কিন্তু সুবোধকে ব্যথা দেয় মানুষের দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা। এটা সেই ব্যথা যা তাকে ক্রমশ ব্যথাহীন করতে থাকে। সুবোধ ক্রমশ ব্যথাহীন হতে থাকে।

(২)

ছিমছাম একটা কক্ষ। দুইটা ডেস্ক। ডেস্কে দুইটা কম্পিউটার। তিনজন মানুষ। দুইজন কম্পিউটারের সামনে বসা, একজন একটা ডেস্কের সামনে, অতিথি চেয়ারে।

ব্যক্তি ১- ভাই সাহেব, একটা নিউজ করতেছি। ইন্টারেস্টিং, সিগনিফিকেন্ট অ্যান্ড সিম্বোলিক। একইসঙ্গেই তিনটাই!

ব্যক্তি২- ইন্টারেস্টিং নইলে সিগনিফিকেন্ট ছাড়া তো আমরা নিউজই করি না। টুয়েন্টিফোর মার্কা নিউজপোর্টাল তো আমরা না যে যা পাব তাই রসিয়ে কসিয়ে পাবলি করে গেলাব!

- নারে ভাই, শুনলেই বুঝবেন, আমি যেটা করতেছি এটা আলাদা, খুবই আলাদা। আর হট টপিক, পাবলিক খাবে। অথচ ঘটনা অতি সিম্পল।

- আচ্ছা কইয়া ফালান।

-সুবোধের কথা মনে আছে আপনার?

-কোন সুবোধ?

-শহরের দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকল কারা জানি, খাঁচাবন্দি  সূর্য হাতে, লিখে রাখল, সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।

-হ্যাঁ হ্যাঁ! কিছুদিন আগে তো গোয়েন্দারাও নড়েচড়ে বসছিল এর আর্টিস্টকে ধরার জন্য!

-ঘটনা হল, গতকাল রাতে মগবাজার ফ্লাইওভার থেকে এক লোক লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। মরতে তো পারেই নাই, বরং পা দুটো ভেঙ্গে এখন হাসপাতালে ভর্তি। এই লোকের নাম সুবোধ।

-ওয়াও!

 

এই দুই ব্যক্তি আরও কিছুক্ষণ হাসপাতালে ভর্তি সুবোধ আর গ্রাফিতির সুবোধ সম্পর্কে আলাপ চালায়। আমি তাদের আলাপ থেকে ধারণা করে নিই তারা হয়তো কোনো বড় পত্রিকা অফিসের সাংবাদিকের কাজ করে। এই দুইজন শেষ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা করে বিশেষ ওই খবরটার শিরোনাম সম্পর্কে মত পোষণ করে যে, শিরোনাম হবে ‘পালাতে পারলেন না সুবোধ’। তারা সেই খবরে গ্রাফিতির আর ফ্লাইওভারের দুই সুবোধকে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেইসঙ্গে তারা মৌচাক ফ্লাইওভারের তীব্র যানজটের মধ্য থেকে লাফিয়ে পড়ার ঘটনার প্রতীকী তাৎপর্যের দিকে প্রচ্ছন্ন ইশারা রাখার কথাও বলে। এমন সময় তৃতীয় ব্যক্তি কথা বলে ওঠে। এতক্ষণ আমি এই তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। প্রথম দুই ব্যক্তি তারুণ্যের শেষ দিককার মাঝবয়সী হলেও তৃতীয় ব্যক্তিটিকে কিছুতেই এদের কাতারে ফেলা যায় না। তার ফরফরে সাদা চুল এবং ঝুলে যাওয়া গালের মাংস- এই দুই প্রধান মুখমণ্ডলীয় বৈশিষ্ট্যকেও ছাড়িয়ে গেছে এক ধরণের নির্লিপ্তভাব। ওদের কথার মাঝেই সে খুবই অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে ওঠে, তার বাড়ি পুরান ঢাকায়। পুরান ঢাকার দক্ষিণ মৈশুন্দির ভূতের গলি। এই কথা শুনে, বাকি দুজন সাংবাদিক কিছুটা বিরক্তই প্রকাশ করে। সুবোধ সংক্রান্ত মচমচে পরিবেশনযোগ্য খবর রেখে ভূতের গলির কথা কোত্থেকে নিয়ে আসে এই বুড়া- এটাই মনে হয় এই দুইজন চোখে-চোখে পরস্পরকে বলে। কিন্তু মূলত চুপ করে থাকে। অপেক্ষা করে বুড়ার কথা শেষ হবার। বুড়া বলে, ‘মহল্লার নানান আজিব জিনিসের মধ্যে একটা জিনিস ছিল, সুবোধ, সুবোধচন্দ্র দাস আর তার বউ স্বপ্না রানী দাস’। তরুণ সাংবাদিক দুইজন এইবার কিছুটা মনোযোগী হয় তার কথায়। সে জানায়, সুবোধ তিন থেকে চার বার, ১৫ বছরের ব্যবধানে বারবার মহল্লায় আসে। আর প্রতিবারই তার বউ, স্বপ্না রাণীকে নিয়ে কুয়োর মধ্যে পড়ে মরে যায়। শুরুটা ছিল ৭১ সালে। রাজাকার সংক্রান্ত একটা ঘটনায় সুবোধ আর তার বউ স্বপ্না রানী কুয়োয় পড়ে মরে। এরপর বিভিন্ন সময়ে, বারবার, বিভিন্ন রূপে কিন্তু একই নামে সুবোধ আসতে থাকে আর বউকে নিয়ে কুয়োয় পড়ে মরতে থাকে। তারপর বেশ কিছু বছর পার হলে এই ভূতুড়ে কাহিনির শেষ হয়। পরে এই কাহিনি লিপিবদ্ধ করে তখনকার এক অখ্যাত লেখক, শহীদুল জহির।‘ এতসব, বাবারা, তোমাগো কইবার কারণ একটাই’। বৃদ্ধ কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে। বলে, যে সুবোধকে নিয়ে তোমরা নিউজ করতে যাচ্ছ, এমনও তো হতে পারে, এরও পুরো নাম সুবোধ চন্দ্র দাস। এরও বউয়ের নাম স্বপ্না রাণী দাস। কথা শুনে দুই সাংবাদিক কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়। এই বয়োজ্যেষ্ঠ এবং নির্লিপ্ত চেহারার লোকটির এমন আষাঢ়ে গল্পের প্রেক্ষিতে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা বুঝে উঠতে পারে না দুইজন। বৃদ্ধ আবার বলতে উদ্যত হয়, যেন নিজ উদ্যোগেই, যেন কিছু একটা প্রেরণা একজন চুপচাপ থাকা মানুষকে হঠাৎ বাচাল বানিয়ে দিয়েছে। সে বলে, এইবার দেখার বিষয়, সুবোধের এই ঘটনা আমাদের ভূতের গল্লির ৭১ এর ঘটনার মত পুনরাবৃত্তি হতে থাকে কিনা। মানে,  সুবোধ বারবার মৌচাক ফ্লাইওভার থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে থাকে কিনা।

বাকি দুইজন এইবার হোহো করে হেসে ওঠে। বলে, তাহলে কিন্তু ওস্তাদ বেশ মজাই হবে! অন্তত আমাদের মত খবর ব্যবসায়ীদের জন্য। ঘটনাকে আরও সুস্বাদু করে খাওয়ানো যাবে জনগণকে। হাহাহা!

(৩)

‘ওস্তাদ’? ওই বৃদ্ধকে ওরা ওস্তাদ বলে নাকি! আমি অবাক হই সম্বোধন শুনে। বাকি কথাগুলো যেন কানে ঢুকলেও মনে ঢোকে না। আমি বৃদ্ধের পরিচয় সম্পর্কে ভাবতে থাকি। সে কি ওদের মতই সাংবাদিক, নাকি নিছকই তাদের পরিচিত বা অর্ধপরিচিত বা অপরিচিত কেউ? বৃদ্ধের কথাবার্তা, তার অস্তিত্ব, তার পরিচয় আমার মগজজুড়ে থাকলেও হঠাতই আমার নিজের সম্পর্কে একটা মৌলিক প্রশ্ন খেলে যায় মাথায়। আমি তাদের সঙ্গে এই কক্ষে কী করছি, আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না কেন। এবার আমি তাদের কথার বিষয়বস্তু, সুবোধ নিয়ে কেচ্ছা-কাহিনি, বৃদ্ধর আষাঢ়ে গল্প সব ভুলে যাই। ভুলে যাওয়া মাত্র এইসব দৃশ্য যেন সামন থেকে মুছে যায়। একমাত্র যা নিয়ে আমি চিন্তিত হই, তা হল, আমার নিজের অস্তিত্ব এবং পরিচয়। চোখ বুজি। প্রাণপণ ভাবতে থাকি। স্মৃতি হাতড়াতে থাকি। হঠাৎ যেন সদ্য ভূমিষ্ঠ এক শিশুর মত ফাঁকা মগজ হয়ে গেছে আমার। খানিক শীত করতে থাকে শরীরে। শৈত্যপ্রবাহের হিম হাওয়া গায়ে লাগে। ধরার মত কিছুই খুঁজে পাই না। শুধু একটা মৃদু গুঞ্জন। আমের সময়ে গ্রামে যে নীল ভোঁয়া মাছিগুলো দেখা যায়, তাদের মত শব্দ। ভোঁয়া মাছির আওয়াজ ক্রমশ বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে মনে হয় অনেকগুলো ভোঁয়া মাছি আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখ খুলি। দেখি, লোহায় তৈরি বড় একটা ফুটওভার ব্রিজ। নতুন। চকচকে। জনশূন্য। আমি ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে। বাম পাশে কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে নেমে গেছে দুইটা সিঁড়ি, ডান পাশে নেমে গেছে আরও দুইটা। মোট চারটা সিঁড়ি। চারপাশে দেখা যায় বহুতল ভবনদের মগজহীন করোটি। নিচে অসংখ্য সবুজ আর অসংখ্য কালো। সবুজগুলো সব সিএনজিচালিত অটোরিকশা। তাদের ইঞ্জিনের সম্মিলিত গুঞ্জনে আকাশকে এক বিরাট ভোঁয়ামাছি মনে হয়। কালোগুলো মানুষের কালো-কালো মাথা। পিলপিল করে তারা স্থির গুঞ্জনরত সবুজগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে ছুটতে চাইছে। কিন্তু ধাক্কা খাচ্ছে সামনের মানুষের সাথে, সিএঞ্জির সঙ্গে। এগুতে আর পারছে না। পিলপিল করছে যেন একটা ছোট্ট বৃত্তের পরিধির ভিতরেই। মানুষ আর সিএনজির ক্রমশ বড় হতে থাকা গুঞ্জনধ্বনি এই জনশূন্য ওভারব্রিজে আমার ওপর এক ধরণের ভীতিকর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। মনে হতে থাকে, আকাশ একটা বিরাট ভোঁয়ামাছি হয়ে উড়ে এসে আমাকে গিলে খাবে, অথবা তুলে নিয়ে যাবে হিমযুগের অনন্ত কুয়াশার আড়ালে, এই জনহীন ওভারব্রিজের উচ্চতা থেকে। আমি পালানোর পথ খুঁজতে থাকি উচ্চতার এই বিপজ্জনক একাকীত্ব থেকে। যে চারটা নামার রাস্তা আছে, আমার ডানে এবং বামে, সেগুলো দিয়ে মাটি পর্যন্ত যেতে হলে আমাকে পার হতে হবে কম হলেও ৭১ ফুট। এদিকে বাড়তে বাড়তে ভোঁয়ার গুঞ্জনধ্বনি আমাকে প্রায় ধরে ফেলেছে। নিচে তাকাই। মনে হয় ঠিক ৪১ ফুট নিচেই অসংখ্য মানুষ কিলবিল করছে। যদিও তাদের উদ্দেশ্য, গন্তব্য এবং কর্ম কিছুই আমার জানা নেই, তবু মনে হতে থাকে, সেখানে গেলেই আমি নিরাপদ। যেভাবেই হোক, আমাকে নামতেই হবে সমস্ত মানুষের আর যানবাহনের আটকে থাকা ভীড়ে। আমি সংক্ষিপ্ত পথটাই বেছে নিই। আমি দ্রুত লাফ দেই ওভার ব্রিজের রেলিং টপকে। এবং লাফিয়ে পড়ার পরমুহূর্তে, পতনের ঠিক আগমুহূর্তে, আমার সন্দেহ হয়, আমি কি সুবোধ?

 ছোট গল্প।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি