ঢাকা, শুক্রবার   ১৪ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

‘আমি কবি’ উপন্যাসের গ্রন্থালোচনা

অক্ষরতুলিতে কবি জীবনের বাস্তব চিত্র আঁকলেন মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত : ১২:০৯, ১০ জুলাই ২০১৯ | আপডেট: ১২:২০, ১৪ জুলাই ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ, আনন্দ-বেদনা-স্পর্শানুভুতি লেখক যখন আপন কল্পনালোকে স্থাপন করে শব্দাক্ষরের সহায়তায় ছন্দবদ্ধ তনুশ্রী দান করেন তখন তিনি একজন পরিপূর্ণ কবি হয়ে উঠেন। কবির অনন্দঘন কিংবা বেদনাবিধুর হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি। কবি সর্বদা ধ্যানস্থ থেকে কল্পনালোকে বিরাজ করেন। এ কারণেই কবিরা চিরদিন উদাসীন হন।

আবীর হাসানও আপদমস্তক একজন কবি। দিনরাত কবিতা লেখায় মশগুল থাকেন। কবিতা তার ধ্যান-জ্ঞান। কাব্য সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি আনন্দলোকে বিরাজ করেন। কবিতার মাধ্যমে উন্মোচন করেন জীবনরহস্য। নিজের আনন্দ-বেদনার কথা পাঠকদের জানান দেন। শব্দসম্ভারের মাধ্যমে প্রেমময়ী নারীর দেহসৌষ্ঠব নিখুঁতভাবে অঙ্কন করেন। তাদের মনের অন্তরালের কথা ছন্দ-মাধুর্যতায় প্রকাশ করেন জাদুকরী মহিমায়।

এ কারণেই আবীরের কবিতার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে অনামিকা আহমদ অনু। তার কবিতার প্রতিটি পঙক্তির মধ্যে অনু নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পান। একপর্যায়ে আবীরের কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত বনে যান তিনি। প্রতিনিয়ত পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে তার কবিতা সংগ্রহ করেন। পরে তা নিজের ফেসবুকের ওয়ালে পোস্ট করেন।

সময়ের পরিক্রমায় আবীরকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলে অনু। কিন্তু আবীরের সঙ্গে তার সরাসরি পরিচয় নেই। একদিন একটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় অনুর। সেদিন চমৎকার একটি প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করে আবীর। এতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মঞ্চে উঠে হাজারো মানুষের সামনে আবীরের গালে ভালোবাসার চুম্বন রেখা এঁকে দেয় অনু। এভাবেই তার ভালোবাসার কথা জানতে পারে আবীর।

কবিরা যেমন প্রেমিক স্বভাবের, তেমনই মানবিক গুণসম্পন্ন। অনুর ভালোবাসাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি আবীর। তার অন্তরের অভিপ্রায়কে সম্মান করতে গিয়ে জাগতিক প্রেমের বেড়াজালে আবদ্ধ হয় আবীর। আর এ বেড়াজাল থেকে বের হতে পারেনি উদাসীন কবি। ছন্নাছাড়া জীবন ত্যাগ করে আশপাশের আট-দশটা মানুষের মতো তাকে সাধারণ জীবন বেছে নিতে হয়। খুঁজে নিতে হয় চাকরি। একপর্যায়ে অনুকে বিয়ে করে তাকে পুরোপুরি সংসারী হতে হয়।

আবীর-অনুর সংসার জীবন প্রথম দিকে ঠিকমতো চলছিল। আবীর ভালো চাকরি নিয়ে সংসারটা অল্প সময়ের মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছিল। স্ত্রীর ভালোবাসা ও কবিতার খ্যাতি তাকে নতুন জীবন দান করেছিল। কিন্তু কথায় আছে, নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি ঈর্ষাপরায়ণ। এই ঈর্ষাই আবীর-অনুর দাম্পত্য জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। আবীরের কবিতার আবেদন অন্য নারীদের হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে-এ বিষয়টি অনু বুঝতে পারে। অন্য নারীরা আবীরের সঙ্গে দেখা করছে-এ খবরও তার কাছে পৌঁছে যায়। এরপরই অনুর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আবীরের কবিতাকে অনু এড়িয়ে চলতে থাকে। তার লেখালেখিতে নানাভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তাকে মানসিকভাবে চাপে রাখে। অনুর এ পরিবর্তনে আবীর অবাক হয়। অনুকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করে-তার সন্দেহ সঠিক নয়, তা মনগড়া মাত্র। কিন্তু বোঝাতে ব্যর্থ হয়। অনুর ঈর্ষার আগুনে ঝলসে যায় আবীরের সৃজনশীল জীবন। তারপরেও আবীর সংসারটা টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। কিন্তু অনুর সন্দেহপ্রবণতা ও অবিশ্বাসের বিষবাষ্প সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। একদিন অনু সিদ্ধান্ত নেয় চিরদিনের জন্য তার বাবা-মায়ের কাছে চলে যাবে। সেদিন আবীর আর তাকে আটকাতে পারেনি।

‘আমি কবি’ উপন্যাসটি সম্পূর্ণ উত্তম পুরুষে লেখা। কবি আবীরের মুখে ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে এর কাহিনি এগিয়েছে। কবি আবীরের বিরহের চিত্রপট উত্থাপনের মাধ্যমেই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে। শুরুতেই আবীর বলেন, ‘অনুর কথা শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল।’ প্রথম লাইনটা পড়েই একজন পাঠক উপন্যাসের ঘোরপ্যাঁচে আটকে যাবেন। কেন বাজ পড়ল? কি হয়েছে?-এর উত্তর খুঁজে পেতে অবশ্যই পরের ঘটনায় মনোনিবেশ করবেন। আর একজন সার্থক লেখকের কাজ হচ্ছে পাঠককে একের পর এক চমকের মাধ্যমে কাহিনির মধ্যে আটকে রাখা। এ উপন্যাসেও সফলভাবে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে।

‘আমি কবি’ উপন্যাসে একজন কবির বাস্তবিক চিত্রপট তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে অনুর মা অহনা আহমেদের উক্তির মধ্যে তা আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘কবিরা মানুষ, তবে ভাবুক মানুষ। ওরা খুব একটি সংসারী হয় না। আদাড়ে-বাদাড়ে ঘোরে। কাজকাম কিছু করে না। বউয়ের ঘাড়ে চেপে বসে।’

কবিরা মুখে তেমন কিছু বলতে পারে না। বরাবরই তা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করে। আবীরও তার ভালোবাসার গভীরতার কথা অনুকে সামনাসামনি বলতে পারেনি। তাই কবিতার আশ্রয় নেয়। আবীর অনুকে উদ্দেশ করে লেখে, ‘সমুদ্রের জলস্রোতের মতো তোমার আবেগ/ আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’

সৃজনশীলতা সংসার জীবনকে ততটা সমর্থন করে না-এটাই ধ্রুব সত্য। আবীরের অফিসের বস রাশেদ মহিউদ্দিনের উক্তির মাধ্যমে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘লেখালেখিটা অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। বিয়ের পর সব শেষ হয়ে গেছে। প্রথম দিকে আমার স্ত্রী ঠিকই আমার লেখার প্রশংসা করতো। একপর্যায়ে দেখলাম সে আর আমাকে লিখতে দেয় না। আমার লেখাই যেন তার শত্রু হয়ে উঠল। কী আর করা! আমি লেখালেখি বন্ধ করে দিলাম।’ রাশেদ মহিউদ্দিনের এ উক্তির সঙ্গে শত শত ঝরে পড়া লেখকের জীবনের মিল রয়েছে। অথচ তারা লেখালেখিটা চালিয়ে রাখতে পারলে হয়তোবা দেশজুড়ে সুনাম অর্জন করতে পারতেন।

মনোবিজ্ঞানী চার্লস লিন্ডহোম প্রেমের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, প্রেম হলো ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি উত্তেজনাপূর্ণ ও রহস্যময় অনুভুতি। এই উত্তেজনা কখনো ক্ষণস্থায়ী হয়, কখনো বা দীর্ঘস্থায়ী হয়। সে অনুসারে উপন্যাসের নায়িকা অনুর প্রেমের উত্তেজনা ক্ষণস্থায়ী ছিল। আবার কথায় আছে, যাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসা যায়, তাকে বিয়ে করা যায় না। তাহলে সেই ভালোবাসা পরবর্তীতে ব্যর্থতায় রূপ নেয়। আবীর-অনুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।  

একজন কবির ব্যর্থ প্রেম ও স্বপ্নভঙের এমনই কাহিনি নিয়ে ‘আমি কবি’ শিরোনামের উপন্যাসটি লিখেছেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল। এবারে একুশে বইমেলায় এটি প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। হলদে অভায় এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বরেণ্য সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে।

বাংলা সাহিত্যের মূলধারার লেখক হিসেবে মোস্তফা কামালের নাম সর্বমহলে উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে ‘অগ্নিকন্যা’, ‘অগ্নিপুরুষ’ ও ‘অগ্নিমানুষ’ উপন্যাস তিনটি তাকে আলোচনার শীর্ষে নিয়ে এসেছে। ‘জননী’ উপন্যাসটিও তাকে অসামান্য খ্যাতি এনে দিয়েছে। এ উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ ‘দ্য মাদার’ লন্ডনের অলিম্পিয়া পাবলিশার্স প্রকাশ করেছে। এছাড়া ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে প্রকাশিত তার তিনটি উপন্যাসের ইংরেজি সংস্করণ ‘থ্রি নভেলস’ আন্তর্জাতিকমানের অনলাইন পরিবেশক আমাজনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়েছে।

মোস্তফা কামালের সাহিত্যকর্মে মানবিক মূল্যবোধ, শ্রেণিচেতনা ও সমাজ বাস্তবতা জীবন্ত উপাদান হয়ে পরিস্ফুটিত হচ্ছে। জীবন ও জীবিকার নানা বাঁক, দৃষ্টিদৃক্ষা ও চর্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি তার সৃষ্টিকর্মকে বাস্তবতায় রূপদান করছেন। পঠনে, বোধে ও বিশ্লেষণে তার সাহিত্যধারা ও সাহিত্যচেতনা সত্যিকারার্থে নতুনত্ব ও উত্তরাধুনিকতার গুণে অনন্য হয়ে উঠেছে।

(উপন্যাসের নাম: আমি কবি। প্রকাশনী: অন্যপ্রকাশ। প্রকাশ: একুশে বইমেলা-২০১৯, প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর। পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১০৪। মূল্য: ২৫০ টাকা।)


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি