গতরাত
প্রকাশিত : ১৯:৫১, ৫ মে ২০১৯
সন্ধ্যা থেকেই আকাশে পূর্ণ চাঁদ। আজ মনে হয় পূর্ণিমা অথবা নয়। এ সব নিয়ে মাথা ঘামায় না কিবরিয়া। ও হাঁটছে ক্ষণিক আকাশের দিকে চেয়ে আবার ক্ষণিক হাটছে রাস্তা দিকে চেয়ে। আধা গ্রাম আধা শহরের রাস্তা। আজ প্রায় ছয় মাস পরে ও বাড়ির পথে। নিজের কাছে বেশ ভালই লাগছে। বরিশালের মেহেদীগঞ্জে বাড়ি ওর। নদীর মায়ার কোমলতা দিয়ে ঘেরা ছোট্ট এক শহর। কিবরিয়া চলছে বহুদিন পর বাড়ি ফেরার আনন্দ নিয়ে। বহুদিন বাদে পরিবার, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা হবে ওর।
উল্টো পথ দিয়ে এগিয়ে আসছিল রিফাত। ইলেকট্রিসিটির আলো ও চাঁদের ঈর্ষাৎ আভায় ওকে অনেক রোগা মনে হচ্ছে। কাছে আসতেই কিবরিয়া ওকে ডাকলো, ‘রিফাত।’
হঠাৎ কিবরিয়াকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠে রিফাত বলল, ‘কিবরিয়া, কখন এলি তুই?’
-‘এইতো মাত্র আসলাম।’
-‘কোথা থেকে আসলি?’
-‘কোথা থেকে আবার? কুমিল্লা থেকে।’
-‘কয়দিনের জন্য আসলি এবার।’
-‘এইতো দিন বিশেকের জন্য। আরে আমার কথা বাদ দে। শাহীন, সাদি, সেলিম ওদের খবর কি?’
-‘এই ভালই আছে ওরা। তোকে খুব মিস করিরে বন্ধু।’
-‘তোরা কি এখনও নেশা করস?’ করুণ নয়নে চেয়ে প্রশ্ন করল কিবরিয়া।
-‘এটা একবার ধরলে আর ছাড়া যায় না। ছাড়তে চাইলেও ছাড়া যায় না বন্ধু।’
-‘কই যাস এখন?’
-‘বাজারের দিকে যাব একটু।’
-‘তোরা তো এখন বাজারেই থাকবি না?’
-‘হ্যাঁ থাকব।’
-‘আচ্ছা তাহলে আমি বাড়িতে গিয়ে এখনই আসছি।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
রিফাত, কিবরিয়া, শাহীন, সাদি ও সেলিম ওরা সেই ছেলেবেলাকার বন্ধু। ওরা একে অপরের কত্ত কাছাকাছি। মাধ্যমিক থেকে ওদের এক সাথে পড়াশুনা। তবে সবার এক সাথে এসএসসিটা পাশ করা হয়নি। সাদি আর কিবরিয়া এসএসসি পাশ করেছে, কিবরিয়া এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আর দুইবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সাদি এখন এলাকার কলেজে ডিগ্রি পড়ে। আর রিফাত, শাহীন, সেলিমের এসএসসি পাশ করা হয়েছে দুই-তিনবারে। তারপর কলেজ পর্যন্ত এসে আর পড়া হয়নি। এখন ওদের দিন কাটে বাপের হোটেলে খেয়ে, অশান্তিতে। কোন এক পাপ যেন তাদের জীবনটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ওদের কাছে এখন জীবন মানেই অস্বস্তি আর হতাশা। একটা অুনশোচনায় ওরা আটকে আছে যেন। একটা পাপের পরবর্তী ফল হিসেবে ওদের দিন কাটে এখন মদ-সিগারেট-গাজা আর অশান্ত মনের শান্তির জন্য টাকার বিনিময়ে নারী। ওদের থেকে সবচেয়ে ভালো আছে কিবরিয়া। ওদের ভিতর কিবরিয়া এখন আদর্শ। কিবরিয়া জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সম্মানজনকভাবে কাজে লাগিয়েছে।
হাতে ব্যাটারির টর্চ নিয়ে কিবরিয়া ঘর থেকে বের হল। টর্চের ক্লান্ত আলো রাস্তায় ফেলে বাজারের দিকে যাচ্ছে ও। রাত ৮টা এখন। ছোট মফস্বলের ধারা বাহিত চুনারচর গ্রাম। হালকা করে শহুরে ছোঁয়া মাখা গ্রাম। রাতের প্রথম প্রহরে টুনটুন বেল বাজিয়ে রিকশা চলছে দু-একটা। রিকসার নিচে হারিকেনের ভিতরের সলতের মিটমিট আলোটা যেন বাতাসের সাথে প্রতিযোগীতায় দুলছে। ঝাকুনিতে কাঁপছে আলোটা।
কিবরিয়া এসে গেছে তার চিরচেনা বাজারের খুব কাছে। আর মিনিট খানেক লাগবে। সামনের মোড়টা ঘুরলেই ওদের ছোট্ট বাজার। বাজারের প্রথম চায়ের দোকানটি আবুল হোসের ভাইয়ের। ওখানে বসেছিল রিফাত, শাহীন, সাদি, সেলিম। এ চারজন কাস্টমার বাদে অন্য কাউকে দেখতে পেল না কিবরিয়া। কিবরিয়াকে দেখতে পেয়ে শাহীন, সাদি ও সেলিম ওকে জড়িয়ে ধরল। বহুদিন পর বন্ধুকে কাছে পাওয়া বলে কথা। বন্ধুদের অভিনন্দনের পালা শেষ হতে মিনিট দুয়েকের মত সময় লাগল। দোকানের মালিক আবুল হোসেন মুখ তুলে কিবরিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে আইলা কিবরিয়া?’
-‘এইতো সন্ধ্যায়, তো কেমন আছো আবুল ভাই?’
-‘আমাগো আর থাহা।’
-‘আরে এ কথা বলছ কেন? তোমরাও দেশের সম্পদ যে।’
আবুল হোসেন মুখে একটা মুচকি হাসি তুললো। কিবরিয়া ওদেরকে তাড়া দিল, ‘কিরে তোরা কি এখানে বসে থাকবি? ওঠ।’
কিবরিয়ার তাড়া খেয়ে ওরা আবুল হোসেনের চায়ের দোকান থেকে উঠল।
আবুল হোসেন কিবরিয়াকে বলল, ‘কিবরিয়া, চা খাইয়্যা যাও।’
-‘এখন না আবুল ভাই। পরে খাব। আছিতো অনেক দিন।’
ওরা পাঁচ বন্ধু হাটছে অন্ধকার রাস্তায়। এই অন্ধকার রাস্তায় হাটার স্বভাব ওদের বহু পুরোনো। বাড়িতে আসলে কিবরিয়া এটাকে খুব উপভোগ করে আর দূরে থাকলে এটার খুব অভাব বোধ করে। এই নিস্তব্ধ রাতে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের মাঝে অনেক না বলা কথার বিনিময় হয়। কিবরিয়া বাদে বাকি চার জন বদের হাড্ডি। মেয়েদের শরীরের প্রতি এই চারজনের লোভ অতিমাত্রায়। লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের গোসল, রাতে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে মেয়েদের শরীরে সিরিঞ্জ দিয়ে পানি দেওয়া, লাঠি দিয়ে কাপড় উলট-পালট করা এদের নিত্য দিনের স্বভাব। ভাবটা এমন যেন, মেয়েদের শরীর এরা আস্ত গিলে খাবে। কখনও এদের এ সব কাজে সঙ্গ দেয়নি কিবরিয়া। এভাবেই চলত ওদের ছেলেবেলা। অবশ্য ওদের চরিত্রে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। কোন একটা ঘটনা ওদের ব্যথা দেয় সব সময়।
-‘তো তোদের দিন কাল এখন কেমন যাচ্ছে?’ কিবরিয়া বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল।
একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রাফি বলল, ‘আমাদের আর দিন কাল।’
-‘আহা, নতুন করে আবার কি জীবন শুরু করা যায় না।?’
-‘শোন জ্ঞান দিবি না। ভাল লাগে না এইসব কথা শুনতে।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে আর বলব না। তবে তোরা কি আর এই নেশার পথ ছাড়বি না।?’
-‘আরে নেশা বলছিস কেন? এটা খুবই শান্তির মামা। এগুলো খেলে পারলেই না নিজেকে খুব ভালো মনে হয়।’ বহু কষ্টে কথা গুলো বলল সেলিম। ওর হাতে একটা দেশী মদের বোতল। তার অর্ধেক খালি। কখন থেকে ওটা হাতে নিয়ে অর্ধেক করে ফেলল তা মোটেও খেয়াল করেনি কিবরিয়া। দুলতে দুলতে হাঁটছে সেলিম। মদের বোতলটা নিতে গিয়েও নিল না কিবরিয়া।
-‘সে দিন রাতে কি যে করে বসলাম মামা। মাথা ঠিক ছিল না। মোটেও।’ সেলিম বলল। সাদি কিবরিয়াকে বলল, ‘জানিস কিবরিয়া, সে দিনের পর থেকে নিজেদেরকে পুরোপুরি খারাপ ছেলে মনে হচ্ছে। কিন্তু দেখ আগে কত আজে-বাজে কাজ করেছি, একটি বারের জন্যও খারাপ ছেলে মনে হয়নি নিজেদেরকে।’
২
কিবরিয়া রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। মাথার উপর সূর্য খাড়া হয়ে তেজ ছড়াচ্ছে সমানভাবে। মেঠ পথের দুই পাশে সুপারি আর আম বাগান। সুপারি গাছের লম্বা লম্বা সারির মাঝখানে ছায়া আর সূর্যের আলো খেলা করছে। বাতাসের তালে তালে গাছের ছায়াগুলো কাঁপছে। আম-সুপারির কালো এই বাগান থেকে বিরতিহীনভাবে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। বসন্তের মাঝামঝি এখন, প্রকৃতির কোলে বসন্ত পূর্ণতা লাভ করেছে যেন। কিবরিয়া রাস্তার মোড় ঘুরে বাম দিকের রাস্তায় চলল। এই মোড়ে রিফাতের সাথে দেখা হল কিবরিয়ার। কিবরিয়া ওকে ডাকল, ‘রিফাত, কৈ গেছিলি?’
-‘সিনেমা দেখতে গেছিলাম।’
কিবরিয়া অবাক হয়ে বলল, ‘তুই এখন সিনেমা দেখতে গেছিলি আর কয় দিন পর না আমাদের পরীক্ষা।’
-‘তো কি হয়েছে। পরিক্ষা দেব, তোর মত আমার এত পড়াশুনা করতে ভাল লাগে না।’
--‘আজ আমাদের আরও একটা পরীক্ষা হয়েছে। তোর আজ কোচিংয়ে যাওয়া উচিত ছিল।’
-‘ঠিক আছে কাল থেকে যাব বন্ধু, এবার আসি।’ বলে রিফাত দ্রুত হাঁটা ধরল। কিবরিয়া রিফাতের যাওয়া দেখল। কিবরিয়া ভাবল কি যে হল রিফাত, সেলিম, সাদি ও শাহীনের। পড়ালেখা করছে না তেমন। আর দুই মাস পর এসএসসি পরীক্ষা। ওরা কি পড়ালেখা কে জানে? কোচিংয়েও যায় না ঠিক মত।
বিকেল বেলা সূর্যের পড়ন্ত আলো নদীর পানিতে ঝলমল করছে। ঢেউয়ে পানির ঝলমল আরও সুন্দর লাগছে। বাতাসে কলমি লতাগুলো সাদা ফুল নিয়ে দুলছে। বাতাসে একটা শো শো শব্দ তুলছে। নদীর পাড়ে রাস্তার দুই ধারে বছরের পর বছর দাঁড়ানো লম্বা লম্বা তালগাছে ঝুলে পড়া শুকনো পাতা বাতাসের তোড়ে খস খস শব্দ করছে। সারা দিন অনেক পড়াশুনা করেছে কিবরিয়া। এখন ও মনোরম বাতাসে বেরিয়েছে, নদীর পাড়ের রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে বটতলার দিকে। ওখানে বন্ধুদের দেখা পাবে।
বটগাছের বড় কয়েকটা শিকড়ের উপর বসে গল্প করছে সেলিম, রিফাত, সাদি ও শাহীন। এক এক জন বট গাছের বিশাল গোড়ার এক এক প্রান্তে বসে গল্প করছে আর হাসছে ইচ্ছা মত। কিবরিয়াকে আসতে দেখে শাহীন বলল, ‘ঐ যে দেখ আমাদের বিদ্বান বন্ধু জনাব আইনস্টাইন আইতাছে।’
শাহীনের কথায় বাকীরা কিবরিয়ার দিকে ফিরে তাকালো। কিবরিয়া ওদের কাছে এসে বলল, ‘কি ব্যাপার তোদের, আমাকে রেখে তোরা আগে আগে এসে বসেছিস?’
কেউ কোন উত্তর না করে একযোগে হেসে ওঠল। হাসতে হাসতে সেলিম বলল, ‘তোমার আবার কি বন্ধু, তুমি তো সারাদিন খালি পড়ো। এত পড়াশুনা করে কি হবে শুনি?’
-‘পড়াশুনা করে কি হবে মানে। পরীক্ষা শুরু হতে আর মাত্র দুই মাস বাকী।’
-‘জানি, জানি। তোর বলতে হবে না।’ শাহীন বলল।
কিবরিয়া ওদের জিজ্ঞাসা করল, ‘তো তোদের পড়াশুনার কি খবর বল।’
সাদি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এ থাম, থাম। এত পড়াশুনার কথা শুনতে ভাল লাগে না। তার চেয়ে বরং শাহীন আজ একটা অভিযান করেছে, সে কথা শোন মজা পাবি।’
কিবরিয়া একটা শিকড়ের উপর বসতে বসতে বলল, ‘কি অভিযান?’
রিফাত বলল, ‘আরে মামা জব্বর অভিযান। আজ দুপুরে শাহীন মিয়া বাড়ির পুকুরে খরাব দেখছে।’
-‘আমি এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।’ কিবরিয়া বলল।
সাদি রিফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ও তোমার তো আর এ সব মাথায় ঢুকবে না। তো চাদু, শাহীন আজ মিয়া বাড়ির মেয়েদেরকে পুকুরে গোসল করার সময় ল্যাংটা দেখেছে।’ বলেই হো হো করে হেসে উঠল।
-‘তোরা এখনও এসব করে বেরাস?’ কিবরিয়া রেগে উঠে যেতেই রিফাত ওকে টেনে ধরল।
-‘আরে, দাঁড়া না মামা একটু বস।’
অনেক জোর করেই কিবরিয়াকে বসিয়ে রাখল ওরা।
শাহীন বলতে শুরু করল, ‘দুপুরে মিয়া বাড়ির বাগান দিয়ে যাচ্ছিলাম। বাগান দিয়ে যাওয়ার পথে শুনতে পেলাম কয়েকটা মেয়ে কথা বলছে। কথা বলছে আর হাসছে। বুঝতে পারলাম পাশের পুকুর ঘাট থেকে কথা আসছে। আমি ধীরে ধীরে পুকুর পাড়ে ঝোপের মধ্যে গিয়ে বসে পড়লাম। তাকিয়ে দেখলাম পুকুরের ওপারে ঘাটে সে কি অবস্থা, আমি তো শেষ। তিনটা মেয়ে গোসল করছে দুটার গায়ে জামা নেই। গামছা পেচিয়ে গায়ে সাবান মাখছে। কি কচি দেহ। নাদুস-নুদুস তাকি ভোল যায়।’ শাহীন চোখে এখনও দুপুরের সেই লালসা লেগে আছে।
কিবরিয়া আর বসতে পারল না ও উঠে বলল, ‘তোরা কি সারাদিন এমনই করবি। মোটেও ঠিক হবি না!’
কিবরিয়া রাগান্বিত হয়ে কথাগুলো বলে চলে যেতে পথ ধরল। পিছন থেকে সাদি ডাকল, ‘কিবরিয়া দাঁড়া, শোন, দাঁড়া।’
কিবরিয়া ওদের ডাক কানে না তুলে চলে গেল। ওরা আবারও বলতে শুরু করল। কথার মাঝে সেলিম বলল, ‘এ, শোন আজ আমি একটা জিনিস চুরি করেছি।’
সবাই সমস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি কি?’
-‘মেয়েরা জামার নিচে যে জামাটা পড়ে, তার নিচে আবার ছোট যেটা পড়ে সেটা। কি সেটার নাম বলতে পারিস।’ সেলিম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল।
সাদি বলল, ‘আমি জানি ওটার নাম...।’
রিফাত সেলিমকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথা থেকে চুরি করলি ওটা?’
সেলিম উত্তর করল, ‘আমার বাড়ির পাশের বাড়ি থেকে চুরি করেছি গতরাতে। গতরাতে পাশের বাড়ির মেয়েটি যে রুমে ঘুমায় সে রুমের জানালা খোলা ছিল। রাতে মেয়েটা ঘুমে ছিল। ওখানে জানালার পাশের আলনা থেকে চুরি করেছি।’
কিবরিয়া চিন্তা করছে, ওরা কি করছে এসব। কোন লেখাপড়া নেই। এভাবেই চলবে ওদের জীবন। কবে ভালো হবে ওরা। ততক্ষণে তো এরা বেশী দেরী করে ফেলবে। দিনের আলো নেই বললেই চলে। পশ্চিম আকাশে রং ধনু দেখা গল। পাখিরা কিবরিয়ার মাথার উপর দিয়ে যে যার ঠিকানায় যেতে লাগল। মাগরিবের আজানের ধ্বনি কিবরিয়ার কানে আসলে ও নদীর পানির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে উঠে চলল মসজিদের উদ্দেশ্যে।
৩
প্রায় আট-নয় মাস হল কিবরিয়াদের এসএসসি পরিক্ষা শেষ হয়েছে। এখন কিবরিয়া ঢাকার একটা কলেজে পড়ে। বন্ধুদের মাঝে শুধু কিবরিয়াই ঢাকায় পড়াশুনার জন্য এসেছে। কিবরিয়া এসএসসি পাশ করেছে ভাল রেজাল্ট পেয়ে। বাকিদের মধ্যে শুধু রিফাত পাশ করেছে টেনেটুনে। সাদি, শাহীন ও সেলিম ডাব্বা মেরেছে ভালভাবেই। তবে এ নিয়ে ওদের মাঝে কোন চিন্তা নেই। ওরা আছে আগের মতই।
গরমের এক রাতে সাদি, শাহীন, সেলিম, রিফাত রাস্তায় হাটছে আমোদের সাথে। বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কিছুক্ষন হল। সবাই মিলে এলাকার রাস্তায় রাস্তায় আড্ডাবাজি করছে। রাত বেশী হয় নাই, আবার কমও বলা যায় না। একটা বাজে এখন। হঠাৎ সাদি বলল, ‘আমাদের জীবনটাই দেখ। কি করলাম আর কিবরিয়া এখন ঢাকায় পড়ে।’
সেলিম বলল, ‘আরে শালায় একটা জিনিস। আর আমাদের মাথায় তো গোবর ছাড়া কিচ্ছু নাই।
-‘এ দেখ দেখ। সামনে কি আইতেছে।’ শাহীন কিছু একটা দেখিয়ে সকলকে বলল। সবাই সামনের দিকে তাকাল।
রাতটা তেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়। আবার তেমন চাঁদের আলোও নাই। পূর্ণিমার রাত নয় তবে পূর্ণিমার কাছাকাছি কিছুটা বলা যায়। সব কিছু স্পষ্টভাবে দেখা না গেলেও অনেকটা দেখা যায়। ওরা দেখল যে, একটা মাঝ বয়সি মহিলা আসছে ওদের দিকে। ত্রিশের কোটায় বয়স হবে হয়ত। মহিলাটা ওদের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো। ওদের কাছাকাছি আসলে ওদের কেউ মহিলাকে লক্ষ্য করে শিষ দিল। কিন্তু তাতে মহিলার দিক থেকে কোন প্রতিউত্তর আসল না। ওরা অনেক উত্তেজনামূলক কথা বলল মহিলাটাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তাতেও মহিলাটার থেকে কোন জবাব আসল না। এতে ওদের মনে আরও অনেক সাহস বেড়ে গেল। ওদের ভিতর থেকে একজন মহিলাটার হাত ধরল, তাতেও কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে ওরা মহিলাটাকে রাস্তার পাথে একটা ঝোপের ভিতর নিয়ে গেল।
ঝোপের ভিতর থেকে হালকা গোঙ্গানির শব্দ হল ঘন্টা দুয়েক। এই ছেলেদের দল মহিলাটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে রেখে চরম উত্তেজনার সুধা পান করল। এক সময় ওরা ক্লান্ত হয়ে মহিলার নিস্তেজ দেহটাকে ঝোপের ভিতর ফেলে দিয়ে বাহিরে এল। ওদের সবার ভিতর একটা তৃপ্তি দেখা গেল। ওরা সবাই খুশি। এ রকম একটা কাজ ওরা এত সহজেই করতে পারবে ভাবেনি কখনও।
পরদিন দুপুরে ওরা আবুল হোসেন ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে গল্প করছে। সাদি, রিফাত, শাহীন, সেলিম ওরা একে অপরকে বলছে গতরাতের কাহিনী। যদিও কাজটা সবাই একসাথে একই জায়গায় করেছে। কার কাছে কেমন লেগেছে, কে কি রকম করেছে, বলছে সব।
আবুল হোসেন ভাই দেখলেন রাস্তার ওপারের বেঞ্চে বসে ওরা কি যেন বলছে আর হাসছে। ওদের এ রকম হাসি আর গোপন আলাপচারিতা আগে কখনও তিনি দেখেন নাই। কথা বলার সময় ওরা দেখতে পেল একজন মহিলা রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে এ দিকে আসছে। ওরা মহিলটার দিকে তাকিয়ে থাকল। আর একটু কাছে আসার পর বুঝতে পারল গত রাতের সেই মহিলাটা। ভয়ে ভয়ে ওরা ঊঠে দাঁড়াল। মহিলাটি দোকানের সামনে এসে আবুল হোসেন ভাইয়ের সামনে দাড়াতেই, আবুল হোসেন ভাই মহিলাটিকে কলা আর রুটি খেতে দিল। সাদি, রাফি, শাহীন, সেলিম অনেক্ষণ দেখল মহিলাটিকে। ওরা বুঝলো যে মহিলাটি একটা পাগল। ওদের চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।
[মধ্যাহ্ন, ২৮ বৈশাখ, ১৪২০ বঙ্গাব্দ, কুমিল্লা]
(গল্পটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭ তে প্রকাশিত লেখকের ‘আসমত আলীর অনশন’ নামক গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া)
এসি