ঢাকা, বুধবার   ০২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বাঁলিহাসের ডাক: একটি মগ্ন চৈতন্যের গল্প

আসিফ হাসান

প্রকাশিত : ২১:৪৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ২১:৫৩, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাঁলিহাসের ডাক: একটি মগ্ন চৈতন্যের গল্প

বাঁলিহাসের ডাক: একটি মগ্ন চৈতন্যের গল্প

Ekushey Television Ltd.

স্ক্যানডেনিভিয়ান দেশ সুইডেনে জন্ম অষ্টাদশী সুজানার। যার শেকড় বাংলাদেশে। এ কারণে তার দেহের মধ্যে বইছে প্রাচ্যের উত্তরাধিকার। অন্যদিকে জন্মনেয়া দেশটির প্রতি দায়বদ্ধতা, সংস্কৃতির প্রভাব, প্রেম, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্তের টানাপোড়েন, ৯০ দশকের আতঙ্ক সোমালিয়ার দুর্ধর্ষ জলদস্যু একটি পরিবারের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার নেপথ্য কাহিনি, ঝুঁকিপূর্ণ সেই দেশে একজনের খোঁজে যাওয়া- সর্বোপরি যাপিত জীবনের যে দ্বন্দ্ব- তাই নিয়ে সুইডেনপ্রবাসী লেখক লিয়াকত হোসেনের উপন্যাস বাঁলিহাসের ডাক।

দেহের ভেতর বালিহাঁসের ডাকও এক রসায়ন। এই রসায়ন কি সবাই বোঝে? বোঝেনা। এদিক দিয়ে সোমালী ও আরবী ছেলেগুলো অনেক স্বপ্রতিভ। ওরা সরাসরি তাকায়। সরু কোমর দুলিয়ে গানের তালে তালে নৃত্য করে। চোখের ইশারায় ডাকে। তাই গল্পের প্রধান চরিত্র ১৮ পেরুনো সুজানা প্রেমে পড়ে একই বিদ্যালয়ে দুই ক্লাশ উপরে পড়া সোমালিয়ার ছেলে আহমেদের।

নিজেকে কিছুটা রক্ষণশীলতার আবরণে ঢেকে রাখলেও একপর্যায়ে নিজের ভেতর বালিহাঁসের ডাক শুনতে পায় সে। অজানা পুলকের এই ডাককে কি বলে, তা সে জানে না। এটা কি প্রেম, না শরীরের দূরন্ত চাওয়া, তাও তার কাছে অজানা। আহমেদের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়টি বেশ জটিল এ কারণে যে, লেখকের বর্ণনায় এটি না প্রেম না বয়সের দূরন্তপনা তা বোঝা দুষ্কর। সম্পর্কটি প্রথমদিকে শরীরবৃত্তীয় হলেও পরে তা অন্য এক মোহময়তায় রূপ নেয়। যখন হঠাৎই আহমেদ হারিয়ে যায়। সুজানা তাকে পাগলের মত খোঁজে।

সুজানা প্রথমদিকে আহমেদকে গুরুত্ব দেয়নি। কাঙ্গালের মতো আহমেদ তার সাথে সম্পর্ক করতে চেয়েছে। একপর্যায়ে সুজানা আত্মসমর্পণ করে আহমেদের কাছে। কিন্তু সেটা সুজানার কাছে যতটা না ছিলো শারীরিক, তার চেয়েও বেশি ছিলো মানসিক। সুজানা জানতো আহমেদের সাথে আরও কয়েকটি মেয়ের সম্পর্ক ছিলো এবং তা ভেঙ্গেও গেছে। এটা জেনেও সুজানা আহমেদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। সুজানার ভাষায় অন্য মেয়েগুলো আহমেদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কিন্তু আহমেদ আমাকে জয় করেছে ওর ভালোবাসা দিয়ে।

রক্ষণশীল বাবা তার বোনের ছেলে মোমিনের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিবেন বলে ঢাকায় নিয়ে আসেন সুজানাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মোমিন সুজানাকে বিয়ে করে সুইডেনে গিয়ে ব্যাংকে চাকরি করার যে স্বপ্ন দেখেছিলো, সুজানার কাছে প্রথমদিনের পরীক্ষাতেই ফেল করে তার সে স্বপ্ন উবে যায়। বিয়ে আর হয় না। 

এখানেও লেখক মোমিন-সুজানার বক্তব্যের মধ্যে খুব সতর্কতার সাথে কিছু কিছু বিষয়ের বাস্তবতায় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের বৈপরীত্য তুলে ধরেছেন নিপুণ কুশলতায়।

দেশ থেকে ফিরে সুজানা জানতে পারে আহমেদ মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছিলো। ওর বাবা-মা ওকে নিয়ে সোমালীয়ায় চলে গেছে। সুজানা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেয় আহমেদকে খুঁজতে সোমালীয়ায় যাবে। শুরু হয় অসম্ভবের যাত্রা। আহমেদ এমন একটি পরিবারের সন্তান, যেই পরিবারটির বিরুদ্ধে রয়েছে আন্তর্জাতিক জলদস্যুতায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ। 

’৯০-এর দশকে সোমালীয়ার গৃহযুদ্ধের পর সেখানে বিদেশী ফিশিং ট্রলারগুলো মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে- এই অভিযোগে দেশটির উপকূলের জেলেরা মাছ ধরা বাদ দিয়ে অ্যাডেন সাগর দিয়ে চলাচলরত অনেক বাণিজ্যিক জাহাজকে নাবিকসহ জিম্মি করতো। এরপর বিপুল অঙ্কের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিতো। 

আসলে উপকূলীয় জলদস্যুদের বিদেশী ট্রলারের বিরুদ্ধে মাছ ধরে নেয়ার অভিযোগের ভিত্তি যতটা না যৌক্তিক ছিলো, তারচেয়ে বেশি ছিলো গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত সোমালীয়ার আর্থ-সামাজিক অবস্থা। যুদ্ধের কারণে ক্ষত-বিক্ষত দেশটিতে সন্ত্রাস সম্প্রসারিত হচ্ছিল। খুব অল্প সময়ে ধনী হওয়া যায়- এই মানসিকতা থেকে জাহাজ আটকের মত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় স্থানীয় কয়েকটি গ্যাং। 

এরকম একটি গ্যাংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় আহমেদের চাচা আব্দুল মুসা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কয়েকটি দেশের সম্মিলিত একটি জোট জাহাজ আটকের মত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশনে যায়। ধরা পরে আহমেদের চাচা। বিচারে তার দীর্ঘমেয়াদী জেল হয়। আরেক চাচা রাগ্গে মুসাও একই অপকর্মে জড়িত হয়ে নিরুদ্দেশ। ভাইদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে মনের দুঃখে, ক্ষোভে আহমেদের বাবা আবদান মুসা সুইডেনপ্রবাসী হন।

এদিকে, আহমেদকে খুঁজতে সুজানার সোমালীয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন সাহসী তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানেই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মানসিকতার বিভাজন স্পষ্ট। পাশ্চাত্যের কোনও মেয়ে তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষকে খুঁজতে কখনওই এমন ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা করবে না। কারণ একজন হারিয়ে গেলে আরেকজনকে সে খুঁজে নেবে। তাদের কাছে হৃদয়ের মূল্য বড়ই গৌণ। 

অপরদিকে সুজানা বহন করছে প্রাচ্যের উত্তরাধিকার। সঙ্গত: কারণে তার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা অন্যরকম। ইউরোপীয় সমাজ বিরাট এক দাবার ছক। ছকে অনেক গুটি, এমনই এক গুটি সুজানা। খেলার নিয়মেই খেলে চলেছে। এ খেলায় হৃদয় বলে কি কিছু আছে? হয়তো নেই। 

অষ্টাদশ শতকের দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট স্পষ্টতই বলেছেন- হৃদয়ের চিন্তা শক্তি নেই। হৃদয়ের কাজ রক্ত শোধন করা। শোধিত রক্ত শিরা উপশিরায় পৌঁছে দেয়া। ভয়-ভীতি অনুভূতি শিহরণ ঘোর সবইতো মস্তিস্কের ব্যপার। 

সুজানাও তেমনি এক ঘোরের ভেতর আছে। এই বয়সে মস্তিষ্ক হয়তো ঘোরের ভেতরই থাকে। তার বিদ্যালয়ের প্রশাসক স্বদেশী বক্কর খান সুজানা-আহমেদের সম্পর্কের বিষয়টি জানতেন। তিনিও নিরুৎসাহিত করেন সুজানাকে সোমালীয়ায় যেতে। কিন্তু সুজানা অনড় থাকায় তিনিও সুজানার সঙ্গী হন সোমালিয়ার পথে। 

স্টকহোম থেকে সোমালীয়া যাওয়ার বর্ণনাটি এককথায় চিত্তাকর্ষক এবং রোমাঞ্চকর। পদে পদে উত্তেজনা আর বিপদসঙ্কুল পথ পেরিয়ে একদিন সুজানা ঠিকই পৌঁছে যায় পুন্তল্যান্ডে অবস্থিত আপার ট্রায়্যাংগালের মত দুর্গম ও ধূসর মরভূমির এক রাজ্যে। কিন্তু তারপর...। 

সুজানা কি আহমেদের দেখা পায়....? জানতে হলে বইটি পড়তে হবে। বালিহাঁসের ডাক বইটি প্রকাশ করেছে অঙ্কুর প্রকাশনী।

লেখক পরিচিতি
লেখক ও অনুবাদক লিয়াকত হোসেন দীর্ঘদিন সুইডেনপ্রবাসী। তিনি সুইডিশ জার্নালিস্ট ইন্সটিটিউট থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। শিক্ষাজীবন কেটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ষ্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি সুইডিশ সাহিত্যের কালজ্বয়ী কিছু বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অনুবাদসহ তার প্রকাশিত বই ১৪টি। অনুবাদে অবদানের জন্য ষ্টকহোম স্থানীয় সরকার থেকে ২০০৪ সালে লাভ করেন ‘সাহিত্য পুরস্কার’। 

সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য লেখক সুইডিশ রাইটার্স ইউনিয়ন থেকে লাভ করেন কার্ল তত্ত্বে ও আস্ট্রিদ স্মরণে ‘আস্ট্রিদ পুরস্কার’ (২০০৯)। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি এই সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হন। সুইডিশ রাইটার্স ইউনিয়ন, সুইস রাইটার্স হাউজ, বাল্টিক রাইটার্স গিল্ড,  গ্রিস রাইটার্স হাউজ, রোডোস রাইটার্স সেন্টার, জুরিখ রাইটার্স হাউস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আমন্ত্রণে বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। 

ভ্রমণ করেছেন ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, গ্রিস, রোডোস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, সুইটজারল্যান্ড, ভারত, মালাউই, চেকাস্কোলোভোকিয়া, অস্ট্রিয়া, ক্রোয়েশীয়া, বসনিয়া, মন্টিনিগ্রো, মরোক্কো, স্পেন, সৌদি আরবসহ প্রভৃতি দেশ। 

এনএস/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি