ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

এটি ছাড়া যাবেন না...

জামশেদ উদ্দীন

প্রকাশিত : ১২:৫১, ১ মে ২০১৮ | আপডেট: ২২:২৬, ১১ অক্টোবর ২০১৯

কোনোভাবেই রেখে যাবেন না। আর না গেলেই সব আয়োজন ভণ্ডল। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ছেলে লিমন মণ্ডল অপেক্ষার প্রহর গুণছে। হবু স্ত্রীর এমন বায়না। বিয়ের আসরে শ্বাশুড়ি আম্মাকে উপস্তিত থাকতেই হবে। ফ্রান্সের নাগরিক থ্রীয়া পাউয়ে। তার সঙ্গে লিমন মণ্ডলের বিয়ে পাকাপাকি। দিনক্ষণও ঠিকঠাক।

থ্রীয়ার এমন আচরণ অনেকটা প্রথাবিরোধী। ফ্রান্সে বিয়ে-অনুষ্ঠানে বর-কনের আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত থাকাটা বাধ্যবাধকতা নেই। থ্রীয়ার এ দাবি তাকে চরম বেকাদায় ফেলে দিয়েছে। তবে লিমন মনে মনে খুশি। অন্তত এ উপলক্ষে আসা হবে মায়ের। অনেক দিন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। জীবীকার তাগিদে বৃদ্ধ মাকে একা রেখে আসতে হয়েছে। দেশে মা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা মারা গেছে বহু বছর আগে। এক মাত্র সন্তান লিমন মণ্ডল।

কিন্তু মায়েরও একি বায়না! আত্মীয়রা ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছে। তিনিও বগার মতো এক পায়ে খাঁড়া। এটি ছাড়া যাবে না, পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। একটি মাত্র মুরগির ছানা। ছানাটির মা মারা গেছে রাতকানা রোগে। ছানা নিয়ে আঙ্গিনায় কুত্-কুত্, ছানা মায়ের ডাকে কিত্-কিত্ ডেকে-ডেকে পেছনে পেছেনে ছুটে চলে। আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাবারও খাওয়ায়।

তিনি প্রতিদিন এ দৃশ্য দেখে আসছেন, আবার চাউল ভাঙা খুদও খেতে দেন নিজে। না খেয়ে রান্না করা ভাতও খেতে দেন। এভাবে বাচ্চা ছানাটি লালন-পালন করে আসছেন।

মরার কাক-চিলে-নেউলে এক এক করে ১০/১১টি ছানা নিয়ে যায়। ছানাগুলো নিজেদের আত্মরক্ষা করার কৌশল শিখার আগেই মা মারা গেল।

ঘরের আঙ্গিনায় কাটা ঝুঁপঝাড় রাখা আছে। কাক-চিল আসতে দেখলোই যেন লুকিয়ে যেতে পারে। সর্বশেষ বাচ্চা-ছানা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এখন বাচ্চটা বেশ বড় হয়েছে। তবুও সারাক্ষণ পেছনে-পেছনে কেমন কিক্-কিক্ ডেকে-ডেকে ঘুরে-বেড়ায়। আদার খান পর্যন্ত কিছুক্ষণ শান্ত থাকে।

কিন্তু দু’চোখ আড়াল হলেই কেমন আবার ঝাঁপটাঝাঁপটি।  

যখন রেখে যাবে না, তা হলে তো আর কোনো উপায় নেই। থলে ভরে নিলে তো হয়। বিষ্টা থলের মধ্যে পরবে। কালো রঙের একটি পলিথিনের মধ্যে শুধু মাথাটা বের করে আছে। সহজে দুনিয়া দেখছে এবং নিশ্বাসও নিতে পারছে।

তিনি বহন করছেন, কাউকে স্পর্শ করতে দিচ্ছেন না। সবার তার এমন আচরণে বিরক্ত। তাই, অগোচরে ছোঁড়েও ফেলে দিতে পারে, তিনিও তা বুঝতে পেরেছেন।

বিমান বন্দর পর্যন্ত নিজেদের ভাড়া মাইক্রোতে যেতে হলো। এ পর্যন্ত পথে একবার বিষ্টা ছেড়েছে। তিনি নিজে নিজে পলিথিন ঝেঁড়ে নিলেন।

ইন্ডিয়া ইয়ারওয়ে। প্রথম স্টেশন কলকাতার নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু। দ্বিতীয় দিল্লির মহাত্মা গান্ধী স্টেশন। দিল্লি থেকে সরাসরি ফ্রান্সের প্যারিসে, মাঝে কোথাও বিরতি নেই। তাই যাত্রীদেরও নামা-উঠার সুযোগ নেই। লাগেজ স্কেনারে, আর বাচ্চাটা বরাবরই তার কোলে। লাগেজ টেস্টে কোনো প্রকার বিপদ-সংকেত দেখায়নি।

তিনি যেতেই চেকপোস্ট আপত্তি জানালো। কিন্তু যতসব ঝামেলা তার হাতের পুঁটলিটি নিয়ে। তারা দেখলেন ছোটখাটো একটি প্রাণী। অনেকটা রসাত্বক কৌতুহল সৃষ্টি হলো। এখন এটাই আলোচনার মধ্যমনি। আস্ত একাট প্রাণী নিয়ে যাওয়া। তা আবার মুরগির বাচ্চা; দাম কতবা হবে? এটি কী রেখে যেতে পারেননি? তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। এ যাবত তারা ইমিগ্রেশনে এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পায়নি।

রেখে যাওয়া তো দূরে থাক কাউকে ধরতেই দিচ্ছেন না। কী আর করা ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র দিতে হলো, অতি বৃদ্ধ দেখে এ সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রাম্য নারী হিসেবে কিছুটা নমনীয় হলো। তারা তার মনে কষ্ট দিতে চায়নি। এমনিতে এ বয়সে মাতৃভূমি-দেশ পাড়াগ্রাম প্রতিবেশী ছেড়ে যেতে হচ্ছে। ভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতি তাকে মেনে নিতে হবে। প্লেন চাড়ার পূর্ব মুহূর্তে বিমানবালারা চেক করে দেখে। তাদের চোখেও এটি ধরা পড়ে। তারা এমন কাণ্ড কখনো দেখেনি। একজন একজন করে তারা সবাই দেখে গেল। তাদের মনেও কী একটা অজানা ভয় উঁকিঝুঁকি দেয়। ইমিগ্রেশনে তারা মেসেজ দেয়, এমনতর বস্তুর বা প্রাণীর উপস্থিতির কথা। ইমিগ্রেশনে পজেটিব আনসার আসায় কেউ আর কোনো আপত্তি করেনি।

প্লেন ছেড়ে যায় আকাশে। খণ্ড-খণ্ড ঝড়োমেঘ কেটে চলেছে। স্থির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের ভেতরে কি একটা কিয়ক্-কিয়ক্ ডেকে উঠে। যাত্রীরা এবং এটেন্ডেনগণ হতচকিত। এমন শব্দ কোত্থেকে এলো, তারা খোঁজতে থাকে। একপর্যায়ে নিশ্চিত হলো মুরগীর ছানার এমন ডাক। খিদে পেয়েছে তো, বৃদ্ধা তা বুঝতে পেরেই কাপড়ের আঁচল থেকে চাউলের খুদ বের করে দেয়। ‘টুক-টুক’ করে খাচ্ছে। সবাই তা দেখে ‘হো-হো’ হেসে উঠে এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে এলো। এর মধ্যে তারাও একটি মেসেজ পাঠিয়ে দেয় স্টেশনে।

বিপজ্জনক শব্দটি একটি কক্ ছানার শব্দ। প্লেনে কক্ ছানা এলো কোত্থেকে স্টেশন জানতে চাইল। তারাও বৃদ্ধার কাহিনিটি জানালো। সেখানেও হাসাহাসি, তবে তারাও পাল্টা উত্তর দেয়, এমন খেয়ালিপনা করা উচিৎ হয়নি বলে জানালো। 

দিল্লিতে ল্যান্ড করায় সব স্টাফ পাল্টে গেল। নতুন স্টাফ-বিমানবালা এলো দায়িত্বে। সঙ্গে সঙ্গে চেকসহ যাবতীয় নিরাপত্তা দেখভাল শুরু হয়।

বিমানবালাগন যাত্রীদের নাম-ধাম ঠিকানা ঠিকঠাক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। 

‘চাচী, আপকা নাম কিয়া হে? দেশ...? এতনে কিয়া হে, বাবু, মোজে দেখনে-দেখনে।’ হঠাৎ বিমানবালার এমন প্রশ্নে দিশাহারা। অনেকটা বিমানবালার চোখে চোখে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসেন তিনি, সঙ্গে পুঁটলিটাও আরও শক্ত করে ধরেন। নজরে পড়লো বিমানবালারও। তিনি আরও পরখ করে দেখতে থাকেন। গায়ে কালো বোরকা, বোরকাটি কেমন কুঁচানো। মনে মনে ভাবেন, কখনও আয়রন করা হয়েছে কিনা কে জানে? ডিম্বা আকৃতির চোখ, মুখ ও কপালে অজস্র বলিরেখা। যুবুথুবু দেহের ভাঁজে ভাঁজে এক ধরণের ভীতি ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠে। পুঁটলিটি স্বজোরে আগলিয়ে রেখেছেন। সম্ভবত কাউকে এটি ধরতে দেবেনই না তিনি।  

বিমানবালা আবারও প্রশ্ন করলেন,‘চাচী, আপনা নাম...?  এতনে...?

একপর্যায়ে বিমানবালা এসব বলে হাতবাড়িয়ে দেয়। কিন্তু পুঁটলিটি কোনোভাবেই দেখাতে রাজি নন। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘তুই কারো মাইয়া, দাঙ্ঘর কোত্থোন, ন-দিয়ুম, ন-দেখায়ুম।’ এ বলে আরও শক্ত করে আঁটকে রাখলেন এবং তড়িগড়ি বোরকা টেনে ঢেকে দেয়, যেন না দেখতে পায়।

চটে গেলো বিমানবালা। তার চোখেমুখে ভীতিকর-আতঙ্কভাব। তিনি চেঁচিয়ে সহকর্মীদের ডেকে উঠলো। তারাও দল বেঁধে তেড়ে আসে। কী একটা বিপজ্জনক সংকেত। এর মধ্যে আবারও ‘খড়-খড়’ ডেকে উঠে মোরেগের ছানা। যাত্রীগণও তাতে হেসে উঠেন, তারা প্রথম থেকে দেখে আসছেন বুড়ির কাণ্ড। অনেকটা হট্টগোল বেঁধে গেলো। 

বিমানবালা আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘চাচী, ইয়া কিয়া হে?’ ‘কী হে কী হে, এ্যান গরি কি জানতে লায়গোজে? কুরার ছা-রি, আই ন-দিয়ুম! আর পোয়ার বিয়ে, আরতন ফ্রান্সে যনপরের। তোরে ন-দিয়ুম। আই বইত কষ্ট গরি পাল্লি-যে।’  

বিমানবালাসহ অন্যান্য স্টাফগণও দিশাহারা, খোদ পাইলট এসে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে গেলেন। এমতাবস্থায় যাত্রা বিলম্ব করতে বাধ্য হলো। তারা যাত্রীটির দেশ ও বুকিং স্টেশনে যোগাযোগ করে একটি মেসেজ বার্তা প্রেরণ করে। সঙ্গে সঙ্গে বিমান স্টাফরাও তা শোনে হতচকিত। কী ঝামেলা যে বেঁধে গেলো। জানি না শেষ পর্যায়ে এ নিয়ে কি ঘটনা ঘটে যায়। তারা ডাটাব্যাস ওপেন করে বৃদ্ধার বায়োডাটা দেখে পাল্টা উত্তরে একটি ইমেল বার্তা প্রেরণ করে। এ বৃদ্ধা ফ্রান্সে যাচ্ছেন। ওইখানে তার ছেলে থাকেন এবং তার বিয়ে-অনুষ্ঠান। সঙ্গে একটি ব্যাগ ও পালিত একটি মুরগীর বাচ্চা আছে। তিনি খুবই শান্ত-স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছেন। গ্রামের অতি স্বহজ-সরল নারী। কোনো প্রকার ঝুঁকি নেই। এটি আমাদের স্কীনেও ইনফরমেশন আছে।

দিল্লির ইমিগ্রেশন ঢাকার এই ইমেল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় যাত্রার নির্দেশ দিলো। তবে এ ঘটনায় ন্যুনতম এক ঘণ্টা বিলম্বে বিমান ছেড়ে গেল। দীর্ঘ আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে প্যারিসের রোসিয়া এয়ারপোটে ল্যান্ড করলো প্লেন। আর মায়ের জন্য অপেক্ষায় আছেন পুত্র লিমন মণ্ডল। সঙ্গে হবু স্ত্রী থ্রীয়ার পাউয়েও রয়েছে। প্লেন নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা বিলম্বে ল্যান্ড করে। কিন্তু থ্রীয়ার মধ্যে এক ধরণের কৌতুহল কাজ করছে। হবু স্বামীর মুখে অনেক গল্প শোনেছে। গ্রামের সহজ-সরল নারী। একটি শিল্পোন্নত-আধুনিক রাষ্ট্র্যের বৈচিত্রময়তার সঙ্গে কতটুকু বা খাপ-খাওয়াতে পারবেন। এসব নিয়ে সে লিমনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন।

এক এক করে যাত্রীরা যার যার অবস্থায় বের হয়ে গন্তব্যে ছুটলেন। কিন্তু লিমনের মায়ের কোন দেখা মিললো না। সে দিগ্বিদিক উঁকি দিয়ে দেখলেন। হঠাৎ হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। লোকজনও দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। বোমা-বিস্ফোরক বহনকালে এক যাত্রীকে আটক করে নিরাপত্তা বাহিনি। তাৎক্ষণিক গুঞ্জন-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাইরেন বাজিয়ে বিশেষ ফৌজ, ফায়ার সার্ভিস ও এম্বুলেন্স ধেয়ে আসতে থাকে। যাত্রীরা যার যার অবস্থানে সর্তক অবস্থায় রয়েছে।

নিরাপত্তা বাহিনি বিস্ফোরক বহনকারিকে থামিয়ে দেয়। বড় ধরনের সাউন্ড বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বোমা বহনকারিকে কোপাঘাত করা হয়। কিন্তু কোনভাবেই বোমাটি নিষ্ক্রিয় করা যাচ্ছে না। রীতিমত চেকপোস্টের লাউন্সে জীবন্ত বিস্ফোরকটি দৌড়াদৌড়ি করছিল। এতে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফৌজ পজিশনে। নির্দেশ আসার সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্যখানে, এটি জীবন্ত বোমা, লক্ষ্যে গুলি ছুড়লে পাল্টা ধ্বংসযজ্ঞ বাড়বে। এই ধরণের বিস্ফোরক সর্ম্পকে পূর্বে তাদের কোনো ধারণাই নেই। এটি নিয়ন্ত্রণে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ ধরণের শব্দে এটি আরো এলোপাতাড়ি ছুটতে থাকে। অদূর থেকে ডিজিটাল ক্যামরায় ধারণকৃত দৃশ্য ইলোট্রমিডিয়ায় দেখাচ্ছিল। বহনকারীকে অজ্ঞান অবস্থায় একটি ট্রেতে উঠিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে চিকিৎসাকেন্দ্রের দিকে নিয়ে যেতে  দেখা যাচ্ছে। বহনকারীর পরনে হিজাব পরা দেখা যাচ্ছে। তাতে তার মুখ-মণ্ডল দেখা যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো ‘জঙ্গিগোষ্টি’র অপতৎপরতা। হয়তো প্যারিসে এ এয়ারপোর্ট উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

অবিশ্বাস্য এ ঘটনা। ইতিমধ্যে কয়েকটিও রাষ্ট্রে এমন নাশকতামুলক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ বিস্ফোরক পরীক্ষা করার মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্ভবত দেশটিতে নেই। দেশটির রাষ্ট্রিয় বিস্ফোরকদল অনেকটা বোকা বনে গেছে। কোনো সিদ্ধান্ত দিতেই পারছে না। র্স্পশ করলেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে এমন আতঙ্ক বিরাজ করছে।

জীবন্ত বিস্ফোরকটি অবিকল দেখতে প্রাণী সাদৃশ্য। যেন ছোটখাটো উট পাখি। সামনের অংশ মুখ থেকে ঝোলা এবং পেছেনের দিক পালকশূন্য। শুধু ডানায় হালকা হালকা কিছু পালক আছে।  

ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা বিভাগ দিশাহারা। তারা কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তারা মিত্রশক্তির সহযোগিতা কামনা করছে। বিশ্বের সব চাইতে প্রতাবশালী দেশ আমেরিকার পেন্টাগনের সাহয্য চাইলো। বিজ্ঞানিগণ বিকাশমান প্রযুক্তির কাছে প্রতিনিয়ত সংশয়ের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। একের পর এক নতুন আবিষ্কারের স্বাক্ষর রেখে চললেও বিস্ফোরকটি আদৌ কী তারা সনাক্ত করতে হিমসিম খাচ্ছে। খুবই দ্রুতগতিতে পেন্টাগনের একটি উচ্চ ক্ষামতাসম্পন্নদল ছুটে এলো। দলটি প্রথমে বস্তুটির গতিবিধি দেখলো। তারাও ঘাবড়ে গেল। প্রথম থেকে এমন সংশয় সবার স্নায়ূচাপ বেড়ে গেল। আপাতত একটি লোহার খাঁচায় বন্ধী করা হলো। প্রবাহমান রক্তের মধ্যে বিস্ফোরক জাতীয় অতিকায়ক ক্ষুদ্রকণা লুকায়িত রয়েছে কী-না, কোনটিই স্পষ্ট নয়।     

দলটিও সিদ্ধান্ত প্রকাশে অপারগতা জানায়। তারা হাইলি ল্যাবলেটরি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে চায় এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে যা করার তা করবে, ছাড়পত্র পেলেই তাদের দেশে নিয়ে যাবে।

এদিকে নিরাপক্তা বাহিনীর হাতে আটক নারীর ছবি বার বার ইলেট্রোমিডিয়ার স্কীনে দেখানো হচ্ছে। তখনো নারীটির জ্ঞান ফিরেনি। সরকারী এক হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। হাসপাতালটিরও সম্ভাব্য স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে, হামলা বা দূর্ঘটনা এড়াতে।

লিমন মণ্ডল নিশ্চিত ধরে নিয়েছেন, এ নারী তার মা হবেন। কিন্তু তার মায়ের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর এমন আচরণ কেন, তিনি হিসাব মিলাতে পারছেন না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, নিজের আত্মীয় পরিচয় দিতেও ভয় পাচ্ছেন, কখন নিজেকে না আবার হেনস্তা হতে হয়! এ ব্যাপারে তার হবু স্ত্রীর সহযোগিতা চাইলেন। থ্রীয়া নিজেতো ফ্রান্সের নাগরিক। রাষ্ট্রিয় অনেক কিছু তার জন্য সহজ। তিনি পরামর্শ দিলেন, আড়ালে না থেকে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদর দপ্তরে দেখা করার জন্য। এমনিতে এ যাত্রীর দেশ এবং ইমিগ্রেশন বিভাগের খোঁজ-খবর নেবে আইনশৃঙ্খলা বিভাগ। তখন উল্টো সমস্যায় পড়তে হবে। বরং, স্বশরীরে গিয়ে মায়ের সহজ-সরলতা এবং গ্রাম্য আচার-কৃষ্টির কথা জানালে বিশেষ বিবেচনায় সহযোগিতা পাওয়া যাবে। হবু স্ত্রী থ্রীয়ার যুক্তি তার পছন্দ হলো। তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন সঙ্গে তাকে নেবেন। থ্রীয়াও তাকে সব প্রকার সহযোগিতার করার আশ্বাস দিলেন।  

প্যান্টাগণের বিশেষজ্ঞগণ খুবই গুরুত্বসহকারে দেখছিল বস্তুটিকে। তারাও রক্ত সঞ্চালনসহ দেহের কাঠামো উপ-কাঠামো এং গঠনপ্রণালী পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি চক তৈরি করে। তারা বহনকারীরও খোঁজ-খবর নিল। দেশটির সর্ম্পকেও জানতে চাইলো। তারা এ-ও জানতে পারলো, এটি এশিয়ার একটি দেশ এং অবিভক্ত ভারতবর্ষের একটি রাজ্য। অবশ্য এখন এটি স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। তবে সংস্কৃতি ও কৃষ্টি  কিছুটা ভারতীয় আচরণে বেষ্টিত। ভৌগলিকগত অঞ্চলটির মানুষ স্বল্পাহারী। ভেজিটেবল, আমিষ ও শর্করাজাতীয় খাদ্যসহ মাত্রারিক্ত মসল্লাভোগী। তার সঙ্গে তারা গৃহস্থালী যতসব উৎপাদন এবং প্রাণী লালন-পালন করে।

এসব তাদের প্রাণের মতো-সন্তানতুল্য। সর্বত্র এসবের বিরজমান। কোথাও কোথাও প্রাণীকুলকে দেবতুল্য এবং জননী হিসেবে সম্মোধন করে। তবে অঞ্চলে ভেদে মতভেদও আছে। হামেশা এ নিয়ে রক্তক্ষয়ী হাঙ্গামাও হয়। মুহূর্তে উত্থাল, মুহূর্তে শান্ত। তবে তারা অতি মানবিকও। পুরনো আচার-প্রথা মেনে চলে। 

আপাতত তারা যে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে, তাতে দেখা যায় এটি গৃহস্থালী প্রাণী। বৃদ্ধা সন্তানের কাছে আসতে গিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। প্রাণীটির মুল্য খুব বেশি নয়। তাতেও তিনি সেইটি রেখে আসেননি। অতি প্রিয় এবং ভালোবাসার টানে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। প্রণীটি সংশ্লিষ্ট দেশ ও দিল্লিরও নজরে পড়ে। তারাও বিষয়টি এভাবে দেখেই গমনে ছাড়পত্র দেয়।   

এতসব ব্যাখ্যার পরও সহজভাবে মেনে নিতে পারছেনা পেন্টাগন। তারা আরও পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালাতে চায়। তারা তাদের দেশের অবসরপ্রাপ্ত এক বিজ্ঞানিকে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি না কী এ যাবতকালের সব আবিষ্কারকদের একজন। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ। তার নাম উলিয়াম আব্রাম।

বিশেষ ব্যবস্থায় তার আগমন। বয়সেও ন্যূজ এ বিজ্ঞানি। যবুথবু-থুতথুরিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। সবাই নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এ বিজ্ঞানি নিজের শরীর নিজে বহন করতেও অক্ষম। তিনি কী বা পরীক্ষা করবেন। তিনি হাত উঁচিয়ে দেখালেন। তারপর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘বের করো ওটি।’

সঙ্গে সঙ্গে বস্তুটি ‘কিক্ কিক্’ শব্দে ডেকে টেবিলে হাঁটাচলা করতে লাগল। একটু অপেক্ষা করে তিনি এগিয়ে গেলেন।

ইনস্টিটিউটের সব কর্মকর্তারা বিশেষ সর্তক অবস্থায রয়েছে। প্রতিটি কক্ষে বিশেষ ব্যবস্থায় দৃশ্যটি অবলোকন করছিলেন। তার সঙ্গে কয়েকটি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করছিল। দেশব্যাপী নয়, বিশ্বব্যাপীও তা নিয়ে কৌতুহলের কমতি নেই। 

উলিয়াম নীল আব্রাম বস্তুটি হাতে উটিয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের উপরি অংশের সরু পাতাতে চিমটিকেটে ছেড়ে দেয়, দেখলেন প্রাণীর মতো রেসপন্স করছে কিনা? তিনি কিছুটা আশ্বস্ত। তারপর একটি ক্ষুদ্র পিন দিয়ে ওই অংশে বিঁধলেন। সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোটা রক্ত বের হয়ে এল। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বস্তুটিকে ছুড়ে দিয়ে বলে উঠলেন-

ছোটগল্প।

কেএনইউ/ এসএইচ/

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি