গল্প
মুরালী
প্রকাশিত : ২১:২৪, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২১:২৬, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
বহু বছর পর শীবচতুর্দশী মেলায় ভজন কাকার আসা। হাতে গুনে ভজন কাকার হিসেবে দশ বছর পর। ভজন কাকা এ মেলার বাঁশিঅলা। মুরালী বাঁশিঅলা। বাঁশীর পশরায় তার মুরালী আকর্ষণ। মুরালী ক্রেতার গুন বুঝে বিকোত। ভজন কাকা বলতো-বুঝলে কাহারা, মুরুলী কিনতি হলি দীককে নিতি অয়। এ বড় সব্বনেশে বাঁশি। সইলের মধ্যি বিছুটি পাতা ঘইসে দ্যায়।
মুরালী কাকা, মানে ভজন কাকা। আমি তাঁকে মুরালী কাকা ডাকলে, যেনো বহুদূর ঘুরে এসে চোখ ফেলতো আমার চোখে। সে চোখ ধূসর কিংবা ছায়াচ্ছন্ন নয়। প্রশ্নবোধক কিনা তাও বুঝে উঠিনি। তবে সেই চোখ বিমূর্ত্য আঁধার ফুঁড়ে চক চক করে ওঠে। ঠিকরে বেরিয়ে আসা তীব্র আলোকরশ্মি সুরের কোরাস তোলে। তখন কি আশ্চর্য্য বিভায় মুরালী, ভজনের ঠোঁট থেকে গড়িয়ে যেতো মেলার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। বসতি ছাড়িয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড় ছুঁয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতো মুরালী। মুরালী থেমে গেলে ভজনের বাঁশিরা; একে একে সেধিয়ে যেতো বোচকার ভেতর। যাবার আগে বুক থেকে চাপা শীষের মতো বেরুত- মুরুলী তুই মুক লিয়ে যাবি ক-নে? তুক খুজতি খুজতি সাধন ভজন কুছু কত্তি পাল্লামনে। মুরালী কাকা চলে যাবার পর আমাদের আর মেলায় থাকা হতো না।
মাঝ বয়সের রাত। পূর্ণিমার চাঁদ কিংবা অমাবস্যা। রাতের গায়ে অন্ধকারের ঘ্রান। আমার জানালার পাশে হাসনাহেনা কিংবা বেলীফুল সংসার। টুপ করে টিনের চালায় ঝড়ে পড়া বেলফুল। তারপর, তারপর মুরালী। মুরালী কেনো আমার ভালো লাগে? আমিতো মুরালী বুঝিনা। ভজনের মত মুরালী আমার কন্ঠলগ্নও নয়। কিন্তু মুরালী আমাকে রাত জাগায়। নিশাচর কিংবা পেঁচার মত। ডাহুক কিংবা হারিকুরি পাখীর মত। পেঁচা, ডাহুক এবং হারিকুরি কেনো রাত জাগে আমি জানিনা। আমি কেনো রাত জাগি? সম্ভবত সেটা অনুভবের ব্যাপার। মুরালী অনুভব। ঠিক চিন্তালগ্ন কোন ধনীকের বিলাসী
চিন্তাচিক্কুর নয়। বিশাল ড়্রইংএ পিয়ানো সাজানোর সৌখিনহন্তারক গাতক অনুভবও নয়। তাহলে আমার অনুভব কেমন? তাতানো রোদের তামাটে গন্ধ শোকার বুকঝিম অনুভব নাকি, মসনদ অধিকার ত্যাজ্য কোন রাজনীতিকের বেহায়ানুভব? আমার অনুভবের সাথে এসবের কোন কিছুই ঠিক যায় না। অতীন্দ্রীয় অনুভব মনে হয় এমনই হয়। এ অনুভব শুধু মুরালী অনুভব। মুরালী কাকা এ অনুভব আমাকে দিয়েছে। এ আনন্দ কিংবা বুকভার ব্যাদনা শুধুমাত্র ভজন কাকার। যা আমাকে বয়ে নিয়ে চলে। আমি এর ভেতর হাটি, এর ভেতর অখন্ড সময় পার হই, রাত জেগে থাকি।
তো ভজন কাকা এসেছেন দশ বছর পর। না ঘুমানো আমার ভেতরের আমি এখনো জেগে আছি। মনে হয় মুরালী ঘুমায় না। মুরালী কাকা শেষ যেবার এসে আর আসেননি মেলায়, সেবার। মুরালী আমার হয় । আমার ঘুম তাড়ায়। আমাকে ভজন কাকার আরো বেশী অনুগত করে। এটা পীরানুগত কিংবা নেতানুগত নয়। এটা অন্য রকম। এরকম ব্যাপার সম্ভবত খুব একটা ঘটে না। বিশেষত এসময়ে। বিব্রতবোধ অথবা রাজাকারের গাড়ীতে জাতীয় পতাকা উড়ার সময়ে, কেউ মুরালীআনুগত হয় না। এখন শুধু বিড়ালানুগত্যের সময়। এসময়ে মুরালী তুচ্ছ। এসময় পাক সার জমি সাদ বাদ কীর্তনের সময়। ফতোয়া দেয়ার সময়। মুখভর্তি দাঁড়ির ভেতর ইবলিস উকুন পালার সময়। যে উকুন বিরামহীন মিথ্যের জিগির করে। মুরালী ওদের ভালো লাগেনা। কেননা মুরালী ওদের মাটির কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। মনে করিয়ে দিতে পারে বিরঙ্গনার কথা। যে বিরঙ্গনা হয়তো তাদের রক্তধারা বহন করে। মুরালী সেই রক্তের কথা বলে। তাই মুরালী তাদের কাছে কুলে¬ হারাম। ভজন হারাম কাজ করার জন্য ফরেজগারদের বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু মুরালী ভজনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। কারণ ভজন ধম্ম কম্মের বিভাজন বোঝে না। ভজন মুরালীকে সত্য ধম্ম বলে জানে। ভজন বলে- বুঝলে কাহারা, ভগমান বুলেন আর আল্লা বুলেন, এই মুরুলীর মইধ্যিই তার বসত। হামি তাক খুঁজি পাই এই মুরুলীর মইধ্যি। মুরুলী হামার ধম্ম, মুরুলী হামার কম্ম। হামি তাক খুঁজি পাই মুরুলীর মইধ্যি। তমরা তাক নদেখলি মোক দোষ দেও ক্যানে। এ হামার সাত পুরুষির বিশ্বেস। হামি আট পুরুষ। হামার বিশ্বিসে ফাটক ধরবি না। হে বিটা হামাক পথ দেখায়। তমরা বাপু হামাক মুরুলী ফুকতি নিষিদ করলি, মুই পারবকলাই। মুরুলীতো হামি ফুকিনা। মুরুলী হামার ঠুটি আইসিই বাইজি ওঠে। এসময় খুরশিদ আহা! আহা! করে ওঠে। সে যেনো মূহুর্তের জন্য ভুলে যায় দলীয় বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস। বলতে শুরু করে- তিরমিজীতে বর্ণিত আছে: রসুল এক যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে এলে এক মহিলা ডফ বাজিয়ে গান গেয়ে তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে চাইলে তিনি অনুমতি দেন। ’ইন আন্তা ইল্লা অসবুউ দুমিতি/ ওয়া ফি সবিলিল্লাহি মা লকিতি’অর্থাৎ হে রক্ত পূর্ণ আঙুল, তুমি আল্লাহর পথে গিয়াছ’। রাসুল স্বয়ং নিজে এ পদবন্ধ রচনা করে গীতিসুরে আবৃত্তি করতেন। হাদিস আওড়ে খুরশীদ বলে- ভজন কাকা, তোমার রক্তপূর্ণ আঙুল মুরালী বাজায়। মুরালীতে তুমি স্বয়ং আল্লাহকে খুঁজে পাও। মুরালী বাজানো তোমার জন্য যায়েছ। তুমি মুরালী বাজাতে পারবে। তোমার কোন ভয় নাই। আমি আল্লাহর পথে তোমাকে দেখে খুশী। যারা তোমাকে বাঁধা দেয়, তারা তোমার মনের খবর জানে না। আমি তোমার মনের খবর তাদের জানিয়ে দেবো। তুমি মুরালী বাজাও। বাজাও মুরালী। জিগির করো মুরালীতে। খুরশীদের একথায় সেবার, ভজন বেঁচে গিয়েছিলো। কেননা খুরশীদ এক তরবারী শক্তির অধিকারী। তারপরও মুরালী কাকা সেবার যাবার পর, আর আসেননি। এলেন দশ বছর পর। কেনো আসেননি তা এখনো জানা হয়নি। খুরশীদের সাহস দেখানোর ঘঠনা আমার এখনো মনে পড়ে। সেই প্রথম কোন স্বঘোষিত ফরেজগারকে, ঢোলবাদ্যি এমনকি মুরালী প্রেমে মজতে দেখেছি। তবে খুরশীদরা এখন সম্ভবত অনেক বেশী গুনাহ করে, যদিও তারা নিজেদের গুনাহগার মনে করে না। গুনাহ তাদের ছুঁতে পারে না। ওরা এখন নারী নেতৃত্ব হারাম মনে করে না। সুর-জলসা নিয়ে তাদের আগ্রহ বেড়েছে। কারণ জনগন এসব পছন্দ করে। স্রোতের বিরুদ্ধে ওরা থাকতে চায় না। এতে সম্ভবত গুনাহ আরো বাড়বে। গুনাহগার হয়ে গেলে জনগনের সেবা করা যাবে না। জনগন দোয়া করলে আল্লাহ শুনবে। তবেইনা আল¬াহর রহমতে জনগনের সেবা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। ওরা এখন এরকমভাবে অনেক বেশী নমনীয়। দলীয় প্রচারনায় পতিতালয় থেকে সুড়িখানা পর্য্যন্ত যেতে ওদের গুনাহ হয়না। কারণ পতিতারা বেঁচে থাকার জন্য উপার্জন করে। জান বাঁচানো ফরজ। এ ফরজ কাজটাই পতিতারা করে। আর মদ গিলে চুর হয়ে থাকা মদ্যপ, সে মিথ্যে কথা বলতে পারেনা। সে অনুসুচনায় দগ্ধ হয়ে সত্য কথা বলতে শুরু করে। সত্য কথা বললে সওয়াব হয়। মদ্যপরা সত্য কথা বলে, তাই ওদের গুনাহ হয়না। ওরা সওয়াব জমাতে জমাতে নেক বান্দা হয়ে ওঠে। ওদের কাছে দলীয় সমর্থন চাওয়া মানে দলের প্রতি আল¬ার নেক নজর বাড়ানো। খুরশীদরা এখন এভাবে নিজেদের অনেক বেশী প্রগতিশীল ভাবতে পছন্দ করে।
তো কথা হচ্ছিলো, মুরালী কাকার দশ বছর পরে আসা নিয়ে। খুরশীদতো তরবারী সাহসের কিছুটা ধার দিয়েছিলো ভজনকে। তাহলে কেনো ভজন দশ বছর এলেন না? মুরালী কাকার সাথে এখনো সে ব্যাপারে কথা হয়নি। তাঁকে প্রথম দেখার পর সে ব্যাপারে জানার ইচ্ছা খুব প্রবল ছিলো। এখন মনে হচ্ছে সে ইচ্ছে নেতিয়ে কুর্ণিশ ঠুকছে মুরালী পদতলে। মুরালী তবুও দশ বছর পরে এসেছে, এ প্রাপ্তি, কোন রকম অপ্রাপ্তিযোগের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে না। শীবচতুর্দশী মেলা বসেছে। মুরালী মেলার আকর্ষন। মাঝে মাঝে মুরালী বেজে উঠছে। ধূলোয় চাপা দশ বছর বয়েসী ঘাসগুলো লতিয়ে উঠছে। সীতা মাটি ফুঁড়ে দাঁড়িয়েছে তেতুল তলায়। দ্রৌপদীরা হয়ে উঠছে মুরালীর। দূর থেকে ভেসে আসা জিগিরের শব্দ মুবালীর সুরে ছুটছে আকাশমুখী। রেলালাইনে পাথরে পাথর ঘসে ফুটছে আঁতসবাজি। আর, আর মেলার ভেতর দিয়ে ভেড়ার পালের মত ছুটে চলা একটি মিছিলের সাথে জমে উঠেছে মুরালীর দন্ধ। নতুন করে আর কোন দন্ধ হবার কথা ছিলোনা। কেননা খুরশীদ এ দন্ধাশংকা দূর করে দিয়েছিলো দশ বছর আগে। অবশ্য দশ বছর সময় কিন্তু কম নয়। এ দীর্ঘ সময়ে দুটো শক্তি দেশটাকে ঘসামাঝা করেছে। অতি সংবেদনশীল মানুষের মত রাষ্ট্রের অর্থ নিজের হেফাজতে রেখেছে। বেহাত হবার আশংকায় বিদেশী ব্যাংকে রেখেছে। অনেকটা পিঁপড়ের কামড়াশংকায় মা যেভাবে সন্তানকে কোলে তুলে রাখে। নিজের অতন্দ্রপ্রহরীদের নিরাপদে রাখতে ক্রস ফায়ারে দিয়েছে কুলাঙ্গারদের। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দাতাদের কাছে হাত পেতেছে। অর্থ এনেছে। ভাগভাটোয়ারা করে দেশের উন্নয়ন করেছে। দুদলের চিন্তার অন্ত নেই সমর্থক পনের কোটি মানুষ নিয়ে। দুদলের ভাস্য মত হিসেবে করলে দেশের জনসংখ্যা ত্রিশ কোটি। সম্ভবত পরিসংখ্যানবিদরা হিসেব কসতে জানেনা। অথবা কম মাথাগুনে টাকা মেরে দিয়েছে। দূর্ণীতি দমন কমিশন এখনো তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করে গুরুতর অপরাধ করছে। খুরশীদদের জোট আর কিছুদিন শাসন করতে পারলে একহাত নিতো। কেননা জনগন তাদের শক্তি। এই শক্তি নিয়ে অনিয়ম ওরা বরদাস্ত করেনা। কারন ওরা পরকালকে খুব ভয় পায়। ইহকালে পাপ করলে পরকালে হাতুড়িপেঠা হবে। হাঁড়গোর ভেঙ্গে যাবে। খুরশীদরা ইহকাল-পরকাল সব জায়গায় সুস্থ থাকতে চায়। আলোর পথে যাবার কথা বলে জনগনের সাথে প্রতারনা করা পাপের পর্যায়ে পড়েনা। একাত্তরে যা করেছিলো তা দীন কায়েমের জন্য। সেই ঘটনার জন্য যারা বিচার চাইবে, তাদের বিচার আল¬া করবে। এসব হিসেব করলে ওরা নেক বান্দা। পরকালে হুরপরি তাদের যত্ন আত্মি করবে। এ নেয়ামতের জন্য মাঝে মাঝে খুরশীদরা মতাদর্শে পরিবর্তন আনে। সম্ভবত এ পরিবর্তনের কোন জায়গায় খুরশীদ মুরালীকে বাঁচানোর সুযোগ হারিয়েছে।
খুরশীদ এখন মিছিলের অগ্রভাগে। অথচ আমি এখনো আপনাদের বলতে পারছিনা ভজন দশ বছর কেন আসেনি। তাঁর সাথে আমার এখনো কথা হয়নি। মুরালী আসার পর আমি নীরু হয়ে উঠছি। এবার আমি মুরালী বাজাবো। ভজন আমার গুরু। আমি শিষ্য হবো। আজ দিন প্রান্তিকের শেষ দিকে। চন্দ্রনাথ পাহাড় চুঁয়ে কুয়াশা নামছে। সন্ধ্যা নামার আয়োজন ধূপগন্ধময়। সম্ভবত শিয়াল ডাকছে। শিয়াল কিনা মিছিল বুঝা যাচ্ছে না। কেননা এখন মুরালী বাজছে। কোন কিছুই মুরালী ছাপিয়ে যেতে পারছেনা। এইযে সাগরদীঘির ঘাটে বসে আপনাদের সাথে মুরালী গল্প করছি, এর প্রতিটা মাত্রা যোগ হচ্ছে মুরালীসুর লহর থেকে। যেসুর একজন হন্তারকের হাত থামিয়ে দিতে পারে। এসুরে সহস্র যুগের অসভ্যতা উত্তীর্ণ হয় সভ্যতায়। অবশ্যই মাঝের অপরিশুদ্ধ দশ বছর থাকতো না যদি মুরালী থাকতো। সাতচল্লিশ থেকে খুড়িয়ে চলা খন্ড খন্ড অসময়গুলোতেও মুরালী ছিলোনা। আমার ভেতর মুরালী ছিলো বলে সম্ভবত পরকালে হাতুড়িপেঠার কথা ভাবতে পারিনি। ভাবতে পারিনি হুরপরীর কথা। এখন মুরালী আছে। ভজন দশ বছরের কুকুরকুন্ডুলী পাকানো জড়সময়কে সান দিচ্ছে। মুরালী বিদ্যুৎ রেখার মত ছড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের পাড়াতলী থেকে শহরতলী পর্য্যন্ত। প্রতিটা মানুষের ভেতর মুরালী বাজছে। এমনকি খুরশীদের ভেতরেও। কিন্তু ওর করার কিছূ নেই। কেননা, কথা দিয়ে কথা ফিরিয়ে নেয়া খুরশীদদের রাজনৈতিক আদর্শে পড়ে। আদর্শের বর খেলাপ করা নাফরমানী। ইমানী যোশ থাকলেই কেবল এরকম আদর্শ লালন করা যায়। এখন আন্দোলন। মুরালীর বিরুদ্ধে আন্দোলন। যতরকম সূচীতার বিরুদ্ধে আন্দোলন। যোশ না থাকলে এরকম আন্দোলন সম্ভব না। খুরশীদদের মিছিল সম্ভবত রেললাইন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মুরালীর দমকে মিছিলের শব্দ ম্রিয়মান। মুরালী শংকর মঠের কোন এক জায়গা থেকে উঠে ছুটছে দিগন্তাভিমূখে। মুরালী অনেক বেশী অপ্রতিরোধ্য। যতটানা খুরশীদদের মিছিল। মুরালী এখন কাঁদছে। মুরালী এখন বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। বিরঙ্গনার মত। শহীদ মা কিংবা পিতার মত। পথ চেয়ে থাকা প্রেমিকার মত। বোবাপ্রায় বিধবার মত। মর্টারের শব্দের মত। ভজন এখন কোন একক সত্বা নয়। মুরালী এখন দমকে দমকে নির্মাণ করছে বহু সত্বা। সত্বারা জেগে উঠছে। সত্বারা রেগে উঠছে। সম্ভবত একটু পরে দাঁড়াবে জারজ মিছিলের সম্মুখে। যে মিছিল এমাটি পারমিট করেনা। প্রতিটি ধূলোবালি ব্যথায় কাতর ওদের পদভারে। কারণ ওরা এমাটিতে পাকসার জমি সাদ বাদ আবাদ করতে চেয়েছিলো। কান পেতে শুনুন; মুরালীরা এসবের বিরুদ্ধে, তাদের প্রতিবাদের হাত উচিয়ে রেখেছে। শুনতে পাচ্ছেন? অনেক দূরে মুরালী ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছে। একান্নায় লেশমাত্র শোক নেই। শুধু আমাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, ধাবমান উত্তরণমুখী সময়ের বিস্ত্রিত সড়কে। যে সড়ক আমার প্রপিতামহের তৈরী। যে সড়ক আমার পিতার সংস্কার। যে সড়কে আমার মায়ের আঁচল পাতা। যে সড়ক আমার প্রিয়তমার নিরাপদ আশ্রয়। সে সড়ক, মুরালী সুরর্ম্চ্ছূনায় অর্শ্ব গতিতে ছুটছে, আরেক মুক্তির দিকে। এভাবে আমরা মুরালী শুনছি সাগরদিঘীর পারে বসে। এভাবে আমরা টের পাচ্ছি আমাদের অস্তিত্ব।
মুরালী বাজছে। পাহাড় বেয়ে নামছে তরল আন্ধকার। মুরালী বাজছে। ঘরে ফেরা মানুষ সাথে নিয়ে যাচ্ছে সারাদিনের কোলাহল। মুরালী বাজছে। সাগরদীঘির ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বটের ঝুলি বেয়ে অন্ধকার ছুঁতে চায়। কাটকয়লা অন্ধকার মেখে আতাল কেঁচোর মত ঘটাং ঘটাং ছুটছে মালগাড়ী। মুরালী বাজছে। আন্ধারমানিক টিলায় শিয়াল ডাকছে। শীতল নিরবতায় মুরালী লকলক করে বাড়ছে। যত রাত বাড়ে ভজন মুরালীকে আপন করে নেয়। দিনের মত রাতকে আলোকময়তায় উদ্ভাসিত করে মুরালী। আর আমি হয়ে উঠি মুরালী প্রতিবেশি। এবার সবার বাড়ি ফেরার সময়। আপনারা ফিরে যান। আমি? এখন আর ফিরে যাবোনা। খুরশীদরা আদর্শ রদবদল করেছে। মুরালী আবার এসেছে। ওই শুনতে পাচ্ছেন? মুরালী দমকে দমকে বাজছে।
পাঠক এই মাত্র কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ হয়েছে। আমার শ্রোতারা আছে কিনা অন্ধকারে টের পাচ্ছিনা। আমি ছুটছি শংকরমঠমুখী। মুরালী বাজছে না। গতি বাড়ায়। মুরালী বাজছে না। কানিচড়ার পাড় ধরে ছুটছি। হঠাৎ কে যেনো পাশ কেটে গেলো। কানিচড়ার পানি ছুটছে কলকল করে। অন্ধকারে জলের শব্দ বাড়ছে। আমি পথ হারিয়ে কানিচড়ায় নেমে ছুটছি। হঠাৎ আমার পা কে যেনো টেনে ধরে। বসে পড়ি। কানিচড়ার জল লিক্যুইড়ের মত ঘন হয়ে বইছে। গরম জলের শব্দে মুরালী মৃদু অথচ তীব্র রোষে বেজে উঠছে। মুরালী সুর দ্রুতবেগে ছুটছে জলের স্রোত বেয়ে। আমার ভেতরের মুরালী বেজে উঠছে। শেয়ালদল ডাকছে। আমি মুরালী হয়ে উঠছি। ভজন আমাকে ধারন করছে, আমি ভজনের নবম পুরুষ হয়ে উঠছি। আমি------