‘কিছু গল্প অবাঙমুখ’ এর বাঙময় পাঠ-অনুভূতি
প্রকাশিত : ১৭:২৫, ১০ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ২১:৩৮, ১০ অক্টোবর ২০১৮
বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী বিভাগ হলো ছোটগল্প। যুগে যুগে কত শত সহস্র গল্প কতভাবেই না বলা হয়েছে তবু ছোটগল্পের আবেদন ফুরায়নি। ফুরাবেও না আশা করা যায়। ক্ষুদ্র বা ছোট পরিসরের মধ্যে জীবনের সবচেয়ে গভীর ও নিগুঢ়তম অনুভূতির ব্যাপ্তি এই ছোটগল্পের মাধ্যমেই পাওয়া যায় বলেই হয়তো ছোটগল্পের আবেদন শাশ্বত।
সমকালীন গল্পকারদের মধ্যে অনেকেই বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এই শাখাটিতে প্রগাঢ় নিষ্ঠা ও বিপুল গৌরবের সাথে বিচরণ করছেন। তাদের সহযাত্রী হিসেবে পথচলার আত্মপ্রত্যয়ে গল্পকার নিবেদিতা আইচের প্রথম গল্পগ্রন্থ `কিছু গল্প অবাঙমুখ` প্রকাশিত হয়েছে সদ্য প্রকাশনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা ‘পেন্সিল পাবলিকেশন্স’ থেকে।
এই গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় গল্পকার বলেছেন, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন, ঘাত-প্রতিঘাতে জীবনের পর্যুদস্ত গল্পেরা কথকের মুখে অস্ফুটে উচ্চারিত হয় বলে এই গ্রন্থের গল্পগুলো অবাঙমুখ। তবে আমার আমার কাছে এক কথায় বইটি পাঠের অনুভূতি হলো, জীবনের বহুমাত্রিকতার গল্প বারবার বাঙময় হয়ে উঠেছে গল্পকার নিবেদিতা আইচের এই গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বইটি পাঠের অনুভূতি জানানোর তাগিদ অনুভব করছি।
নিবেদিতা আইচ
পার্থিব জীবনের চিরচেনা নিক্তিতে যেসব অনুভূতির সূক্ষ্মতা পরিমাপ করা দুষ্কর সেসব অনুভূতির গল্প খুঁজে পাই কিছু গল্প অবাঙমুখে। বিশেষ করে এই বইয়ের `আমাদের পুরনো ছাদ` গল্পটি পাঠকের মনোজগতকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করবে। নিঃসন্দেহে এই গল্পটি এই বইয়ের অন্যতম সেরা গল্প।
বাঁকা হতে হতে আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে তবু আমাদের কোনোদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের মৃত স্বপ্নের মাঝে আমরা সাড়হীন বিকলাঙ্গ প্রাণির মতো পড়ে আছি। স্বপ্ন আর আলোহীন জীবন মৃত্যুরই নামান্তর। একসময় আমাদের একটা ছাদ ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিল, এখন আমরা আমাদের পুরনো ছাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগে ভুগে স্বপ্ন ছোঁয়ার সকল সাধ বিসর্জন দিয়ে কোমর বাঁকা করে হাঁটি। এই গল্পগ্রন্থের রূপকাশ্রিত গল্প ` আমাদের পুরনো ছাদ` গল্পটি খুব আটপৌরে ভাষায় শুরু হলেও ক্রমে ক্রমে তা গোটা বাংলাদেশের রূপ ধারণ করে বৃহৎ একটি গল্প হয়ে উঠেছে। এই গল্পের সমাপ্তিতে মনের ভেতরে একটি প্রশ্নের গুঞ্জন চলতেই থাকে-আমি বা আমরা কি সত্যিই মেরুদণ্ডহীন? এখানেই হয়তো গল্পকারের সার্থকতা।
পত্রসাহিত্য বরাবর বুকের ভেতরে ঢেউয়ের তোলপাড় তোলে, স্মৃতিকাতর করে। আবলুশের দেরাজে বন্দি একটি চিঠি আর বইয়ের ভাঁজ থেকে পনেরো বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া একটি চিঠি-এই দুটি চিঠি নিয়ে দুজন মানুষের গল্প `অকালবোধন।` যখন বাতিঘরকে সম্বোধন করে ছন্দার চিঠি পড়ছি তখন ক্যাফে রোজ্জোতে ম্লানমুখে অপেক্ষারত একটি মায়াবী মুখের জন্য বুকের ভেতরে মুচড়ে উঠেছে। আবার মধুছন্দার চিঠির জবাবে এত বছর পর বাতিঘরের যে প্রতিউত্তর এলো সেই চিঠির গন্তব্যহীনতা একইভাবে তোলপাড় তুলেছে বুকের ভেতর।
`পাপস্নান` গল্পটি শুরু হয়েছে আমাদের খুব চেনা একটি চরিত্রের দিনলিপির বর্ণনা দিয়ে। মেসে রান্না আর ফ্লাটবাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে সুফিয়া। একদিন ও কাজে গেলে ওর নয় বছরের মেয়ে আদুরিকে ধর্ষণ করে নরপশুর দল। পুলিশী হাঙ্গামা এড়াতে বস্তির মালিক এরপর ঘর ছাড়তে বলে মা-মেয়েকে। মেয়ের নিরাপত্তার চিন্তা আর ট্রাকচালক নেশাখোর স্বামীর নির্লজ্জ নিষ্ঠুরতায় দিশেহারা সুফিয়া পাপস্নানে সিক্ত হয়ে নিজের আর নিজের সন্তানের জন্য আলো খোঁজে। বাস্তবতার নিরিখে নির্মিত এই গল্পটি বেশ পরিণত।
সাদিয়া সুলতানা
অভাবের সাথে কি ভাগ্য বিড়ম্বনার নিগুঢ় কোনো সংযোগ আছে? গল্পকার যখন লেখেন, `দুলি এত শক্ত শক্ত কথা মনে রাখতে পারে না। রোগের যত নামই হোক না কেন গরীবের জন্য সবই এক আর তা হলো ওই জঠর যাতনা। দুলি তাই এসব মনে রাখে না। ডাক্তার বলে খালি পেটে অমুক ওষুধ আর ভরাপেটে তমুক খেতে হবে, দুলি ভাবে তাদের আবার ভরাপেট আর খালিপেট! এমন কোনো ওষুধ কি আছে যাতে এই ক্ষুধা তৃষ্ণা মিটে যাবে আজীবনের জন্য?’ তখন নিষ্ঠুর ছকে বাঁধা জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম গল্পের আভাস পাই। বানের পানির দুর্ভোগের সাথে চিত্রিত সন্তানসম্ভবা দুলিকে নিয়ে লেখা `বান` গল্পটি ভালো লাগার বোধের চেয়ে মনে বিষাদের বান উসকে দেয়।
দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার মনস্তত্ত্ব নিয়ে লেখা `দ্বিতীয় জন্ম` গল্পটি ঠিক নিটোল প্রেমের গল্প না। যদিও একজন প্রেমিকের নিপাট ভালোমানুষির গল্পও হয়ে উঠতে পারতো এটি। যা হয়তো অবাস্তবও মনে হতো পাঠকের কাছে। যৌন হয়রানি নিয়ে লেখা এই গল্পটি প্লট সাজানোর দক্ষতার কারণে শেষ পর্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়েছি।
`নির্জনার অহর্নিশ` গল্পের ছকটি খুব চেনা। ভাগ্যবিবর্জিতা নারী বিভার জীবনের নানা সংকটের মাঝে হুট করে উঁকি দেয়া ভাগ্যরেখাটি পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে মামুলি মনে হলেও পিতাকে অবলম্বন করে সন্তানসুখে বিভোর বিভার গল্পটি পাঠক হিসেবে আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে।
মুক্তিযোদ্ধা আবিদের ডানহাতের তিনটে আঙুল আর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচ কেটে ফেলতে হয়েছিল। লড়াকু আবিদ তবু বেঁচে ছিল। আবিদের পত্রমিতা রিনা। রিনার জন্য বুকপকেটে আবিদের চিঠি নিয়ে যায় গল্পকথক। সেই চিঠি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধদিনের খণ্ডচিত্র। চিঠিটি পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসে, মনের মাঝে কিছু প্রশ্ন উঁকি দেয়। জীবনভর আমরাও এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরি। রিনা, আবিদ বা গল্পকথকের কাছেও হয়তো সেসব প্রশ্নের অজানা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প `বুকপকেটে মৌসন্ধ্যা` এই বইয়ের একটি শক্তিশালী গল্প। যুদ্ধোত্তর কালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গল্প লেখার মতো কঠিন কাজটি দক্ষতার সাথেই করেছেন লেখক।
`ক্যানভাস আর নিকোটিনের গল্প` গল্পটির ক্যানভাস ছোট কিন্তু ব্যাপ্তি বড়। `পাণ্ডুলিপি` গল্পটির গল্প ছাপিয়ে গেছে গল্পটিতে ব্যবহৃত কবিতার সৌন্দর্য। তাই এই গল্পটি দারুণ একটা গল্প হবার আশা জাগিয়েও দপ করে নিভে গেছে। এই গল্পটি ছাড়াও `মৃত নদীর জীবন`, `মমতাজ মহল` গল্প দুটোতে লেখকের আরেকটু সময় নেয়া জরুরি ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।
পরিশেষে নতুন প্রকাশনী ‘পেন্সিল পাবলিকেশন্স’ এর সকল শুভ উদ্যোগের জন্য শুভকামনা রইল এবং যেই বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে `কিছু গল্প অবাঙমুখে`র মাধ্যমে গল্পকার নিবেদিতা আইচের যাত্রা শুরু হলো তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক সেই স্নেহাশীর্বাদ রইল।
গল্পগন্থ `কিছু গল্প অবাঙমুখ`
গল্পকার `নিবেদিতা আইচ`
প্রকাশনী-পেন্সিল পাবলিকেশন্স
টিআর/