কথাসাহিত্যই আমার পছন্দের প্রকাশ মাধ্যম: হারুন পাশা
প্রকাশিত : ২৩:০২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৪:১৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০
কথাসাহিত্যিক হারুন পাশা। জন্মগ্রহণ করেছেন রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার তালুক শাহবাজ গ্রামে। যার গল্প প্রকাশিত হচ্ছে ২০১২ সাল থেকে। পাশার গল্প-উপন্যাসে স্বাতন্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, তিনি গল্প-উপন্যাসের বর্ণনায় লেখককে অনুপস্থিত রাখেন।
আবার একজনকে চরিত্র শোনান, আরেকজনকে গল্প। এতে করে চরিত্রের কথনেই গল্প-উপন্যাসের কাহিনী এগিয়ে যায় শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। নতুন এ প্রকাশরীতি পাঠককে মুগ্ধ করে।
তিনি শৈশব-কৈশোরে ছিলেন বঞ্চিত মানুষ। এই বঞ্চনা এবং গল্প শুনতে না পারার অতৃপ্তি আর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তিনি গল্প বলেন চরিত্রের মধ্যদিয়ে। তার লেখায় উঠে আসে সমাজ, দেশ, মানুষের সংকটাপন্ন জীবনকথা। গল্প-উপন্যাসে গুরুত্ব দেন আঞ্চলিক ভাষা। এবং তিনি লেখেন পিতার সম্মান বৃদ্ধির জন্য।
যার হাত ধরে একে একে প্রকাশিত হয়েছে ৫টি গ্রন্থ ও ২৩টি গল্প। এরমধ্যে দুটি উপন্যাস, ‘তিস্তা’ এবং ‘চাকরিনামা’। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার এবং কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার।
তরুণ এ কথা সাহিত্যিক কথা বলেছেন একুশে টিভি অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি খালিদ হাসান তুষার।
প্রশ্ন: আপনি তো বেশ কয়েক বছর ধরেই গল্প ও উপন্যাস লিখছেন। গল্প লেখার গল্পটা কেমন?
হারুন পাশা: গল্প আমার পছন্দের প্রকাশ মাধ্যম, যেমন পছন্দ উপন্যাস। আমি গল্প বলতে পছন্দ করি। আর গল্প ও উপন্যাসে গল্পটা বলা যায়। গল্প লেখা শুরু করেছিলাম ২০০৯ সালে। ‘বেকারদের আর্তনাদ’ শিরোনামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে ‘দৈনিক ভোরের কাগজে। এভাবেই শুরু হয়ে যায় কথাসাহিত্যে প্রবেশ।
প্রশ্ন: আপনার প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে ‘তিস্তা’ একটি। এটি লেখার কারণ বলবেন কি?
হারুন পাশা: ‘তিস্তা’ উপন্যাস লেখার কারণ বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। যে তিস্তা নদী নিয়ে লিখেছি সেই তিস্তার সাথে আমার পরিচয় জন্মের পর থেকেই। স্কুলের টিফিনে কিংবা স্কুল ছুটি হলে বন্ধুরা মিলে নদী দেখতে যেতাম। দেখেছি ভরা তিস্তায় কেমন করে কচুরিপানা পাঁক খায়। মাঝির মাছ ধরা দেখেছি। ধানের জমিতে পলি দেখতে পেতাম। নদীতে মাছ আছে, ঘরে ধান আছে, মানে ভাত আছে। ফলে সংসারে হাসি-খুশিও থাকত। চরের মানুষের ভুট্টা, আখ, মরিচ, তরমুজ, বাদাম আবাদ করা দেখেছি।
কিন্তু এই তিস্তা আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় না হয়ে ছোট হতে থাকে। হয়ে যায় নালার মতো। বর্ষার দুই মাস বাদে বছরের অন্য সময়গুলোয় নদীতে থাকে বালু। যে নদীর গর্জন শুনে ভয় পেতাম, সেই নদীর বুকে হাঁটা যায়। একপাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়া সম্ভব। শৈশব-কৈশরের এমন সমৃদ্ধ স্মৃতি বড় বেলায় খুঁজে পাই না। মিলাতে পারি না শৈশবের তিস্তার সঙ্গে যৌবনে দেখা তিস্তা।
এ তিস্তার বুকে রস নেই। কষ্ট তীব্র হয় নিজের ভেতর। দেখতে পাই নদীতে পানি নেই বলে তিস্তাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকা মানুষ ঠিক মত আবাদ করতে পারছে না, মাছ ধরতে পারছে না। দেখি তাদের ক্ষয়, হতাশা, না খেয়ে থাকা, পেশা বদলের মিছিল। তিস্তার পাড় দিয়ে হাঁটি, ব্যাথা বড় হতে থাকে। যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হই। তাদের ভাগ্যবদল তো আমি করতে পারব না, কারণ সেই ক্ষমতা আমার নেই। ফলে তাদের বর্তমান জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টায় নিজেকে যুক্ত করেছি। কেননা নদী ও মানুষের সমৃদ্ধ অতীত হয়েছে দরিদ্র। দারিদ্র্যের আখ্যানে পূর্ণ তাদের জীবন।
প্রশ্ন: আপনার লেখায় নিম্নবর্গীয় মানুষের বিচরণ বেশি লক্ষ করা যায়, কিন্তু এই সময়ে এসে শহুরে হাওয়ার ঢেউ গ্রাম অবধি বয়ে চলেছে। এটাই কেন নির্বাচিত বিষয়বস্তু হলো?
হারুন পাশা: খেয়াল করলে দেখবেন, গ্রামে নগরের হাওয়া ঢুকলেও নিম্নবর্গের ভাগ্যবদল খুব বেশি হচ্ছে না। আর নিম্নবর্গ বলতে কেবল গ্রামীণ মানুষদেরই বোঝায় না, শহুরে বা নাগরিক জীবনে বসবাস করা মানুষরাও এর আওতাভুক্ত। নিম্নবর্গ তো নির্যাতীত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত হয়ে থাকে সবসময়, সবক্ষেত্রে। তাদের এই নিপীড়ন আমাকে ব্যাথাহত করে। আমি বঞ্চিতদের সঞ্চিত করতে চাই।
তাছাড়া এই মানুষদের মধ্যে পাওয়া যায় প্রকৃত কিংবা মৌলিক এক জীবন। যেখানে থাকা মায়া, মমতা, ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা। থাকে না কোনো অভিনয়। ব্যক্তিগত জীবনে আমিও এসব পছন্দ করি। এমন কিছু কারণে তাদের জীবন নিয়ে লিখি।
আমার লেখায় শহর এবং গ্রাম দুইজীবনই আছে। ‘তিস্তা’ উপন্যাসে আছে তিস্তাপারের মানুষের নিম্নবর্গীয় জীবন। আর ‘চাকরিনামা’ উপন্যাসে আছে শাহরিক মানুষের নিম্নবর্গীয় জীবন। এই নিম্নবর্গ হলো বেকার মানুষেরা। যাদের স্বর গুরুত্ব পায় না পরিবার, সমাজ, দেশ কিংবা রাষ্ট্রের কাছে। বন্ধু-বান্ধব এমনকি প্রেমিকার কাছেও।
প্রশ্ন: এবার আসি আপনার দ্বিতীয় উপন্যাস প্রসঙ্গে। ‘চাকরিনামা’ উপন্যাসে কোন বিষয়গুলো উঠে এসেছে?
হারুন পাশা: এ উপন্যাসটি হলো আমাদের বর্তমান চাকরিব্যবস্থার পোস্টমর্টেম। সব ধরনের চাকরিব্যবস্থার ভেতর বাস্তবতার কথা বলেছি। কর্মহীন মানুষের জীবনের নানা সংকট, হতাশা, না পাওয়া, বঞ্চনা এবং উত্তরণের কথাও আছে। সফলতাও আছে। তারা যে কেবল ব্যর্থ মানুষ তা নয়। চাকরি না থাকা সাময়িক সমস্যা। চরিত্ররা সমস্যা উতরিয়েছে একাগ্রতা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে।
ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছি প্রমিত আঞ্চলিকতা। আমরা প্রত্যেক সন্ধ্যায় নিজেরা যে ভাষায় গল্প করি ওই ভাষা। ভাষা ব্যবহারে চরিত্ররা মুখোশ থেকে বেরিয়েছে। পলিস বা সরকারি ভাষা তারা ব্যবহার করেনি। নিজেরা যে ভাষায় দিনের অধিকাংশ সময় কথা বলে, সেই ভাষাই এসেছে।
প্রশ্ন: চাকরিক্ষেত্রে আমাদের যে অব্যবস্থাপনা, এ থেকে কীভাবে মুক্তি আসতে পারে?
হারুন পাশা: সরকারকে ভালো উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগে থাকবে মাস্টারপ্ল্যান। যাতে বেকারদের কর্মের ব্যবস্থা করা যায়। কেবল প্ল্যান করে রাখলেই হবে না, তা বাস্তবায়নও করতে হবে। বেসরকারি পর্যায়ে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেখানেও পোস্ট ক্রিয়েট করতে হবে। আবার কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে, কেবল কাজের চাপে রাখলে হবে না। আবার এতটা চাপমুক্ত রাখা যাবে না যাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মতো স্লো না হয়ে যায়।
সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক পর্যায়ে কাজের গতি রাখতে হবে। আমাদের সমাজের ট্রেন্ডও বদলাতে হবে। সমাজ বেকারের কর্মসংস্থান বলতে বোঝে সরকারি চাকরি। সরকারি অফিসের পিওন হলেও তারা খুশি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা যারা উদ্যোক্তা তাদের ততটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না। উদ্যোক্তাদের তো বেকার হিসাবেই কাউন্ট করে সমাজ ও তার মানুষরা। আমাদের চিন্তা কিংবা দৃষ্টির পরিবর্তনও আবশ্যক।
প্রশ্ন: যদিও লেখকের সব সৃষ্টিই তার একান্ত আপন, আপনাকে যদি এই দুটো উপন্যাসের ভেতর নম্বর দিতে বলা হয়, দশের ভেতর কোনটাকে কত দিবেন?
হারুন পাশা: নম্বর দিলে তো বেশি দিয়ে ফেলব। কারণ আমি কখনই কাউকে কম নম্বর দেই না। এই দায়িত্ব পাঠকের হাতেই থাক। আমি এটুকু বলব, দুটি উপন্যাসই দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল। ‘তিস্তা’ লিখেছি ২০১৪-’১৭ সাল পর্যন্ত। ‘চাকরিনামা’ লিখেছি ’১৭ সালের শেষ থেকে ’১৮ সালের শেষ পর্যন্ত। উপন্যাস দুটি লিখেছি দীর্ঘ সময়, পরিকল্পনা এবং পরিশ্রমযোগে।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন বাংলা সাহিত্য একটি বাঁক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে? যদিও রূপান্তরই নিয়ত সত্য। প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, মানুষের আধুনিক জীবনের জটিলতর আখ্যানের প্রভাব আমরা কীভাবে পাচ্ছি?
হারুন পাশা: নতুন বাঁকে লেখকরা লিখবেন সাহিত্য। পাঠকরা পড়বেন নতুন বাঁক সম্পর্কে। এটাই তো ঘটে আসছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাটলে তাই তো আমরা দেখতে পাই। বঙ্কিমচন্দ্রের বাঁক ভেঙে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়ালেন।
রবীন্দ্রনাথের বাঁক ভেঙে দাঁড়ালেন মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার বন্দ্যোপাধ্যায়দের বাঁক ভেঙে দাঁড়ালেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু। বাংলাদেশের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান কিংবা এর পরে সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দীন আল আজাদ কিংবা তাদের পরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, সেলিনা হোসেন কিংবা তাদের পরে কায়েস আহমেদ, হরিপদ দত্ত, সুশান্ত মজুমদার, ফারুক মঈনউদ্দীন কিংবা শহীদুল জহির, মামুন হোসাইন, নাসরীন জাহান প্রমুখ বাঁক বদলে ভূমিকা রাখলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। অর্থাৎ বোঝা যায় আগের সাহিত্য তথা মহাভারত কিংবা রামায়ণ থেকেই শুরু করে প্রাচীন, মধ্যযুগ, প্রাক-আধুনিক যুগ কিংবা তারও কিছু পরে সাহিত্যে নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারগুলো ছিল। মানুষ জীবনকে সরল কিংবা বিশ্বাসের চোখে উপলব্ধি করত। জটিলতাকে সারল্যে ফেলে একটা সুখী জীবন যাপনের চেষ্টা করত। সাহিত্য তো যাপিত জীবন কিংবা সময়ের আলেখ্য।
ফলে সাহিত্যেও এই ব্যাপারগুলো উঠে আসে। প্রযুক্তির প্রভাবে মানুষ এগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রযুক্তি প্রথম দিকে আমাদের ঘরে অতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। শিক্ষানবিশ পর্যায়ে ছিল। সময় এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রযুক্তি মানুষের প্রবণতা বুঝতে পারে এবং এই বোঝার সাথে নতুন কিছু যোগ করে বাজারে ছাড়ে। আর ভিন্ন ভিন্ন মানুষেরা তা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে থাকে।
এই প্রযুক্তি কিন্তু মানুষই তৈরি করছে। পুঁজির স্পর্শে মানুষই মানুষকে বিপদে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। মানুষ হারাতে বসে পরস্পরের উপর বিশ্বাস কিংবা আস্থা। মানুষ হয়ে পড়ছে বেশি মাত্রায় স্বার্থবাদি এবং নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে একজন সত্য কথা বললেও ভাবে যে সে মিথ্যা বলছে। বাড়িয়ে ও বানিয়ে বলছে। বাবা ছেলের উপর ভরসা রাখতে পারছে না। ছেলেও ভরসা রাখতে পারছে না বাবা কিংবা মায়ের উপর। স্বামী ভরসা রাখতে পারছে না স্ত্রীর উপর। স্ত্রী ভরসা রাখতে পারছে না স্বামী কিংবা সন্তানের উপর।
ভরসা ও আস্থাহীনতা কিংবা নৈতিক অবক্ষয়, স্বার্থবাদিতা আমাদের জীবনকে করে তুলেছে বিষাদময়। জীবনকে করে তুলেছে জটিলতর। সাহিত্য মানবজীবনের আখ্যানকে উপজীব্য করে বলেই জীবনে বিদ্যমান জটিলতাকেই আমরা খুঁজে পাচ্ছি সাহিত্যে। বলবে যে, আগেও তো এসব ছিল। হ্যাঁ, ছিল, মাত্রাটা ছিল কম, এখন প্রকট।
প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে এসে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকসহ আরও জায়গায় অনেক লেখক উঠে আসার খবর পাচ্ছি, কিন্তু দেখা যাচ্ছে অধিকাংশই প্রস্তুতিবিহীন লিখছেন এবং লেখক হবার জন্য যে নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও সাধনা দরকার প্রায়ই ভেতরে নেই। এ বিষয়ে কী বলবেন?
হারুন পাশা: তাদের উঠতে দেখতেছ, কয়দিন পর পড়ে যেতেও দেখবে। এটা নিয়ে হতাশ হইয়ো না, যদিও দুঃশ্চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা একটা নষ্ট সময় পার হচ্ছে ফেসবুকীয় দাপটে। এটা তাদেরও জানা উচিত সিরিয়াস ধারার লেখকরা চমৎকার প্রস্তুতি নিয়েই লিখতে আসেন। কিংবা লিখতে লিখতে নিজেকে ধারাল করে নেন। বিনিয়োগ করেন পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও সাধনা। তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই চিন্তা করো না। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর পরিশ্রম, নিষ্ঠা বিনিয়োগে যদি আর না লিখতেন তাহলে আমরা আংশিক রবীন্দ্রনাথ পেতাম।
কারণ ১৯১৩ সালের পরই ভালো ভালো গল্প-উপন্যাস-নাটক আমরা পাই। বাংলা সাহিত্যের বাইরের কথা যদি বলো শেক্সপিয়র, তলস্তয়, হেমিংওয়ে, দস্তয়ভস্কি, কাফকাসহ অন্যরা আজ বিশ্ব সাহিত্যের মাস্টারপিচ লেখক হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ তারা নন-সিরিয়াস সাহিত্যচর্চা করেন নাই। তারা ফেসবুকে লিখেন নাই, ‘বন্দু তোমার পেঁয়াজ লাগলে আমায় দিও ডাক/ তোমার সাথে পেঁয়াজ খাব আমি সারারাত..’।
হাজার হাজার লাইক পেয়ে লেখক বনে যান নাই। তারা প্রত্যেকের নিষ্ঠার সাথে পরিশ্রম বিনিয়োগ করেছেন। প্রস্তুতি নিয়েই লিখতে এসেছেন। জীবন ও জগৎকে জেনেছেন গভীরতর ও অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে সাহিত্য লিখতে গেলে অনেক অসহযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়, মানুষের বিমুখতাগুলো কাটিয়ে উঠার শক্তি কীভাবে পান?
হারুন পাশা: কাউকে কোনো কাজ থেকে বিরত রাখা সমাজের মানুষের ট্রেন্ড হয়ে গেছে। নিজে কিছু করতে পারবে না কিন্তু কারো কাজে ‘বাগড়া’ বাঁধাবে। সৃষ্টিশীলরা সাহিত্য করার শুরু থেকেই অসহযোগিতার মুখোমুখি হয়ে আসছে। আমরা কি রবীন্দ্রনাথকে ছেড়েছি? ছাড়ি নাই। তার সমালোচনা করেছি। অসহযোগিতা দেখিয়েছি। জীবনানন্দ দাশকে তো জীবিত থাকাকালীন প্রকাশিত হতেই দেওয়া হলো না। অথচ জীবনানন্দ এখন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি।
সৃষ্টিশীলদের অসহোগিতা আসে পরিবার থেকে, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে, সমাজের মানুষের কাছ থেকে। সমসাময়িক লেখকদের কাছ থেকে। অসহোগিতা আসে সম্পাদকের কাছ থেকেও। এই বিমুখতা অতিক্রম করতে হবে উদ্যমতা, তারুণ্য ও সব সময় লেখায় লেগে থাকার মধ্যদিয়ে।
প্রশ্ন: আপনার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলুন। আপনার বাবা-মা, ক'ভাইবোন আপনারা? পরিবার থেকে লেখালেখির ক্ষেত্রে কার কাছ থেকে বেশি সহায়তা পান?
হারুন পাশা: আমার বাবা-মা বেঁচে আছেন। তারা খুবই ভালো এবং ভদ্র মানুষ। আমার লেখালেখি নিয়ে তাদের সহযোগিতা আছে। তাদের ষষ্ঠ সন্তান হারুন পাশা চাকরিতে নাই, এটাই তাদের টেনশনের কারণ। অন্যকোনো টেনশন নাই। বাবা চাকরি করতেন। মা ঘর-সংসার সামলিয়েছেন। এখনও যেমন সামলান।
আমরা আট ভাইবোন। সবাই এডুকেটেড। কিন্তু সাহিত্য তেমন পড়ে না। একমাত্র আমিই ওই লাইন থেকে বেরিয়ে এসে সাহিত্য পড়ছি এবং সাহিত্য করছি। আমার পরিবার থেকে বাবা-মা কিংবা ভাইবোনেরা সহযোগিতা করে আসছে। মাঝেমধ্যে একটু এদিক-সেদিক তো হয়ই। তবে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি আমার বড় ভাই রবিউল আউয়ালের কাছ থেকে। তিনি আমাকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন।
এজন্য আমাকে টাকা রোজগারের জন্য টিউশনি করাতে হয় নাই। টেক্সটের বাইরের বই পড়ার সময় ও সুযোগ পেয়েছি। নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছি পাঠ সংক্রান্ত প্রস্তুতিতে। আমি যে আজ হারুন পাশা নামে পরিচিত এবং লিখছি। এটা তার সহযোগিতা ছিল বলেই সম্ভব হয়েছে। এজন্য ভাইকে উৎসর্গ করেছি কালি ও কলম পুরস্কার প্রাপ্তির মুহূর্ত। যদিও এই উৎসর্গ তার সহযোগিতার পাহাড়কে টপকাতে বা ছুঁতে পারবে না।
প্রশ্ন: আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন রংপুর। সেখানেই বেড়ে উঠা, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পড়ালেখা। আপনার শৈশবের কিছু কথা যদি বলতেন, বিশেষ করে ঠিক কার অনুপ্রেরণায় বা কেন লেখালেখির প্রতি ভালোলাগা জন্মাল?
হারুন পাশা: লেখক হওয়ার যে লক্ষণগুলো থাকে ছোটবেলা থেকেই সেসব আমার ভেতর ছিল। আমি চারপাশে গল্প খুঁজতাম। ভালোলাগার যেটা পেতাম ওইটা নিয়েই গল্প বানানোর চেষ্টা করতাম। নিজের মতো করে থাকতে পছন্দ করতাম। কেওয়াজ কিংবা হৈ-হুল্লোড় বা উচ্চ শব্দ পছন্দ করতাম না। প্রচুর খেলাধুলা করতাম। ক্রিকেট খেলতাম অনেক। মার্বেল খেলতাম। এটা ছিল আমার পছন্দের একটি কাজ।
মার্বেল খেলতে খেলতে একটা বিষয় আমি শিখেছি। বিষয়টা হলো বেশি বেশি চর্চা করলে কোনো জিনিস ভালো করে আয়ত্তে আনা সম্ভব। যেমন আয়ত্ত করেছিলাম মার্বেল খেলার কৌশল। এতে করে যেটা হয়েছিল আমার এলাকার কেউই খেলতে এসে ফতুর না হয়ে ফিরে যেতে পারত না। লেখালেখির ক্ষেত্রে এই ধারণাটা প্রয়োগ করে দেখলাম, আসলেই তো ব্যাপারটা তাই। এটাও আমার প্রেরণা।
তারপর আমি প্রচুর গান শুনতাম স্কুল-কলেজ জীবনে। একবার কলেজের বেতন না দিয়ে ওই টাকায় ছোট্ট একটি টেপরেকর্ডার কিনেছিলাম গান শোনার জন্য। গানের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক থাকায় একটা সময় মনে হলো গান লিখব। এবং গান লিখিও। মাঝে মধ্যে অ্যালবামের গায়ে দেওয়া ঠিকানায় পাঠাতামও ওই গান। এর মধ্যদিয়ে কিন্তু লেখালেখির চর্চাটা শুরু হয়ে গেল।
ফল হিসেবে কলেজ জীবনে কবিতা লিখি এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেও কবিতা লিখতাম। এখনও যদিও লিখি, কিন্তু প্রকাশ করি না। কারণ কবিতা লিখলে মনে এক প্রকারের তারুণ্য কাজ করে। এই তারুণ্য ভেতরে রেখেই গদ্যে প্রয়োগ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়বর্ষ থেকে গল্প লেখা শুরু করি।
মজার ব্যাপার হলো আমি প্রথম গল্প লেখা শুরু করেছিলাম ২০০৯ সালে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমবর্ষে। আর শেষ করি মাস্টার্স দিয়ে। মাঝে যদিও আরো বেশ কিছু গল্প লিখি। যেটা বলছিলাম, গান লেখার চর্চাটাই আমাকে এখন এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বলা যায় এটাও একটা প্রেরণা।
বড়বেলায় এসে বাংলা সাহিত্যের প্রায় ১৫০ বছরের গল্প-উপন্যাস ও কবিতা পড়ে ফেলি। পড়ে পড়েই জেনে ফেলি যে কীভাবে লিখতে হবে এবং কী লিখতে হবে। এটুকু জানার পর নিজের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে লিখছি উপন্যাস এবং গল্প। পড়াটাও আমার জন্য অনুপ্রেরণা।
প্রশ্ন: আমরা জানি প্রত্যেক লেখকের জীবনে নারী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, আপনি আসলে প্রেমকে কীভাবে ভাবেন?
