পর্ব-২
ফাঁস
প্রকাশিত : ১৯:৩৬, ১৫ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৫:১৫, ৪ এপ্রিল ২০১৮
সবুজ নিজের মতো করে মেয়ে খুঁজে বেড়ায় ।বন্ধুরা সবুজের জন্য হন্য হয়ে মেয়ে খোঁজে । মেয়ে পাওয়া যায়, মেয়ে পছন্দ হয়, কিন্তু, মেয়ের পরিবার পছন্দ হয় না ।আবার কোনটার পরিবার পছন্দ হলে, মেয়েটা সবুজের মনোমত হয় না । পছন্দ অপছন্দের গ্যাঁড়াকলে পড়ে সবুজের বসন্ত বন থেকে এক বছরের বেশি সময় হাওয়া হয়ে ওড়ে যায় ।
হঠাৎ এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়, দুর সম্পর্কীয় সবুজের এক খালাত ভাই সবুজকে নিয়ে চিত্রাদের বাড়িতে হাজির হয় ।
সবুজ বলে, এই বাড়িটা মেয়ের বাবার ।শহরের বুকে, বেশ খোলামেলা জায়গায় বাড়িটা দেখতেও বেশ সুন্দর ।মেয়েদের নিজের গাড়ি আছে ।পরিবারও তোর পছন্দ হবে ।সবাই খুব হাসি খুশি মিশুক । গাড়ি বাড়ির মালিক হলেও মনের ভেতর কোন অহংকার নেই ।
চিত্রার মা বাবার সাথে সবুজের সাক্ষাৎ হয় ।চিত্রার সাথে সবুজের দেখা হয়, কথা হয় ।চিত্রা গান করতে পারে না, কিন্তু কণ্ঠস্বর বড়বেশি সুরেলা, আহ্লাদে ভরা, ভারি মিষ্টি । চিত্রার চোখে মুখে চড়ুই পাখির অস্থিরতা । আর গায়ের রং স্বর্ণলতার মতো হলুদ । চিত্রা রুপবহ্ণি, চোখে তার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, হাসিতে মুক্তো ঝরছে ।
চিত্রা বড়বেশি কথা বলে, কলকলিয়ে নদীস্রোতের মতো সেই শব্দধ্বনি । মিনিট দশ পনরের মধ্যে চিত্রা তার ভেতর বাইরের সব সৌর্ন্দয সবুজকে জানিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় ।
সবুজ কোন কথা বলে না, বলার সুযোগ সে পায় না । চিত্রা বলে, সবুজ শুনে যায় ।সবুজ মুগ্ধ, বিমোহিত, এরকম চঞ্চলা হরিনীকে তো সবুজ মনে মনে এতদিন খোঁজে ফিরছে ।
শুধু চিত্রাকে নয়, চিত্রার পরিবারও সবুজের পছন্দ হয় ।
চিত্রার বাবা ছোটখাট একজন ব্যবসায়ী ।সপরিবারে শহরে থাকে । নিজের কেনা জমিতে একতলা দালান, গাড়ি আছে, বাসায় কাজের ছেলে মেয়ে আছে ।ভদ্রলোকের দুই মেয়ে, দুই ছেলে । চিত্রা সন্তানদের মধ্যে প্রথম ।
চিত্রার বাবা সবুজের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ।চৌদ্দজাতের মানুষ নিয়ে তার কারবার ।মিনিট কয়েকে সবুজেকে চিত্রার বাবা চিনে নিতে ভুল করে না ।গ্রামের ছোপ ছোপ সবুজমাখা সবুজের ভেতরটা পড়ে আসতে তার খুব একটা অসুবিধা হয় না ।
চিত্রার বাবা হাস্যমুখে সবুজের কাছে নিজ পরিবারের গল্প করে যায় । কোন কথা গোপন রাখে না । বলে, দেখ বাবা, আমিও গ্রামের ছেলে, পরিশ্রম আর সাধনায় আমি আজ এখানে এসে, হা হা হা ।
চিত্রার বাবা খুব হাসিখুশি মানুষ । মুখে তার হাসি লেগেই থাকে ।চিত্রার বাবা হাসতে হাসতে বলে, মেয়ে দুটি হয়েছে, সালেহার মতো, আমার স্ত্রী, বুদ্ধিমান, বেশ চালাক চতুর ।প্রথম জীবনে চাকরি করেছি, মাসগোনা পয়সায় সালেহার মন ভরে না । ওর জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে শুর করি ব্যবসা । হা হা । ভাল আছি, সুখেই আছি ।
আর একটা কথা, তুমি নিশ্চয় শুনেছ, এসব কথা তো লুকিয়ে রাখা যাবে না, দুর্গন্ধ তো সবার আগেই ছড়ায় । না শুনলেও দুই একদিনের মধ্যে শুনে যাবে । বলার লোকতো আর কম নেই । তার চেয়ে আমার মুখে শুন, আমার ছোট মেয়ে, নাম, চয়না, সে কলেজে ভর্তি হতে না হতেই এক ছেলেকে তার প্রেমের ফাঁদে আটকে নিয়ে বিয়ে করে বসেছে । চিত্রার বাবা আবারও হা হা করে হাসে । বলে, আমি বাবা হয়েও বুঝতে পারি নাই, আমার মেয়ের পেঠের ভেতর এত বুদ্ধি ।বুঝেছ বাবা, ছেলেটা পুলিশ বিভাগে চাকরি করে । ফ্যামেলিও ভাল । বুঝতে পারছ, কি বিচক্ষন মেয়ে আমার, একটা জ্বলজ্যান্ত পুলিশ অফিসারের গলায় ফাঁস পরিয়ে দিয়েছে ।যেখানে পুলিশ, চিত্রার বাবা আবারও শব্দ করে হাসে ।
তুমি কি এবার একটু চুপ করবে । চিত্রার মা বলে ।
চিত্রার মা কিন্তু এখনো মেয়ে জামাইকে স্বীকার করে নেয় নাই । অপেক্ষা করছে, পুলিশ বিভাগে চাকরি করার মতো মেধা সাহস, জ্ঞানবুদ্ধি ছেলেটার সত্যি আছে কিনা, খুব সাবধানী চোখে বিষয়গুলো চিত্রার মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে । আর আমি, গোপনে মেয়েটার সাথে এক আধটু কথা বলি, তবে জামাই বাবাজীর সাথে এখনো কোন কথা বলা হয়নি । হা হা হা ।
চিত্রার মা ধমক দিয়ে বলে, তোমার আক্কেল জ্ঞান কবে হবে, বলতে পার । কি সব যাতা বলে যাচ্ছ । ছেলেটা কি ভাবছে, বল তো ।
সবুজ একটা বোধাই টাইপের হাসি দিয়ে বলে, না না, আমি কিছুই ভাবছি না । ওনার কথা শুনতে আমার খুব ভালো লাগছে । সাদামাটা মনের মানুষ, মনের ভেতর কোন রকম ঘোর প্যাঁচ নেই ।আজকাল তো এরকম মানুষের দেখা মেলা ভাগ্যের ব্যাপার । আঙ্কেল, আপনি বলুন ।
চিত্রার বাবা মুখ বন্ধ করে রাখে । চিত্রার মা মুখ খোলে ।
চিত্রার মা মেয়ের মত রং সুন্দরী । কথার সুরটা ঠিক মেয়েলি নয়, শাসকের সুরে সে কথা বলতে বেশি পছন্দ করে ।সবুজকে তার ছাত্র মনে করে, নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তুলে । সবুজ ঘর্মাক্ত শরীরে, ভীত স্বরে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায় ।সবুজের আচরণে ব্যবহারে চিত্রার মা-বাবা দুইজনে খুব খুশি হয় ।
চিত্রার মা মনে মনে বলে, এরকম একটা ছেলেই আমি এতদিন ধরে আমার চিত্রা মায়ের জন্য খুঁজছি ।হে আল্লাহ, সত্যিই তুমি রাহমানুর রাহিম ।সব কিছু ভালোই ভালোই যেন শেষ করতে পারি, সেই দয়াটুকু করো ।
চিত্রার মা হাসিমুখে চিত্রা সম্পর্কে এক গাদা ভালো ভালো কথা সবুজকে শুনিয়ে দেয় ।বলে, দেখ, আমার মেয়েটার গুনগান তোমার কাছে আমি করবো না । তবে মেয়েটার দোষ যদি বলতে হয়, তাহলে বলবো, মেয়েটা আমার একটু অস্থির স্বভাবের ।বয়স কম, কলেজে পড়ে, আর আমাদের প্রথম সন্তান । ওর বাবা ওকে বেশি সোহাগ দিয়ে দিয়ে একটু জেদি স্বভারের বানিয়ে দিয়েছে ।বাইরে কারো সাথে অবশ্য এই জেদ দেখায় না । বাপের আহ্লাদি মেয়ে, বাপের কাছেই যত আব্দার আর জেদ ।অইসব নিয়ে ভাববার কিছু নেই, বিয়ের পর মেয়েদের এসব জেদ ফেদ কোথায় চলে যায় ।
চিত্রার বাবা বলে, কি শুরু করলে তুমি, মেয়ে তো বাবার কাছে নানা আব্দার করবে, এটাকে তুমি দোষ বলে প্রচার করছ কেন ।আমার মেয়েটার গুনগুলো সবুজকে শুনিয়ে দাও । ওসব শুনতে সবুজের ভালো লাগবে ।
সবুজ চিত্রার মা বাবার এই সরলতা দেখে মুগ্ধ হয় । ভাবে, একেই তো বলে পরিবার । কি সুন্দর আন্ডারস্টেডিং ।
চিত্রা শিকারি দৃষ্টিতে সবুজের আপাদমস্তক বার কয়েক দেখে নেয় । সবুজের গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, লম্বা, তবে শরীর-স্বাস্থ্যটা একটু রোগা রোগা । সবচেয়ে, বড় সম্যস্যা সবুজের পোশাক, কেমন যেন ক্ষেতক্ষেত মার্কা । কালো প্যান্ট, সাথে হলুদ রংয়ের ফতুয়া । কর্থাবার্তায়ও সবুজ খুব একটা স্মার্ট বলে চিত্রার মনে হয় না । কেমন একটা মুখচোরা স্বভাবের বলে তার বিশ্বাসে দানা বাঁধে ।সবুজকে তার পছন্দ হয়, আবার হয় না । দোটানার দোলাচলে সে দুলতে থাকে ।
চিত্রার মা, মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ায় । গুজুর গাজুর, ফিসফাস করে সে মেয়েকে বুঝিয়ে বলে, এরকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । কোন রকম ওজর আপত্তি করো না ।
মা, ছেলেটাকে আমিও খারাপ বলছি না, আগেকার গুলোর চেয়ে এই ছেলেটা অনেক ভালো, কিন্তু,পোশাকে আশাকে কেমন একটা গেঁয়ো ভাব আছে ।
তুমি মায়ের কথা শোন, ঐ গেঁয়ো গন্ধ দুইচার মাসের সাবান শ্যাম্পু জলের ধাক্কা খেলে বাপ বাপ করে কোথায় যে পালিয়ে যাবে,, সেটা তুমিও বুঝে ওঠতে পারবে না ।তোমার ভবিষ্যত সাজিয়ে গুছিয়ে দেবার দায়িত্বতো তোমার মায়ের । মায়ের ওপর ভরষা রাখো, বিশ্বাস রাখো, দেখ, কি হয় ।
মা, ওর পরিবার ।
ওর পরিবার ধুয়ে কি আমরা পানি খাব নাকি । আমাদের দরকার একটা মেয়ে জামাই, ওর পরিবার নয় ।আর বিয়ের পর, তুমি তো ওর পরিবার নিয়ে থাকবে না । থাকবে তুমি আর সবুজ । সেখানে বাইরের কেউ, আসে কি করে । সেইসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না । ছেলেটা নিজের পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তার মা বাবার পছন্দকে নয় ।ওর খালাতো ভাইয়ের সাথে আমার আর তোমার বাবার আগেই সব কথা ফাইনাল হয়ে আছে ।
তবু বলছি, ওর মা বাবা, ভাই বোন ।
বলছি তো, বেশি কিছু এখন জানার দরকার নেই, সময়ে সব জানতে পারবে ।
চিত্রা তার মাকে তার সম্মতি জানিয়ে দেয় ।
সবুজের বাবা মায়ের অমতে সবুজের খালাত ভাই, সবুজের অভিভাবক হয়ে বিয়ের কথা পাকা দিয়ে আসে ।
(চলবে)
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ কুমিল্লা ও রংপুর ক্যাডেট কলেজ।