মিলটন রহমানের ভালোবাসার গল্প
একা এবং অদৃশ্য
প্রকাশিত : ১৯:৩১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৯:১১, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
থেমসের পাড়ে দাঁড়ানো অট্টালিকাগুলো ভেঙে ভেঙে পরছে। এইচএসবিসি, সিটি ব্যাংক এনএ, ক্রেডিট সুইজ সব, সেঁধিয়ে যাচ্ছে থেমসের পেটে। নানান রঙে ভাসছে জল। মৃত এবং আহত মানুষের রক্ত, শ্বাসের নীলাভ অংশ, কারো কারো বুকে জমিয়ে রাখা ক্ষোভ, ঘৃণা ও ভালোবাসা সব, সব ভাসছে। মাছেরা তৃপ্তি পাচ্ছে, এতো সুগন্ধি রক্ত আর কখনো পাওয়া যায়নি। এতো এলকোহল কোথা থেকে এলো! থেমসের সাথে মিশে সব পানি নেশা নেশা হয়ে ভাসছে। মাছেরা নেশায় বুদ হয়ে যাচ্ছে।
রমনীর বুক থেকে শুঁকে নিচ্ছে আফিমের ঘ্রাণ। ছুঁয়ে দিচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে নদীর নাভী বেয়ে তপ্ত উনুন। এভাবে আহত রমনীরা মাছের মা হয়ে উঠছে আর আহত পুরুষেরা নিজেদের জনক ভাবতে শুরু করেছে। মাছেরা ঠোঁট কেলিয়ে হাসে আর ভাবে,’যাক বাবা দূর্নামের হাত থেকে বাঁচা গেলো।’ মৃতদের দেখে আহতরা হাসছে আর বলছে, ’কি বোকা ওরা বাঁচতে পারলো না, মরে গেলো, হাঃ হাঃ হাঃ, আমরা বাঁচলাম কি করে। বাঁচলাম বলেই এতো এতো গিনি সোনা আর এতো রমনের রঙমহলে ভাসছি। রক্ত কোথায়? সব দেখি মৌতাতের নেশাজল। আরে কত কত পাউন্ড ভাসে জলে! প্রতিদিন এক একটি দেশ কিনে নেবো। বসাবো তান্ডব বাজার। হি: হি: হি:।
ঘুম ভেঙে গেলো সিহানের। জানালার পাশে বৃক্ষরা পাতাবাহার পাতাবাহার খেলছে। কোথাও মেঘ নেই। ওয়াপিং থেকে দেখা যায় দাঁড়িয়ে আছে এইচএসবিসি, সিটি ব্যাংক এনএ, ক্রেডিট সুইজ। তাহলে কি দেখেছে সে! ভাবতেই অবাক লাগে। কি বাজে স্বপ্ন! হায়! হায়! কি অমঙ্গল। গত পাঁচ বছরে একবারও দেখেনি এমন স্বপ্ন। এর মানে কি? আহা! কত কত রমনীরা ভেসে যাচ্ছিলো। এলসেসেসিয়ান কুকুরের মত জিহ্Ÿাও দেখা গেলো ভেসে যাওয়া পুরুষদের। তাদের মধ্যে সিহানও কি ছিলো! ভেবেই জিব কাটে সিহান। থাকলেও মন্দ হতো না! বড়লোকদের সাথে কিছু সময় ভেসে থাকতে পারলে মোটাতাজা হবার কিছু কড়ি জুটেও যেতে পারতো। একটু আফিমের ঘ্রাণ, একেবারে মন্দ হতো না। সিহান আবার ভেবে হতাশ হয়। আহা, সেতো ছিলো স্বপ্ন। কিন্তু ওই যে ভেঙে যাবার দৃশ্য! কোন মতেই ভুলা যাচ্ছে না। সত্যিই যদি ভেঙে যায় কি হবে?
ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে ওই এলাকার একটা ছবি আছে। ওই ছবি ১৮০৮ সালে তোলা। কিছুই ছিলো না সেখানে। ছিলো বাঁক নেয়া নদী আর ভাসমান কিছু ইঞ্জিনবোট। স্বপ্নের মত সব ভেঙে গেলে কি দুই’শ বছর পিছনে ফিরে যাবে কেনারি ওয়ার্ফ বা ইস্ট ইন্ডিয়া ডক? তাতে কি ভালো হতো? না । কারণ তখন তো ব্রিটিশরা দস্যুবৃত্তি করে বেড়াতো। ওই ডাকাতরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য জাতি হিসেবে নিজেদের দাবি করে। অথচ তাদের ডাকাতির ধরনটা পোশাক বদলেছে মাত্র।
আমি যা আয় করি তা যে কিভাবে শালারা আমার পকেট থেকে নিয়ে নেয় টেরই পাই না। আমাদের দেশে পকেট থেকে টাকা নেয়ার সময় ঝগড়া করা যায়। কিন্ত এখানে বুঝা যায় যে পকেট থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছু বলা যায় না। কারণ পদ্ধতি। ইংরেজীতে যাকে বলে ’সিস্টেম’। ইচ্ছে করে পুঁদের ওপর কষে একটা লাথি মারি। আহা! দিয়া’র পাশে বসলেই সব কষ্ট বাতাসের মত ফুৎকারিয়া যায়। বুক পকেটে জমে যায় আধুলি আধুলি সুখ। ওই সিস্টেমের কথা আর মনে পড়ে না। দিয়া বড় পয়োমন্তর। চোখ দিয়ে চেকে নিয়ে যায় সব চিন্তা আর টন টন ব্যাথা। ওই সুখের জন্য একটা রাজ্য দিতেও আমি রাজি। কিন্তু সমস্যাতো অন্য। ধ্যাৎ সমস্যার কথা আর ভাবতে ইচ্ছে করে না।
আজ দিনটাই শুরু হলো এভাবে। বাসা থেকে বেরিয়ে ওয়াপিং ডকের রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করেছে সিহান। কাজে যেতে ভালো লাগছে না। প্রায় দুইশ’(১৮০৫) বছরের পুরনো ওয়াপিং ডক এখনো কতো সাজানো গোছানো। এখানে নাকি বাংলাদেশ থেকে একবার একটি শীপ এসেছিলো। যে জলপথে ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারতবর্ষে লুটপাটে গিয়েছিলো, ওই পথেই এসেছিলো কি সে জাহাজ! যেভাবেই আসুক, অবাক করা ব্যাপার হলো,এ জলই পুরো পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠকে অখন্ড করে রেখেছে। কী দীর্ঘ জলের শরীর! শঙ্খ, কর্ণফুলীর জল কি থেমসে এসে মিশে? সিহান ভাবে, এই ডকের পাশে যদি তার ঘর হতো। তাহলে প্রতিদিন জলের শব্দ শুনতে পেতো। যে জল ভেসে এসেছে তার দেশের প্রিয় নদী কিংবা সমুদ্র থেকে। ঠিক জলের ওপর একটি ঘর। ওখানে দিয়া আর সিহান কান পেতে থাকতো।
জলের শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহের মত ইথারে ভেসে আসতো ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী। কিন্তু এ মুহূর্তে ভাবেতও আর ভালো লাগছে না। রাতের স্বপ্ন আর দিয়া, দু`টোই কেমন যেনো ভেজা মেঘের মত ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন তো স্বপ্নই, কিন্তু দিয়া? তাকে স্বপ্ন ভাববে কেনো! তার ঘ্রানতো সারাক্ষণ লেগে থাকে শরীর আর মনে। আন্ধারমানিক কানিচরার জল যখন সাপের মত ভাটির দিকে যায়, তখন তো ঘুমায় না বইন্যাকোরা কিংবা চালতা আঁটির ঝাড়। থেমসের জল ভাটিতে গেলে কেনো মরে যাবে দিয়া দিয়া সুখ? এ এক অবাক করা ব্যাপার। বিলেতের বাতাসে আফিম কিংবা এলকোহলের ঘ্রাণ থাকতেই পারে। সাদা গোলাপ বাগানে উর্কাবগা সাপ কিছু সময় বিলি কাটলে কি করার থাকে? দিয়া তো আর মেঘ হয়ে যায়নি। বরং আকাশের পশ্চিম রেখা থেমসের নাভিতে ডুব দিলে জেগে ওঠে দিয়ার মোলায়েম ঘ্রাণ। সিহানের মনে পড়ে প্রথম বিলেতে প্রবেশের কথা। সেদিন থার্টিফাস্ট নাইট। ভারী মেটালের সাথে দুলে দুলে উঠছিলো বিলেতি কইন্যারা। কিন্তু শরীর কিংবা মনের কোন অঙ্গে কাঁপন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মনে মনে ওই দিয়ার মত কাউকেই খুঁজেছিলো সিহান। এখনতো সে আছে।
আজ গ্রামের কথা খুব মনে পড়ছে সিহানের। তাদের বাড়ির পুকুর ঘাটে বসলেই সামনে দাঁড়িয়ে যায় কালো পাহাড়। পেছন থেকে ভোরের সূর্য রশ্নি ছড়াতে থাকলে ওই পাহাড়ও হেসে ওঠে। কিন্তু কানিচরা থেকে আন্ধার মানিক-দোচাইলা-একপাইয়া হয়ে মাটির শরীর বেয়ে বাঁকা পথটি কোথায় চলে গেছে তার সন্ধান পাওয়া যায়নি কখনো। সেই কৈশোর থেকে ওই পথের শেষ খুঁজছে সে। ওই পথে তো আর সমুদ্র নেই যে পৃথিবীতে ব্যপ্ত হয়ে গেছে। সত্যিই এই রহস্য নারীর মতই! দিয়াকে কত কাছে ধরে রাখে সারাক্ষণ, কিন্তু প্রায়ই তাকে অচেনা মনে হয়। বিলেতের আবহাওয়ার মত মুহুর্তেই সে মেঘ, রোদ কিংবা বৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু কোন রঙেই তাকে দূরের মনে হয় না। তবে থাকে মাঝ সমুদ্রে জেগে ওঠা একটা চর। ওখানে সব প্রশ্ন নির্বাসনে থেকে যায়। কোন প্রশ্নেরই আর উত্তর মেলে না। ও হেনরি’র ’প্রাইজ’ গল্পের প্রধান চরিত্রটির মতই প্রশ্নরা বিনা অপরাধে নির্বাসন প্রাপ্ত হয়।
হাটতে হাটতে রাতের স্বপ্নের সাথে দিয়া’র অন্তমিল খোঁজে সিহান। কোথাও একটা সূতো বান্ধা না থাকলে স্বপ্নের সাথে দিয়া কেনো আসবে? কিন্তু পরক্ষনেই এ চিন্তা ঠাঁই পায় না। স্বপ্ন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না সিহানের। তবুও কখনো কখনো কিছু স্বপ্ন নোঙর ফেলে বসে থাকে বুকের মাঝখানে। ভাগ্যিস দিয়াকে মাছের মা হতে দেখেনি সিহান। তাহলে বিলেত যাপন ভারী হয়ে যেতো। অজান্তে বা অদেখায় যা কিছুই হয় তা ’না দেখে বলবো কিভাবে’র মত প্রশ্নই থেকে যায়। চতুর না হলে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না আর। ঠিক ওই ইংরেজী ’সিস্টেম’ এর মত একটা ব্যাপার। সিহান ভাবে, তাহলে কি দিয়া ব্রিটিশ কায়দা রপ্ত করে ফেলেছে? ভারতবর্ষের যে মানুষগুলো উড়ে চলে এসেছে এদেশে, সবাই কি একই কায়দা রপ্ত করছে? তাহলেতো একটা কাজ হবে। ওই যে ভারতবর্ষে বেনিয়াদের শাষন-শোষনের কাল, তার পূণঃ প্রবর্তন হবে ব্রিটেনে।
এটাকে প্রাকৃতিক নিয়মও বলা যেতে পারে। কিন্তু ভারতবর্ষের মানুষগুলো ওই শোষনের জন্য মানষিকভাবে সামর্থবান কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে। ওই এলাকার মানুষেরা কেনো যেনো দুঃখ বিলাসী হয়। দুঃখের গান কিংবা কবিতা তাদের ভালো লাগে। মুখে সহজে হাসি লাগে না। এর প্রধান কারণ কি দারিদ্র? হতেও পারে। দিয়া’র তো অর্থ-কড়ির টান নেই। বাবার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পদ। তবুও কখনো কখনো তার মুষড়ে যাওয়া পরিদৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিলেতের নদীগুলো ভাঙ্গে না পদ্মা-মেঘনার মত। নিরন্তর বহমান যৌবন। দিয়ার বাল্য বন্ধু রূপনের কথা মনে হয় সিহানের। যে কিনা ঢাকায় বসে প্রতিনিয়ত মনে করতো তার গ্রাম সাভারচালায় শীতলক্ষ্যা ভাঙছে আর বুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভুল ভাঙে পাঁচ বছর পর যখন শীতলক্ষ্যার জলে পা রাখে। টের পায় শীতলক্ষ্যা নয়, রূপনই বুড়িয়েছে। ইদানিং এ গল্প বলে দিয়া। কেনো বলে?
আজ আর কাজে যাওয়া হবে না। ওয়াপিং পার্কে ওক গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে সিহান। ওকের চ্যাপ্টা পাতার ফাঁক গলে গড়িয়ে পরছে কখনো রোদ, কখনো মেঘ। এ এক অদ্ভুদ আবহাওয়া। সামার যাই যাই করছে। গাছের পাতারা হলুদ হচ্ছে। তাপমাত্রা এখন চৌদ্দ ডিগ্রী তো কতক্ষণ পর আঠারো ডিগ্রী। তবে বৃষ্টির আশংকা নেই মনে হচ্ছে। অদূরে ম্যাপেল গাছে বসে আছে ব্লু টিট পাখি। বুকের হলুদ রঙ আর নীল পাখনায় এ পাখিটির আঁকার বাংলাদেশের দোয়েলের কথা মনে করিয়ে দেয়। কখনো কখনো দিয়া পাখি হয়ে যায়। উড়তে থাকে লন্ডন শহরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। পাখি হিসেবে কি নাম দেয়া যায় তার? ব্লু টিট নাকি দোয়েল? ওকে জিজ্ঞেস করলে নির্ঘাত বলবে দোয়েল। বাংলাদেশের অনেক পাখির নাম তার মুখস্ত।
দেশের প্রতি তার ভালোবাসা যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। এক সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দেশ নিয়ে বক্তব্য শুনার জন্য অনেক শিক্ষকও ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতেন। কখনো কখনো ভাড়াটে বক্তা হিসেবে কাজ করার গল্পও সে করেছে। মুখে বাক্য থাকলে যে কোনো দেশে গিয়ে খাপ খাওয়ানো সহজ। দিয়া কে দেখলে তা বুঝা যায় অনায়াসে। ব্রিটিশদের নানা অকর্ম নিয়ে তার তিরস্কারের সীমা নেই। অথচ সেই পথেই পা রেখে সব ভুলে যায় দিয়া। কাজ করে যায়। হাতের মুঠো পুরে ফিরে আসে। এসে বলে ’বুঝলে এ হলো ক‚টনীতি’। বাংলাদেশের কোনো একটি মিশনে যদি সরকার তাকে নিয়োগ দিতো তাহলে নিশ্চয় একটি ঐতিহাসিক দৃশ্য তৈরী করতে পারতো। আজকাল বাংলাদেশের রাজনীতিক বা ক‚টনীতিক-আমলারা ছিচকে চোর। তাদের দিয়ে আর যাই হোক দিয়া’র মত ক‚টনীতি হবে না। প্রায়ই দেশে ফেরার কথা বলে সে। বেশ কয়েক বছর যাওয়া হয়না। লাল পাসপোর্টটা যতেœ রাখে। যাদের নাই তারা ওটা পর্দাফাই করে দিতে পারে সে ভয় তাকে তটস্থ রাখে। সবুজ পাসপোর্টটিও রিনিউ করে রাখে। তবে ওটার প্রতি তার তেমন মায়া দেখা যায় না। কাছে থাকলে তাকে রাতের স্বপ্নের কথা বলা যেতো। ও আবার এলকোহল খুব পছন্দ করে।
নিমিষেই ভোতকা সাফাই করে দেয়। আহা, তখন দিয়ার চোখে ঘোড়া ছুটতে থাকে। লিপিস্টিক ছাড়াই অধর লাল হয়। কাঁপতে থাকে আর টান টান করে কথা বলে। একবার তো এ অবস্থায় পুরো ওয়েস্টমিনিস্টার নিজের দাবি করে বসেছিলো। আর বলেছিলো একবার যদি ছোট প্রিন্সের সাথে দেখা হতো! সিহানের তখন বলতে ইচ্ছে করেছিলো, ইস একবার যদি মিডলটনের সাথে দেখা হতো! এ কথা মনে হবার সাথে সাথে রাতে দেখা স্বপ্নের সাথে দিয়া এবং নিজের কোথায় যেনো একটা মিল পাওয়া যায়। কোথায়? দু’জনের মধ্যেই ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন কাজ করছে। কাজ করছে স্থান দখলের ইচ্ছা। ব্রিটিশ আর মার্কিনীরা তো পুরো বিশ্বে থাবা ফেলে বসে আছে। আর এলকোহল না হলে দু’জনেরই এখন আর চলে না। পুরো সপ্তাহের অন্তত একদিন দু’জনে বসে পান করতে করতে মাতাল হবে আর ঢলে পরবে এটা তো রুটিন হয়ে গেছে।
কি অবলীলায় মৌজ করার দেশ ব্রিটেন। দিয়া অন্য দিনগুলো পাখির মত উড়তে থাকে। সিহানের কাছে এসময় বিলেতের আকাশকে দিয়াময় মনে হয়। খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোট বেলায় মেঘের ঘোড়া কিংবা হাতি দেখার মত পেয়ে যায় দিয়াকে। কিন্তু কখনো কখনো ওই মেঘের দেশে দিয়ার সাথে অন্য একজনকে দেখা যায়। তখন সিহানের মুখ খিচে খিস্তি আওড়াতে ইচ্ছে করে। আবার দমে যায়। এদেশে এসব নিয়ে কথা বলা যায় না। যার যা ইচ্ছে করবে। বাঁধা দিলে বিপদ। অধিকার খুন্নের অভিযোগে আইনের ফাঁস গলায় বিঁধে যাবে।
সিহান ওকের গুঁড়ি থেকে টান টান করে উঠে দাঁড়ায়। থেমসের দিকে হাটে। পাশের অফ লাইসেন্স থেকে একটি স্ট্রংবো’র ক্যান টেনে নেয়। রাতের একটি স্বপ্ন পরো দিনটিকে চমৎকার কিংবা দুরূহ ভাবনার আধার করে দিলো। বিয়ারের ক্যানে কয়েক টান দিয়ে বিরক্তিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মাত্র ৫ ভাগ এলকোহল! শালা এতেতো নেশাই হবে না। মাঝে মাঝে সিহানের এমন নেশা করতে ইচ্ছে করে যে, চোখে যেনো শুধু সবুজ দেখা যায়। ওই বাংলাদেশের মত সবুজ মানচিত্র। ওই মানচিত্রের শিরায় শিরায় মিশে যাবে দিয়া আর তার দেহগত সুখ। এরকম চিন্তা মাথায় কুন্ডুলী পাকাতে থাকলে থেমসের পাড়ে দাঁড়িয়ে একটু স্থির হয় সিহান।
পাশের বেঞ্চিতে বসে খালি পা রাখে বেঞ্চের ওপর। মেজাজ আবার সিঁটিয়ে ওঠে। মনে পড়ে বাড়ির পাশে দূর্বাঘাসের ওপর পা রাখলে কেমন শিউরে উঠতো পুরো শরীর। আর এখানে পা রেখে মনে হচ্ছে মরা কার্পেটের ওপর পা রেখেছে। কেনারি ওয়ার্ফের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করে না। থেমসের বুকে জেগে ওঠা ওই বাণিজ্যিক শহরটি তাবৎ বিশ্বের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এখান থেকে কত অন্নের যোগ-বিয়োগ হয় তা কে জানে। ওখানে নাকি বিশাল বাজেটের ছবিরও শ্যূটিং হয়। একবার নাকি আমাদের নায়িকা ববিতা শ্যূটিং করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একদিনে নব্বই হাজার পাউন্ড দিতে হবে শুনে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরও ওই এলাকাটি স্বপ্নের মত ভেঙে যাক তা সিহান চায় না।
ধরা যাক ওখানে যা কিছু মঙ্গলের জন্য হয় তা-ই মানুষের জন্য। আর অমঙ্গল তো সব সময়ই অস্পৃশ্য। সিহান তাকায় সম্মুখে। থেমসের বুক দ্বিখন্ডিত করে চলে যাচ্ছে রিভার ক্রুইজ। ওখানে লাফাচ্ছে সাফ কিংবা অক্টোপাস। ওরা ছোবল দেয় ওরা ঘিরে রাখে। ওদের বিষ অনেক সুস্বাদু হবার কথা নয়। মাঝে মাঝে দিয়া’র চোখে মুখে ওই বিষের সন্তরণ দেখা যায়। তবুও যে কেনো দিয়াকে এতো ভালো লাগে! কাছে পেতে ইচ্ছে করে। বুক থেকে এক গুচ্ছ বেলিফুলের ঘ্রান নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ইদানিং প্রায়ই ওর ফোন বন্ধ থাকে। বেশ ক’দিন দেখা হয় না। মাঝে মাঝে ও সময় পাল্টাতে চায়। রিফিল করতে চায় নতুন সময়। সিহান ঠিক করে এবার পেলে দিয়াকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। এ অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলে। সেখানে থেমস নয়, লী’র মত ছোট্ট একটি নদী থাকবে। থাকবে ছোট্ট ডিঙ্গী নৌকো। ওখানেই জলের ওপর হবে বসত। চারদিকে থাকবে জলপদ্মের বজরা। মাঝে মাঝে শাপলা থাকলেও মন্দ নয়।
প্রতিদিন দিয়ার পুঁজো দিতে সংগ্রহে থাকবে এক লক্ষ গোলাপ। ভাবতে ভাবতে দিয়ার নাম্বারে ফোন করে সিহান। আগে ভাগেই বলে নেয়া যাক ভাবনার কথা। দিয়া নিশ্চয় এসব শুনার পর মেঘের ঘোড়ায় চাপবে না। কিন্তু মোবাইল যথারীতি বন্ধ। মাথা নীচু করে বসে থাকে সিহান। দেখে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল কামড়ে ধরেছে একটি বিলেতি পোকা। ওটাকে হাতে তুলে ছুঁড়ে দেয় থেমসের স্রোতে। থেমস ভেসে যাচ্ছে। দিয়া ভেসে যাচ্ছে। থেমস বহুগামী হয়ে আছে এ লন্ডন শহরে। অত গমণ পথে দিয়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে, যাত্রা ভঙ্গ এড়াতে কিংবা নিজের ভেঙ্গে যাওয়া গোপনে লালন করতে। সিহান আর দাঁড়ায় না। নিজের ছায়া সাথে করে কর্ণের দুল খোঁজে নদী কর্ণফুলীতে।
/ এআর /