হারুন পাশা: প্রেম আমাদের শরীর ও মনে এক প্রকারের নরম আবহ তৈরি করে। যেটা একজন সৃষ্টিশীল কিংবা অসৃষ্টিশীল মানুষের মানসিক তৃপ্তি দেয়। যে তৃপ্তি নতুন কিছু তৈরির পক্ষে প্রণোদনা যোগায়, যদি আমরা এর চমৎকার ব্যবহার করতে পারি।
প্রশ্ন: লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রত্যেক লেখকের একটা আলাদা স্টাইল থাকতে হয়। যেটা আপনার লেখাতেও আছে। এক্ষেত্রে আপনি মূলত কাকে অনুসরণ করতে চান কিংবা লেখকের পৃথক স্বর তৈরির বিষয় নিয়ে কী বলবেন?
হারুন পাশা: অনুসরণ না বলে, বলা যেতে পারে ধারণা। পৃথক স্বর তৈরিতে ধারণা পেয়েছি অনেকের কাছ থেকে। যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান, শাহেদ আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমেদ, শহীদুল জহির প্রমুখ।
পৃথক স্বর নিজেকেই তৈরি করতে হবে। কেউ শিখাবে না। জানাবে না। নিজেকেই শিখতে হবে এবং জানতে হবে। তারপর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আমি যাদের কথা উল্লেখ করলাম প্রত্যেকেই সাহিত্যে পৃথক স্বর তৈরি করেছেন। পৃথক স্বর তৈরি করেছেন বলেই আমরা আজ তাদের কথা বলছি।
আমার সাহিত্যের পৃথক স্বর হলো এখানে একজন গল্প বলবে আরেকজন শুনবে। গল্প বলবে চরিত্ররা। এক চরিত্র শোনাবে আরেক চরিত্রকে গল্প। মাঝেমধ্যে কেউ হয়ত লিঙ্কআপ করতে পারে, আবার নাও পারে। চরিত্রের কথনেই উপন্যাস কিংবা গল্প এগিয়ে যাবে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। আগের সাহিত্যে লেখক ও চরিত্র এক লাইনেই কথা বলে। আমি এটা এড়িয়ে গেছি। এখানে চরিত্ররাই সব। চরিত্ররাই যাপিত জীবনের ব্যাখ্যাকারক। তারা কথা বলে নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায়। প্রকাশ পায় দেশ, সমাজ ও মানুষের সংকটাপন্ন জীবনকথা। আমার সাহিত্যে লেখক কিংবা লেখকের বর্ণনা মুখ্য বিষয় নয়। আমি লেখায় লেখককে অনুপস্থিত রাখি।
প্রশ্ন: লেখালেখি না করলে আর কি হতে চাইতেন?
হারুন পাশা : ক্রিকেটার হতে চাইতাম। কারণ ছোটবেলায় ব্যাপকভাবে ক্রিকেট খেলতাম এবং মনে মনে চাইতাম ক্রিকেটার হতে।
প্রশ্ন: সবশেষে, নতুন যারা লিখছে এ সময়ে, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
হারুন পাশা : নতুনদের ভেতর আমিও পড়ি। শেষ দশকের ক্যাটাগরিতে আমিও আছি। ২০১১ থেকে শুরু করে ২০২০ পর্যন্ত প্রথম বা দ্বিতীয় দশক কাউন্ট করা হয়। সেই দশকের লেখক আমি নিজেও। নতুনদের কথা বলতে গেলে আমি ও আমার সময়ে যারা লিখছে তাদের কথাই বলতে হবে। কেননা পরের দশক এখনও শুরু হয়নি।
সাহিত্যটা লেখক নিজে তৈরি করবে। সে কীভাবে লিখবে এবং কী লিখবে তা লেখককেই ঠিক করতে হয়। কেউ প্রেমকাহিনীর লেখক হবে, না কেউ সমাজ ও মানুষের ভেতর বাস্তবতা ও সংকটের কথা বলবে, তা লেখকই ঠিক করবে।
এক্ষেত্রে কারো উদ্দেশ্যে তেমন কিছু বলার থাকে না। এটুকু বলা যায়, প্রচুর পড়তে হবে, সময় ও সমাজকে চমৎকারভাবে অবজারভেশন করতে হবে, নিজস্ব ধরন আবিষ্কার করতে হবে এবং লিখে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। যেমন লিখে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ শামসুল হক।
এআই/এসি