ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৩ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আসাহি সিম্বুন ও আমরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:৪৪, ২৯ মার্চ ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

জাপানে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষ এক নম্বর পত্রিকাটির নাম আমাদের অনেকেরই অজানা। তবে প্রচার সংখ্যায়  শীর্ষস্থানে থাকা পত্রিকাটির নাম আবার অনেকেই জানেন। পত্রিকাটির নাম আসাহি সিম্বুন (ASAHI SIMBUN)। জাপানি ভাষায় আস্ হা শব্দের অর্থ ভোর বা সকাল। আর সিম্বুন শব্দের অর্থ পত্রিকা বা কাগজ। বাংলায় আসাহি সিম্বুনের নাম বলা যায়, ভোরের পত্রিকা বা ভোরের কাগজ; সকালের পত্রিকা বা সকালের কাগজ।

তিন দশক আগে জাপানের রাজধানী টোকিওতে অবস্থিত আসাহি সিম্বুনের অন্যতম সদর দপ্তর তিন-তিনবার সরজমিনে পরিদর্শনের সৌভাগ্য হওয়ায় এ পত্রিকাটির প্রকাশনা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা হয়। দীর্ঘদিন পর আমি আমার সাংবাদিক সহকর্মীদের সাথে এই পত্রিকাটির প্রকাশনা বিষয়ে কিছু তথ্য ভাগাভাগি করার লক্ষ্যেই আজকে আমার এ লেখার উদ্দেশ্য। দীর্ঘ সময়ে এনালগ যুগ থেকে ডিজিটাল যুগে পদার্পণ করেছে বিশ্বের ছোট-বড় অনেক দেশ। ডিজিটাল উন্নয়নের এ ধারা এখন মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। ফলে এখন আর থাকছে না জেনারেশন গ্যাপ বা প্রজন্মশূন্যতা। হালে বাংলাদেশও ডিজিটালের কল্যাণে এগিয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। জাপানের আসাহি সিম্বুনের প্রকাশনায় তৎকালীন আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতি দেখার পর আমার কি ধারণা হতে পারে তা এখন সবাই সহজেই অনুমান করতে পারেন।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নকালে বারবার মাস্টার্স পরীক্ষার তারিখ পেছানোর এক পর্যায়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইন্সটিটিউটে জাপানি ভাষার ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস করছিলাম। এরই মধ্যে মাস্টার্স পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা ও পরীক্ষা শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে জাপানি ভাষার ক্লাস করা তথা ডিপ্লোমা কোর্সটি সম্পন্ন করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। যদিও একই সময়ে আমি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম জাপানির ভাষার সামান্যতম শিক্ষাটুকুও বুঝি আমার জন্য নিরর্থকই হয়ে যাবে। কিন্তু না, ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ‘ইয়ু লিডারশিপে’র ওপর জাপান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছয় মাসের এক বৃত্তি নিয়ে আমি জাপান যাই। নিপ্পন কেনসিকাই (NIPPON KENSIKAI) নামের যে যুব সংস্থার কল্যাণে বৃত্তিটি পেয়ে আমার জাপান যাওয়া, তারা যখন জানতে পারলো আমি পেশায় একজন সাংবাদিক; তখন তারা তাদের কর্মসূচিতে কিছু পরিবর্তন এনে সাংবাদিক হিসেবে আমাকে আমার কাঙ্খিত বেশকিছু ক্ষেত্রে বিচরণে অগ্রাধিকারও দেয়। আলোচিত কর্মসূচিতে এশীয় অঞ্চলের আরও ৭/৮টি দেশের যে যুবক ও তরুণেরা অংশগ্রহণ করেন তাদের সঙ্গে একই বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অবসর সময়ে আমার কাঙ্খিত ক্ষেত্রে আমাকে নিয়ে যাওয়া হতো। একথা হয়তো আমাদের সবারই জানা, আমন্ত্রিতদের হোমস্টেতে রেখে জাপানিরা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল কর্মকান্ড এবং জাতীয় উন্নয়নের সবকিছুই অন্যকে দেখাতে ভালোবাসে।

এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের প্রতিবছরই জাপানে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, জাপান থেকেও প্রায় বিশ হাজার তরুণ-তরুণীকে সরকারি খরচে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট দেশের সামাজিক অবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকান্ড সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের জন্য।

জাপানে যখন যাই তখন আমি টগবগে তরুণ এক পেশাদার রিপোর্টার সাংবাদিক। ছোটবেলা বই-পুস্তকে পড়েছি ‘সূর্যোদয়ের দেশ জাপান’। তাই জাপান ও সে দেশের মানুষ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল আমার আগে থেকেই। জাপান সূর্যোদয়ের দেশ- কথাটি যে আসলে সিম্বোলিক বা প্রতীকী তা বুঝতে পারি জাপান যাওয়ার পরেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত জাপান প্রতিহিংসার রাজনীতিতে না জড়িয়ে ‘ফ্লাওয়ার মুভমেন্ট’ বা শান্তির আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রা শুরু করে সেখান থেকেই জাপানের সূর্যোদয়ের দেশের খ্যাতি। যা পরবর্তীতে সারা বিশ্বের মানুষই উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এর ফলে বিশ্বের অনেক দেশই এখন উন্নত বা উন্নয়নশীল উন্নত দেশ। একদিন নিপ্পন কেনসিকাই প্রধান হাম্মাদা সানকে জাপানের শ্রেষ্ঠ পত্রিকার প্রকাশনা কার্যক্রম দেখার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি আমাকে জাপানে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষ পত্রিকাটির নাম বললেও প্রচার সংখ্যায় দ্বিতীয় শীর্ষ পত্রিকা ‘আসাহি সিম্বুন’-এর টোকিও সদর দপ্তর পরিদর্শনের ব্যবস্থা করলেন।

প্রথম যেদিন আসাহি সিম্বুন পত্রিকা অফিসে যাই তখন আমাকে রিসেপশন কক্ষে টেলিভিশন মনিটরে পত্রিকাটির প্রকাশনা কার্যক্রম দেখানো হয়। কেননা ওই দিন ভিতরে ঢুকে সরজমিনে দেখার অনুমতি আমার ছিল না। অবশ্য সাধারণের সরজমিনে পর্যবেক্ষণের কোন নিয়মও তখন চালু ছিল না। পত্রিকাটির প্রকাশনা কার্যক্রম টেলিভিশন মনিটরে দেখে আমি তৃপ্ত না হওয়ায় হাম্মাদা সান আসাহি সিম্বুন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্বিতীয়বারের মত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করলেন। এবার পত্রিকা অফিসের ভিতরে গিয়ে অসংখ্য কম্পিউটার মনিটর দেখে আমারতো মাথা খারাপ। কেননা এর আগে বাংলাদেশে কোন পত্রিকা অফিসে কম্পিউটারে কম্পোজ ব্যবস্থা দেখিনি এবং আমাদের দেশের সংবাদপত্রে জাপানের তৎকালীন ডিজিটাল আধুনিকতার হাওয়া মোটেই লাগেনি বললে চলে। আগে থেকেই আমাকে বলা হলো এবং পরে দেখানো হলো রিপোর্টারদের কম্পোজে ভুল হলে সঙ্গেসঙ্গেই ভুল সংশোধন করা যায়। ঠিক ওই সময়ে আমার ধারণা ছিল শুধুমাত্র টাইপ রাইটার সম্পর্কেই। আলোচিত সময়ে বাংলাদেশে সংবাদপত্রে কম্পিউটার কম্পোজতো দূরের কথা কম্পিউটার প্রযুক্তিই ছিল দুর্লভ এবং যা ছিল তখন সবার চিন্তারও বাইরে। তখন বাংলাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে ছাপাখানায় সিশার টাইপে হ্যান্ড কম্পোজই ছিল একমাত্র ভরসা।

এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার নয়শ’ বিশ বর্গমাইল আয়তনের বিশ্বের ৬১তম বৃহৎ দেশ জাপান। যার ৭৩ শতাংশ এলাকাই পাহাড় পর্বত ঘেরা। জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৬৮ লাখ। যা ৫৫ হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির চেয়ে প্রায় চার কোটি কম। জাপানের অধিকাংশ মানুষই শিক্ষিত। তাই পত্রিকার পাঠক সংখ্যাও বেশি। অথচ বাংলাদেশে শুধু পত্রিকার সংখ্যাই সাত শতাধিক কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় পত্রিকার পাঠক সংখ্যা কম। ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী জাপানে পত্রিকা প্রকাশনার সংখ্যা মোট ১১০টি। এরমধ্যে জাতীয় পত্রিকার সংখ্যা পাঁচটি। শীর্ষ একনম্বর পত্রিকার নাম ইয়োমিউরি (YOMIUR)। রক্ষণশীল দৈনিক হিসেবে পরিচিত বাম রাজনীতির ধারক এ পত্রিকার সারাদেশে প্রকাশ সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৪৩ হাজার। উদারপন্থী বা Liberal হিসেবে পরিচিত দ্বিতীয় শীর্ষ দৈনিক আসাহি সিম্বুনের (ASAHI SIMBUN)প্রচার সংখ্যাও বর্তমানে এক কোটির উপরে।

উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত অপর তিনটি পত্রিকার প্রত্যেকের প্রচার সংখ্যাও ষাট লাখের উপরে। আলোচিত আসাহি সিম্বুন তার উদারনৈতিক সাংবাদিকতার জন্য জাপানে এখনও সর্বজনগ্রাহ্য একটি দৈনিক পত্রিকা হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত। টোকিও ছাড়াও পত্রিকাটি আরও পাঁচটি প্রশাসনিক অঞ্চল (প্রেফেকচার) থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির অন্যতম প্রকাশনা সদর দপ্তর ওসাকা প্রশাসনিক অঞ্চলে।

আসাহি সিম্বুন ১৮৭৯ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম প্রকাশিত হয় ওসাকা সদর দপ্তর থেকেই। তখন এর প্রচার সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার কপি। টোকিও সদর দপ্তর থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয় ১৮৮৮ সালের ১০ জুলাই। তখন পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজার কপি। ইংরেজি ভাষায় সকাল ও বিকেলে দু’টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সকালের সংস্করণ প্রকাশের সংখ্যা ৭.৯৬ মিলিয়ন বা ৭০ লাখ ৯৬ হাজার এবং বিকেলের সংস্করণ ৩.১ মিলিয়ন বা ৩১লাখ কপি।

ছিয়ানব্বুই বছর পরের কথা। ১৯৮৪ সালে আমার টোকিও সদর দপ্তরস্থ আসাহি সিম্বুন পরিদর্শনের সময় তার কার্যালয়ের অবস্থান ছিল মহানগরীর কিয়োবাসি (KYOBASI) এলাকার

মতোসুকিয়াকোতে (MOTOSUKIYACHO)। তখনকার আসাহি সিম্বুন ভবনের আটতলার ছাদে ছিল তিনটি হেলিকপ্টারের উড্ডয়ন ও অবতরণের ব্যবস্থা। দেশের কোথাও কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলে রিপোর্টার-ফেটাগ্রাফারসহ প্রয়োজনীয় দল ছুটে যেতো সেখানে। সংবাদ সংগ্রহের জন্য খোদ টোকিও

মহানগরীতেই নিয়োজিত ছিল ২২শ’ (২২০০) রিপোর্টার। পত্রিকা ছাপা হওয়ার পর তার গ্রাহক বা এজেন্টের কাছে পৌঁছানোর জন্য নাম-ঠিকানা লেখা, প্যাকেট করা এবং তা গাড়িতে ওঠানোর ব্যবস্থাও করা হয় সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতেই।

বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে কতজন রিপোর্টার কাজ করেন তার কোন সঠিক তথ্য কারও কাছে আছে বলে আমার মনে হয় না। প্রশ্ন করা হলে কেউ হয়তো অনুমান ভিত্তিক একটি সংখ্যাও বলে দেবেন। এ সংখ্যা হয়তো হবে ৫/৬ হাজার।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) কতজন সদস্য তার একটা সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে ঠিকই কিন্তু পাওয়া যাবে না গোটা দেশ কিংবা শুধু ঢাকায় কর্মরত সংবাদ মাধ্যমগুলোর রিপোর্টারদের সঠিক পরিসংখ্যান। চীন আন্তর্জাতিক বেতার (CRI), বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল বাংলাভিশন এবং কয়েকটি সংবাদপত্রে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আমার সম্পৃক্ততা। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে কর্মরত প্রকৃত রিপোর্টারের সংখ্যা শুধু আসাহি সিম্বুনের টোকিও মহানগরিতে কর্মরত রিপোর্টারের সংখ্যার চেয়ে খুব একটা বেশি হবে বলে আমার মনে হয় না। সংবাদপত্র প্রকাশনা ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিন দশক আগে আমরা কোথায় ছিলাম, আর এখন কোথায় আছি- সে কথাই ভাবছি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি