ঢাকা, রবিবার   ০১ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্লেড

প্রকাশিত : ২০:০৩, ৭ মার্চ ২০১৯ | আপডেট: ২০:০৯, ৭ মার্চ ২০১৯

আমি আত্মহত্যা করব। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে কথাটি বলে এক সেকেন্ড দম নিল মেয়েটি। ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আগে বলল, ‘‘ম্যাসেঞ্জারে এসো। একটা জিনিস দেখাবো।’’

ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে মেয়েটি একটি ছবি পাঠিয়েছে। ওর হাতের তালুতে চকচক করছে ব্লেড। স্মার্টফোনের ক্যামেরার ফ্লাশের আলো পড়ায় ব্লেডের উপর থাকা লেখা পড়া যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে না কোন কোম্পানীর ব্লেড এটি।

প্রেমিক ছেলেটির চোখ গেল মেয়েটির চমৎকার আঙুলের দিকে। কী সুন্দর! আঙুলের মাথায় লম্বা হয়ে থাকা নখগুলোও আকর্ষণীয়। অনিন্দ সুন্দরী মেয়েটি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে, ভাবতেই ওর শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসল। প্রচন্ড পানির পিপাসা পাচ্ছে। মুহুর্তেই ভিজে উঠল দু’চোখ। বিগত দিনে দু`জনের একসাথে কাটানো মধুর সময়গুলো মনে পড়ছে।

দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি নিয়ে প্রেমিক ছেলেটি দ্রুত টাইপ করল- ‘‘পাগলামো বন্ধ করো সোনা। প্লিজ। দরকার হলে আমি চুপ হয়ে যাব, তাও এমন বোকামো করো না। নিজের সামান্য ক্ষতিও করোনা। এ জীবন অনেক মূল্যবান। একদম ভুল করা যাবে না। মৃত্যুই সবকিছুর সমাধান নয় সোনা।‘’

: জানি না প্রিয়তম। এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নাই। তোমাকে বিয়ে করলে মা-বাবা ভীষণ কষ্ট পাবেন। তাঁদের মান সম্মানের প্রশ্ন। অন্য কাউকে বিয়ে করলে তুমি সারাজীবন কষ্টে ভুগবে। আমি এসব মানতে পারব না। এসবের চেয়ে আমার মরে যাওয়াই ভাল। কেন যে আমরা একই ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্মালাম না জান?

- তাই বলে মরে যেতে হবে? এত বোকা তো ভাবি নি তোমাকে। পৃথিবীতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা বিয়ে করছে না? আমরাই কি প্রথম? আমাদের দেশেই কি এমন বিয়ে হয়নি আগে?

: পারব না। একদম পারব না। তোমাকে বিয়ে করলে মা-বাবা কষ্টে-অপমানে হয়তো মরেই যাবেন। ছোট ভাই-বোনগুলোর বিয়েতে সমস্যা হবে।

- বোকার মতো কথা বলো না তো সোনা। তুমি আত্মহত্যা করলে তারা কষ্ট পাবে না? সম্মান যাবে না? কোনো সমস্যা হবে না? এরচেয়ে বরং চলো- সবাইকে ম্যানেজ করে বিয়েটা করে ফেলি।

‌: পারব না আমি। তোমাকে বিয়ে করলে মা-বাবা অখুশি। অন্য কাউকে বিয়ে করলে তুমি সহ্য করতে পারবে না। বিয়ে না করেও উপায় নেই, এই সমাজ উল্টাপাল্টা কথা শুনাতে ছাড়বে না। আমার হয়েছে জ্বালা। তারচেয়ে মরে যাই।

- চুপ করো তো। প্লিজ।

: হুম। চুপ হয়ে যাব একদম। পঞ্জিকায় দেখলাম আজ রাত তিনটা থেকে একটা ভাল লগ্ন শুরু হচ্ছে। এ সময় মৃত্যু হওয়া নাকি ভাল।

মেয়েটির অমন কথা শুনে প্রেমিক ছেলেটি না হেসে পারল না। ধর্মভীরু মেয়েরা বুঝি আত্মহত্যা করতেও লোকনাথ পঞ্জিকা দেখে! অথচ সে ভালই জানে, আত্মহত্যা মহাপাপ। সব ধর্মই এ কথা বলে। ভাল ক্ষণ দেখে কেউ নরকে যেতে চায়!

ছেলেটি দুষ্টুমি করার চেষ্টা করে- ``আত্মহত্যাকারীরা স্বর্গের কোন স্তরে থাকবে, এমন কিছু পঞ্জিকায় লেখা আছে সোনা! আমাকে পড়ে শোনাও না! তোমাকে ফোন করি। বল আমাকে।``

: না। ফোন করো না। শোনো, আমি ফান করছি না। সত্যিই মরে যাব। ছবি দেখে কিছু বুঝতে পারছ না? আমি কি করতে যাচ্ছি মাথায় ঢুকেছে?

- হুম। ঢুকেছে। ভয়ানকভাবে ঢুকেছে।

: মন খারাপ করো না জান। পরপারে দেখা হবে। এ পৃথিবীতে তো তোমাকে পেলাম না। পরপারে যদি ...

- আসলে আমি ভাবছি দুনিয়ার কথা। তোমার আঙুল আর নখের কথা।

: মরার আগে নখ নিয়ে ভেবে কি হবে। স্যরি, তুমি গত সপ্তায় বলার পরও কাটি নি। জানোই তো, নখ বড় রাখতে আমার ভাল লাগে। প্লিজ, শেষ সময়ে এটা নিয়ে ঝগড়া করো না প্রিয়তম। আমাকে শান্তিতে মরতে দাও?

- বকবো কেন? বললাম না, তোমার আঙুল আর নখ নিয়ে ভাবছি?

: কি ভাবছ জান?

- ভাবছি, জন্মের পর তোমার এই সুন্দর আঙুলগুলো কত নরমই না ছিল।

: হুম।

-জন্মের সময় তো হাত-পায়ের আঙুলে নখও থাকে। মায়েরা কত সতর্কতার সাথে সন্তানের নখ কেটে দেন। সামান্য ভুলে না আবার কলিজার টুকরা সন্তানের আঙুলের চামরা কেটে যায়, খুব ভয়ে থাকেন তারা।
মায়েরা দিনে অসংখ্যবার সন্তানের নরম আঙুলগুলোয় চুমু খান। বাবারাও। এমন পরিস্থিতি দিয়ে গেছেন তোমার মা, আমার মা। গ্রামে নিজ বাড়ির আঁতুরঘরে সন্তান জন্ম দেওয়া সকল মায়েরই এই অভিজ্ঞতা আছে। তাই না?

: হুম। ঠিক।

- ব্লেড দেখে আরেকটা বিষয় মনে পড়ল। বলব?

: বল জান।

- জন্মের সময় হয়তো এমনই কোনো ব্লেড দিয়ে তোমার-আমার নাড়ি কেটেছিলেন গ্রামের ধাত্রী! বলাকা নাকি অন্যকোনো নামের ব্লেড ছিল ওগুলো, কে জানে!

: মানে? এখন বুঝি দুষ্টুমির মুড এলো তোমার?

- খেয়াল করেছো, মায়েরা সন্তান পেটে ধরা থেকে শুরু করে জন্মদান ও লালন-পালনে কত কষ্ট করেন। স্বাভাবিক ডেলিভারীর মাধ্যমে সন্তান জন্মদানে অভিজ্ঞ মায়ের কাছে প্রশ্ন করলে জানতে পারবে, এ অভিজ্ঞতা কত কষ্টকর। মাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তার কলিজায় লাথি মেরে তবেই আমরা পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম কি না! ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া মায়ের এই কষ্টের কোনো তুলনা হয়?

: না, হয় না। কিন্তু হঠাৎ এসব বলছ কেনো জান?

- কারণ আছে বৈ কি। প্রেমের মানুষটিকে পাওয়া-না পাওয়ার দোলাচলে কষ্ট পেয়ে জন্মদাত্রী মায়ের মুখটি একবার খেয়াল করছ না। তার ছবিটা একবার চোখ বুঝে দেখছ না। মরতে চাচ্ছো। তুমি সত্যি এমন করলে তাঁর কি হবে ভেবেছো একবার?

খেয়াল করে দেখেছো, নাড়িছেঁড়া ধন সন্তানকে নিয়ে মায়েরা কত কষ্ট স্বীকার করেন? শোনো, সন্তান বড় হয়ে গেলেও মায়েরা তাদের নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তায় থাকেন। আমার ধারণা, তোমাকে নিয়েও তোমার মা এভাবে সারাক্ষণ ভাবেন।

: মায়ের কথা বলে মনটা অন্যরকম করে দিলে জান। তুমি এত ভাল কেন বল তো! এমন করে কথাবার্তা বলো বলেই কি না তোমার ওপর কঠিন হতে পারি না। নইলে কবেই প্রেমটাকে কবর দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলতাম!

- করে নাও।

: পারছি কই?

- হুম। ‘এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে...’!
‘শত্রু তুমি, বন্ধু তুমি/ তুমি আমার সাধনা...’!

: ঢং! এই শোনো। ব্লেডটা দিয়ে একটা কাজ করব। প্লিজ বকো না যেন?

- কি কাজ সোনা?

: তোমার নাম লিখব।

- কোথায়?

: বামহাতে।

- পাগল নাকি তুমি! এই শোনো, হাত কেটে নাম লেখার দরকার নেই। হৃদয়ে লিখেছো, এ-ই আমার পরম পাওয়া, ওটা মুছতে দিও না।

: তোমার কথার জবাব নেই জান।

- শোনো, ব্লেড দিয়ে হাত-পা কাটলে ইনফেকশন হতে পারে। তারচেয়ে এটা দিয়ে লম্বা নখগুলো কেটে ফেল। চাইলে ব্লেডের অন্য ব্যবহারও করতে পারো!

: যেমন?

- এই যেমন আমি শেভ করি। গোঁফ-দাড়ি কাটি!

: দুষ্টু কোথাকার! এই তুমি আমাকে হাসালে কেন? আজ আর কথা বলব না! ঘুমাবো। শুভরাত্রি।

- শুভরাত্রি! সুপ্রভাত জানানোর জন্য ভোরে ওঠো কিন্তু।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি