সুরা, সুরা পান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
প্রকাশিত : ২০:৪৪, ১৫ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৫:১৫, ৪ এপ্রিল ২০১৮
ব্যাংককের পথে শিকাগো গিয়ে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইস্তাম্বুল ফ্লাইটে উঠে বসেছি মাত্র। প্রান্তিক আসন আমার জন্য আগেই সংরক্ষিত ছিল। একই সারিতে ডান পাশের দু’টো বসার জায়গা এখনো খালি। বিমান প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ, ভাবছি আর যদি কেউ না আসে তাহলে আজ তিন আসন নিয়ে শুয়ে-বসে আরাম করে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া যাবে। এমন সময় হাতে জ্যাকেট ও কাঁধে হ্যান্ডব্যাগ ঝুলিয়ে এক ভদ্রমহিলা হাঁটতে হাঁটতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন, জানান দিলেন, আমাকে ডিঙিয়ে জানালা-সিটের মালিক তিনি। কী আর করা, আমার আশায় গুড়ে বালি! পথ করে দিলাম, তিনি তাঁর জায়গায় গিয়ে বসলেন। ইতিমধ্যে বিমানের প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রীরা নিজ নিজ আসনে থিতু হয়েছেন। আমার ঠিক ডানের যাত্রী অনুপস্থিত, তাই অবস্থানগত দিক থেকে আমাদের দু’জনের মাঝে মাত্র এক আসন বরাবর তফাৎ। হলে কী হবে, অপরিচিত মানুষদের মতামত ও মত বিনিময়ের দূরত্ব অজানা, অপরিসীম! দুর্ভাগ্যক্রমে, এ দূরত্ব মাপার কোনো যন্ত্র আজ অবধি আবিষ্কৃত হয়নি!
এ সব বাস্তবতা মাথায় রেখেই আমি যখন সফরে বের হই তখন লেখালেখির উপাদানের খোঁজে সব কিছুই কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করি, অজানা অচেনা মানুষের সাথে কথা বলারও লোভ সামলাতে পারি না। এতে মাঝেমধ্যে আমাকে অসুবিধায়ও পড়তে হয়, আর ব্যক্তিটি যদি নারী হন তাহলে তো কথাই নেই - নিঃসন্দেহে, ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়, তথাপি আগুপাছু না ভেবে, সহযাত্রিণীকে জিজ্ঞেস করে ফেলললাম, আপনি কি ইস্তাম্বুলেই থাকেন? ‘না, আমি লরেন্স-ক্যানসাসে থাকি, তেহরান যাচ্ছি অসুস্থ বাবাকে দেখতে,’ উত্তর দিলেন তিনি। প্রশ্নে যা চেয়েছি, জবাব তার চেয়ে বেশি মিলল। তাঁর দেশ সম্পর্কে এমনিতে আমার অনেক জানার আছে, কৌতূহলও আছে। ভাবলাম, নিশ্চয়ই আজ আপনাদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মত কিছু না কিছু নতুন জ্ঞান পাওয়া যাবে। অবশ্য ওদিকে যাওয়ার আগে ভদ্রমহিলা নিজ থেকেই বলে বসলেন যে, তাঁর মনটা খুব খারাপ, কারণ সাম্প্রতিক ওয়াল স্ট্রিটের টালমাটাল অবস্থা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তিনি তাঁর কতগুলো স্টক বিক্রি করে সাড়ে সাত হাজার ডলার লোকসান গুনেছেন! এ বিষয়ে আমি যেটুকু জানি ও বুঝি তার ওপর ভর করে তাঁকে একটু আশার কথা শোনাবার চেষ্টা করলাম।
মনে হলো তিনি আমার বয়ান মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, সমঝে নিলেন এবং দু’দণ্ড স্বস্তিও পেলেন। পরক্ষণেই একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন রাখলেন, ‘আপনি এতকিছু জানেন কী করে?’ আমি অর্থশাস্ত্রের এক জন ছাত্র এবং স্টক মার্কেট সম্মন্ধে আমার সামান্য কিছু অভিজ্ঞতা আছে, এই যা, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। ওয়াল স্ট্রিট ওঠা-নামার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যদি সত্যি সত্যি বুঝতে পারতাম তা হলে আমি আজ এখানে না বসে ফার্স্ট ক্লাসেই বসতাম, সংক্ষেপে এই ছিল আমার জবাব। তিনি একটু মুচকি হেসে চুপ মেরে গেলেন। লম্বা বিরতির পর আবার কথোপকথন শুরু হলো। এবার তিনি নিজ দেশ সম্মন্ধে আমাকে যা অবহিত করলেন, সংক্ষেপে তা এইরূপ: বহির্বিশ্বের অবরোধ উঠে গেলেও এখনো ইরানের আর্থসামাজিক অবস্থা খুবই নাজুক। জীবনযাত্রার জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, তার ওপর মুদ্রাস্ফীতি লাগামহীন হারে বেড়েই চলেছে। বিত্তবানরা সৌখিন জিনিসপত্র টাকা দিয়েও মেলাতে পারে না। জনগণের ওপর রাজনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়ন অব্যাহত আছে। সম্প্রতি রাজপথে যেটুকু উত্তেজনা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল তা থেমে গেছে। এখন মানুষের মুখে প্রতিবাদের কোনো ভাষা নেই। মনে হলো ভদ্রমহিলা ঘোর সরকারবিরোধী। ইরানে এটা নেই, ওটা নেই বলতে বলতে তিনি এক পর্যায়ে বলে বসলেন, তাঁর দেশ এমনভাবে দেউলিয়া হয়েছে যে, তেহরান এয়ারপোর্টের বাথরুমে নাকি টয়লেট পেপার রাখার সামর্থও হারিয়ে ফেলেছে। আরও বললেন, তিনি এতে ভীষণভাবে লজ্জিত ও বিব্রতবোধ করেন। হাফিজ, সাদী, আত্তার, খৈয়াম ও ফেরদৌসীর দেশ - ইরানে দেখার মতন অনেক কিছু আছে, এ সব ছাপিয়ে ওই মুহূর্তে তেহরান বিমানবন্দরের বাথরুম দেখার উদগ্র বাসনা আমার মাঝে জেগে উঠলো, কিন্তু আমার এ ইচ্ছের কথা কোনোমতেই তাঁকে বুঝতে দিলাম না।
সচেতন অথবা অবচেতন মনে তিনি তাঁর দেশকে নিয়ে খানিকটা গর্ববোধও করলেন। বললেন, তিনি তেহরানে যে ল্যাসিক সার্জারি করিয়েছিলেন, জনৈক আমেরিকান চোখের ডাক্তার তা দেখে অবাক হয়ে বলেছেন, ‘কাজটি নিখুঁত হয়েছে!’ আরও জানালেন, ইনস্যুরেন্স কোপেমেন্টের কারণে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমআরআই করাতে অসমর্থ। এবার তেহরানের সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে কাজটি সেরে যাবেন। আমি বললাম, তাহলে আপনার দেশে কিছু ভালো ও ইতিবাচক কাজও হচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো, দীর্ঘ দিনের এই কঠিন অবরোধের মাঝে ইরান অত্যাধুনিক মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি আমদানী কিভাবে করে, কোত্থেকে করে? তিনি এর জবাব দিতে পারলেন না। আমিও এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পাইনি। তারপর এক সময় আমি ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার দেশে কি মেয়েদের জন্য হিজাব পরা বাধ্যতামূলক? তিনি জানালেন, ‘হ্যাঁ’। আমি বললাম, হিজাব ছাড়া এয়ারপোর্টে গিয়ে নামলে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না? বললেন, ‘আমার হ্যান্ডব্যাগে হিজাব আছে। সময়মত পরে ফেলব’। না পরলে কী হবে? আমার পরের প্রশ্ন। ‘পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, জেলে পুরবে, নির্যাতনও করতে পারে!’ দারুণ অসহায়ের সাথে বলতে বলতে তাঁর চোখেমুখে এক করুণ ছবি ভেসে উঠলো! আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল! ইরানি নারীর সাথে আমার কাজের কথা মোটামুটি এখানেই শেষ।
এরপর ডিনার পরিবেশিত হলো। খাওয়াদাওয়ার পর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘন্টা দু’এক বাদে চোখ খুলে দেখি, আমার সহযাত্রিণী মনের আনন্দে আচ্ছাসে সুরা এস্তেমাল করছেন! মনে মনে ভাবলাম, আপনার দেশের সরকার, পুলিশ, প্রশাসন আপনার ওপর জুলুম করছে, কিন্তু আপনিও যে নিজের ওপর জুলুম করছেন তা বেমালুম গাফেল হয়ে আছেন! আজকাল আমরা এমন এক জমানায় বাস করছি যখন অত্যাচারী যে, সে তো অত্যাচারীই, যে অত্যাচারিত সেও আজ অত্যাচারীর বেশে আবির্ভূত হয়েছে! আর কাউকে না পারলে, জেনে হোক, না জেনে হোক, ন্যুনতম পক্ষে নিজের ওপর নিজেই অত্যাচার করে চলেছে! সুরা ও সুরা পানের কথা কিন্তু এখানেই শেষ নয়, সামনে আরও আছে। একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন।
এ রাত গেল, পরের দিনও গেল, আকাশে উড়ছি তো উড়ছি, পথ আর শেষ হচ্ছে না! অবশেষে ইস্তাম্বুলে কয়েক ঘন্টা বিরতির পর তৃতীয় দিন স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ন’টার দিকে ব্যাংককে অবতরণ করলাম। যথারীতি ইমিগ্রেশন ও কাস্টম্স সেরে ট্যাক্সিতে উঠে হোটেলের দিকে রওয়ানা দিয়েছি। নতুন দেশ, এ-দিক ও-দিক দেখছি, ভালোই লাগছে। রাস্তাঘাট নিখুঁত, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এয়ারপোর্ট থেকে যতই শহরের দিকে এগোচ্ছি, ততই পরিবেশটা যেন কেমন কেমন লাগছে! মেঘবিহীন আকাশ, সূর্য আছে, উত্তাপ আছে, আলো আছে, ছায়াও আছে, তবু কী যেন একটা নেই! কী নেই, তা আবার বুঝতেও পারছি না! আকাশটা যেন মলিন, মনমরা, ঘোলাটে ঘোলাটে লাগছে; ধোঁয়ামাখা, ধোঁয়াটে। আকাশের গাঢ় নীল রঙ বদলে গেছে! হে আল্লাহ্, এ কী হেরিলাম আমি ব্যাংককে! সভ্যতার এ কী বীভৎস বিকৃত রূপ, উন্নয়নের এ কী বিধ্বংসী বিষাক্ত বহিঃপ্রকাশ! এতক্ষণে বুঝলাম কী হয়েছে!
দূষণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অগণিত খাল-নালা ও নদী যেমন মরে গেছে, ব্যাংককের আকাশ ও আজ মৃত! এত বড় শহর, লক্ষ লক্ষ লোকের বাস, বিরাট, বিস্তৃত, উন্মুক্ত আকাশ! এত বড় আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে, আকাশের ঘন নীল রঙ ফিকে হয়ে আছে! বৃষ্টি, ঝড়, বাতাস কোনো কিছুই এই ধোঁয়া কাটাতে পারছে না। আমি বিস্ময়ে হতবাক, আমি স্তম্ভিত! আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা হরহামেশা ব্যাংকক যায়-আসে, তাদের সাথে দেখা হয়, কথা হয়, কিন্তু ব্যাংককের এই বিবর্ণ অম্বরের কথা কেউ আমাকে বলেনি, কোনো দিন বলেনি। আমার এক শ্রীলঙ্কান বন্ধু সাংহাই-এ থাকে। তার কাছে শুনেছি, সাংহাই ও বেইজিং-এ নীল আকাশ দেখা যায় না। আজ ফিকে আকাশ, মৃত আকাশ ব্যাংককেই দেখে ফেলেছি। ধূসর আকাশ দেখতে ও’দিকে আর না গেলেও চলবে! এ কোন জগতে আমার বাস করছি! মানুষ শুধু জমিন, পানি ও হাওয়ার স্বাদ ও গন্ধ বিকৃত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা চৌহদ্দিবিহীন উদাম উন্মুক্ত আসমানের রঙও বদলে দিয়েছে! নিঃসন্দেহে এটা মানব সভ্যতার এক ক্রান্তিকাল!
ব্যাংককের আকাশ দেখে দেখে আমার ক্লান্ত চোখজোড়া নেমে এল মাটির ধরায়। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে চেয়ে দেখি ট্যাক্সি ড্রাইভারের লাইসেন্স ঝুলছে। ভদ্রলোকের নাম, মি. সুরা পান। তাঁকে বললাম আপনার নামটা বড়ই সুন্দর! আমাদের ভাষায় এ নামের অর্থ মদ্যপান। আপনি কি সুরা পান করেন? তিনি অকপটে বললেন, বিকেল বেলা কিঞ্চিৎ সেবন করে থাকেন। সুরা ও সুরা পান নিয়ে আমার মূল কথা এখানেই শেষ, তবে আপনাদের আগ্রহ থাকলে এ নিয়ে আরো দু’একটি কথা বলতে পারি। ধৈর্য ধরে পড়ুন, আশা করি নিরাশ হবেন না। সুরা ও সুরা পান পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এত দিন আমেরিকায় থেকেও দু’একটি মাত্র শব্দ ছাড়া এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানি না। এ লেখা শুরুর আগে গুগল-অনুসন্ধান করে সুরা সস্মন্ধীয় আরো কয়েকটি শব্দমালা আবিষ্কার করি, যেমন: ভদকা, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, ভারমাউথ, কগন্যাক, বিয়ার, পোর্ট ওয়াইন, রাম, জিন, স্কচ, লিকার, বোরবন, স্টাউট, ফেনি, শ্যাম্পেন, টাকিলা, রেড ওয়াইন, হোয়াইট ওয়াইন ইত্যাদি, ইত্যাদি। এরপর বন্ধু মাহবুবকে ফোন করলাম এই ভেবে যে, সে কী জানে। আমি তাকে বললাম, দেখ, আমি হরেক রকম মদের একটি তালিকা তৈরি করেছি, দেখি তুই কতটার কথা জানিস। আমাকে বলল, ‘পড় তো দেখি কী কী পেয়েছিস’। আমি পড়তে লাগলাম, ভোদকা, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, ভারমাউথ। ‘ভারমাউথ’ বলতেই মাহবুব হেসে দিয়ে আমাকে থামালো, বলল, ‘এটা ‘ভারমাউথ’ নয়, ‘ভারমুথ’’। আমি ধাক্কা খেলাম, একটি নতুন শব্দ শিখলাম। ‘তারপর বল’, মাহবুবের তাগাদা। আমি গড় গড় করে পড়ে যাচ্ছি, ‘কগন্যাক’, এবার সে আরো জোরে হেসে দিয়ে বলল, এটা ‘কগন্যাক’ নয়, এর উচ্চারণ ‘কনিয়াক’। ফ্রান্সের একটি জায়গার নাম ‘কনিয়াক’। ওই জায়গার নামানুসারে এই মদের নাম হয়েছে ‘কনিয়াক’। আমি বললাম, তুই এত কিছু জানিস কী করে? তাহলে নিশ্চয়ই তুই লুকিয়ে লুকিয়ে মদ খাস, হা হা করে দুই বন্ধু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। বুঝলাম, আমার বন্ধুর পাণ্ডিত্যের সাথে পেরে ওঠার কোনো উপায় নেই! মদ না খেয়েই মদের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখে, এতে যদি তার আসক্তি থাকত, তাহলে দু’একটি নতুন মদ হয়তো সে আবিষ্কারই করে ফেলত। সুরা ও সুরা পান নিয়ে মাহবুবের বাকি কথা বলতে গেলে আমার এ লেখা আজ শেষ হবে না। তাই ওদিকে আর যাচ্ছি না।
মি. সুরা পান আমাকে ‘অ্যাম্বেসেডর’ হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। হোটেলে চেকইন করার সময়ই বুঝতে পারলাম, এই হোটেলের অধিকাংশ অতিথি বাংলাদেশী। কেউ বেড়াতে এসেছেন, কেউ ব্যবসার কাজে, তবে বেশিরভাগের আগমন চিকিৎসার্থে। রোগীর সাথে আসা কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম, ঢাকায় এত নামীদামী হাসপাতাল হলো - সেখানে কি এই মানের চিকিৎসা হয় না? ‘স্কয়ার’, ‘ইউনাইটেড’, ‘ল্যাব এইড’ থাকতে এত কষ্ট করে, এত টাকা খরচ করে আপনারা কেন এখানে আসেন? তাঁদের কাছে যে উত্তর পেলাম তা কেবল নৈরাশ্যজনকই নয়, বরং বিভীষিকাময়! বাংলাদেশের রোগীরা, নিজ দেশের ডাক্তার ও হাসপাতালকে বিশ্বাস করেন না। তাঁরা জানালেন, শুধু মোটা অঙ্কের বিল করার জন্য, ডাক্তার ও হাসপাতাল মিলে অকারণে রোগীদের ওপর অস্ত্রোপচার করে ফেলে। শুনে আমার পিলে চমকে উঠলো! এ কথা আমাকে একজন, দু’জন নয়, অনেকেই বলেছেন। নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় দেশ ও জাতিকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে! এই গভীর খাদ থেকে উত্তরণের উপায় কী, ভাবতে হবে সবাইকে।
‘অ্যাম্বেসেডর’ ও তার আশেপাশে সব সময় অসংখ্য বাংলাদেশী ভাই ও বোনেরা হাঁটাহাঁটি করেন। হোটেল চত্বরের মধ্যে তাঁদের অনেকের দোকানও আছে। কয়েক জনের সাথে আমার কথা হয়েছে, যেমন - এই যে আপনারা ব্যাংকক আসা-যাওয়া করেন, আপনাদের কি কখনো নজরে পড়েছে যে, ব্যাংককের আকাশ মরে গেছে! এখানে মেঘহীন আকাশের রঙ বদলে গেছে! ‘আমরা তো খেয়াল করিনি। তবে হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমরা তো কখনো এভাবে দেখিওনি, ভাবিওনি’। মোটামুটি সবার মুখে একই কথা। আমি বললাম, গত দশ বছর দেশে যাই না, বলেন তো, ঢাকার আকাশেরও কি রঙ এ রকম ফিকে হয়ে আছে? বন্ধুরা ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে থাকেন, ‘কী জানি, আমরা তো ঢাকার আকাশ খেয়াল করে দেখিনি, দেখার দরকারও মনে করিনি’। বাহ! আমার দেশের মানুষ, ঢাকায় থাকেন, অথচ ঢাকার আকাশ গাঢ় নীল না ধোঁয়ায় ঢাকা, বলতে পারেন না। বলেন তো, আমি হাসব না কাঁদব!
এবার ব্যাংককে বিদেশীদের সামাজিক সম্পর্কের ওপর সামান্য আলোকপাত করতে চাই। এআইটির অধ্যাপক ফজলে করিম সাহেবের বাসায় এক ছোট্ট ঘরোয়া আড্ডায় যে গল্প শুনেছি তা আমার মত করে আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। কথায় কথায় করিম ভাই বলেছিলেন, সম্প্রতি তিনি জটিল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা সেলে কয়েক দিন ছিলেন। ওই সময় তাঁকে দেখতে বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবের অনেকেই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে একজন ছিলেন খ্রীষ্টান, তিনি শুধু দেখতেই যাননি, বরং একই দিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অনেক দূরে অনেক কষ্ট করে চার্চে গিয়েছিলেন কেবল বন্ধু রোগীর জন্য প্রার্থনা করতে। আরেকজন ছিলেন ভারতীয় মহিলা, জাতিতে জৈন, তিনি রোগী দেখতে রাতের বেলা হাসপাতালে গিয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে বের হতে হতে দেরি হয়ে যায়, তথাপি বাড়িতে না গিয়ে তিনি সরাসরি ব্যাংককের জৈন টেম্পলে চলে যান। সেখানে করিম ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা করে গভীর রাতে ঘরে ফিরেন। যে কথা শুনে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো, করিম ভাই যে নাপিতের কাছে নিয়মিত চুল কাটাতেন তাঁর পেরেশানি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখে। অনেক দিন করিম ভাইয়ের দেখা না পেয়ে নাপিত হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজতে থাকেন, বাড়িতে ফোন করে খবর নেন। এত দিনে রোগী বাড়িতে চলে এসেছেন, কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হননি। এ কথা জেনে নাপিত করিম ভাইয়ের বাড়িতে এসে তাঁর চুল কেটে দিয়ে যান। আগেকার দিনে বাঁধা নাপিত নিয়মিত জমিদারবাড়িতে এসে সকলের চুল কেটে, দাড়ি ছেঁটে দিয়ে যেতেন। করিম ভাই শুধু এআইটির শিক্ষকই নন, ব্যাংককের জমিদারও বটেন!
পরিশেষে করিম ভাই ও ভাবির মুখে শোনা একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আজকের মত বিদায় নেব। কয়েক বছর আগে গোটা এআইটি ক্যাম্পাস এক প্রলয়ঙ্করী বন্যায় প্লাবিত হয়। ছয় থেকে আট ফুট পানি পুরো ক্যাম্পাসের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। যত দিন তাঁদের বাড়িঘর পানির তলে ছিল তত দিন তাঁরা সিটি সেন্টারে একটি হোটেলে ছিলেন। পানি সরে যাওয়ার পর প্রথম যেদিন ঘরে এসে ঢুকলেন তখন দেখেন নিচতালার যাবতীয় জিনিসপত্র কাদামাটি মেখে লন্ডভন্ড হয়ে বিধ্বস্ত মেঝেতে লুটিয়ে আছে। এর মাঝে শুধু একটি ব্যতিক্রম ছিল - কোরআন শরীফ, যেটা টেবিলের ওপর পেয়েছেন - যেন কেউ যত্ন করে তুলে রেখেছে! এখানে বলে রাখা দরকার, পবিত্র কোরআন খানাও পানিতে ডুবেছে, ভেসেছে, ভিজেছে, কারণ এর কাভার, কাগজ, ছাপা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, পাতা উল্টিয়ে তার পাঠোদ্ধার অসম্ভব হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো - সবকিছু মাটিতে, শুধু কোরআনখানা টেবিলের ওপর!
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক- টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