শ্রাবণী
প্রকাশিত : ১৮:১৫, ১৭ এপ্রিল ২০২০
মোহাম্মদ একরাম হোসেন
ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। দেখতে দেখতে রাস্তায় হাঁটু পানি জমে গেছে। জহির একবার ভাবল আসবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আসতে হলো। সে দুইশত টাকা দিয়ে শ্রাবণীর জন্য একটি বই কিনেছে। সে বই নিয়ে আসা। জহিরের আজকে আসাটাই বোকামী হয়েছে। এখন এই পানি নামা পর্যন্ত তাকে বসে থাকতে হবে। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট ভিজিয়ে তো সে শ্রাবণীদের বাসায় গিয়ে উঠতে পারে না। শ্রাবণীর সাথে পরিচয় মামুনের মাধ্যমে। মামুনের নাকি দূর সম্পর্কের আত্নীয় হয়। জহিরের মনে হলো এই মেয়ের সাথে পরিচয় না হলে তার জীবনটাই বৃথা হয়ে যেত। এত অদ্ভুত মিষ্টি ভাষায় কথা বলতে জহির এর আগে কাউকে কখনো দেখেনি।
জহিরের ধারণা এই মেয়ের দিকে যে একবার তাকাবে সে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে পারবে না। জহির যেদিন প্রথম শ্রাবণীদের বাসায় গেছে সেদিন শ্রাবণী পরেছে আকাশি কালারের একটি শাড়ি। তার সাথে মিলিয়ে নীল একটা টিপ ও নীল কালরের রিবন। আজকালকার মেয়েরা সবকিছু মিলিয়ে মিলিয়ে পরে। তাদের এক একটাকে দেখতে পরীর মত মনে হয়। এই মেয়ে যদি শাদা শাড়ী পরত তাহলে আরেকটু পরী পরী দেখাত। এখন অবশ্য দেখাচ্ছে নীল পরীর মতো। তখন দেখাত স্বেত পরীর মতো। পরীরা কোন রংঙের হয় জহির জানে না। একবার পরী দেখতে পারলে ভাল হতো। পরী দেখার শখ তার অনেক দিনের। পরীর সাথে দেখা হলে আবশ্য সে কিছুকক্ষণ আলাপও করে নিত। কোন কোন মেয়েকে দেখলে ধক্ করে বুকে একটা ধাক্কা লাগে। বুকের ভেতরে চাপ চাপ একটা ব্যথা হয়। মনে হয় কি যেন নেই কি যেন নেই, জহিরের
এই একুশ বছর বয়সে মনে হল কোথাও যেন তার একটা ভুল হয়ে গেছে।
শ্রাবনী একবার জহিরদের বাসায় আসবে বলেছিল, জহিরের সে কি হুলস্থুল কান্ড! তাদের ভাড়া বাসায় নিজেদের টাকায় চুনকাম করা হলো। চুনকাম ঠিকমত করা যায়নি, আস্তরসহ ঝরে ঝরে পড়ছে। ক্যাঁচর কোচঁর করা চেয়ারদুটি ফেলে দিয়ে নতুন একজোড়া চেয়ার কিনেছে। টেবিলের উপর সুন্দর প্রিন্টের একটা রবার লাগানো হলো। জহিরের ছোট বোন রিনি তার মার বিছানার কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বলল, মা ভাইয়ার কি বৌ আসবে? জহির পাশের রুম থেকে তার কথা শুনছিল। লজ্জায় একেবারে তার মাথা কাটা যাবার মতো অবস্থা। শ্রাবণী অবশ্য আসেনি। আসলে জহির লজ্জায় মরে যেত।
জহির মাঝে মাঝে তার কাছ থেকে বই নিয়ে আসে। অবশ্য পড়তে আনে না। তার কাছে যাবার একটা উপলক্ষ্য মাত্র। জহির নানা উপলক্ষ্য তৈরী করে যায়। উপলক্ষ্য তৈরী করার প্রয়োজন হয় না। শ্রাবণী হাসি মুখে বসতে বলে নিজের হাতে চা বানিয়ে আনে। চা খেতে খেতে গল্প গুজুব করে।
প্রথম মাসের বেতন পেয়ে জহির একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসে। সে সাড়ে সাতশ টাকা দিয়ে একটা শাদা শাড়ি কিনে ফেলল এবং অত্যন্ত কাব্যিক ভাষায় শ্রাবনীকে বলল, তোমাকে কেন জানি পরীর মতো লাগে তাই তোমার জন্য এই শাদা শাড়িটা নিয়ে এলাম। শ্রাবণী চোখ কপালে তুলে বলল, এত টাকা কোথায় পেলে?
বেতন পেয়েছি। তোমাকে বলা হয়নি আমি একটি চাকরি পেয়েছি।
চাকরি পেয়েছো ভাল কথা আমাকে জানওনি কেন?
জানানোর মত কিছু না, সামান্য বেতন। এ জন্য জানাইনি।
এখন অবশ্য জহিরের বেতন বেড়েছে। কাঁচুমাচুঁ স্বভাবের একটা ছেলে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতন পাচ্ছে ভাবতেই অবাক লাগে। জহিরের ধারণা তাকে কেউ পছন্দ করে না। বিশেষ করে জি এম সাহেব । জহিরকে অবাক করে দিয়ে জি এম সাহেব একদিন তাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন এবং অত্যান্ত কোমল গলায় বললেন, তোমার কাজকর্মে আমি ভীষন খুশি। চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে ভালো করতে পারবে। জহিরের আনন্দে চোখে প্রায় পানি এসে যাচ্ছিল। তার মা ছাড়া তার সাথে এমন কোমল গলায় কেউ কখনো কথা বলে না। এই প্রথম বাইরের একজন মানুষ তার সাথে কোমল গলায় কথা বলল।
জহির প্রতিবারই চাপা উদ্বেগ নিয়ে শ্রাবনীদের বাসায় ঢুকে। তার ধারণা শাদা শাড়িতে শ্রাবনীকে একেবারে শ্বেত পরীর মত মনে হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় শ্রাবনীকে আজ পর্যন্ত তার দেয়া শাড়িটা পরতে দেখা যায়নি। রূপবতী মেয়েদেরকে শাদা শাড়িতে প্রচন্ড রকমে মানায়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো কেন জানিনা মেয়েরা শাদা রং অপচন্দ করে। তার এক ফুফাতো বোন শাদা শাড়ি পরে থানা মিলনায়তনে নৃত্য পরিবেশন করেছিল। নাচার সময় এই শ্যমলা মেয়েকে কি অপূর্বইনা মনে হয়েছে।
জরিরকে হকচকিয়ে দিয়ে শ্রাবনী বলল, তোমার দেয়া শাড়িটা পরেছি, কী রকম লাগছে? জহির অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না। শুধু পরপর দু’টা ঢোক গিলল। জহির এতদিন যা ভাবছে তার চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর লাগছে। তার কাছে মনে হলো এই মেয়ে পৃথিবীর কোন মেয়ে না। এ হচ্ছে স্বর্গের মেয়ে। ভুল করে এ পৃথিবীতে চলে এসেছে। জহির অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলল, ধর এই বইটা তোমার জন্য এনেছি।
শ্রাবনী নিঃসংকোচে বইটা নিল এবং বলল, জহির ভাই আমি একটা দ্বন্ধে আছি, বুঝে উঠতে পারছি না কি করব। এই প্রথম শ্রাবণী জহিরকে ভাই বলল। বলতে বলতে তার গলা ধরে এল। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। কান্না জড়ানো কন্ঠেও অদ্ভুত মিষ্টি স্বরে বলল, জহির ভাই আপনি আমাকে ভালবাসেন কিনা জানি না কিন্তু আমি নিজের অজান্তে আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি।
জহির লক্ষ্য করল শ্রাবণীর চোখের নিচে কালি পড়েছে। কাজলও সেই কালি ঢাকতে পারছে না। শ্রাবণী ভেজা গলায় বলল, জহির ভাই আপনি এত বোকা কেন? ধরুন আমার হাতটা ধরুন। শ্রাবণী গভীর ভালোবাসায় তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। জহির সে হাত ধরবে কিনা বুঝতে পারছে না। ইচ্ছা করলেই পরীর মতো একটা মেয়ের হাত ধরা যায় না। সে ভাবছে সে কি করবে।
এসি/এমএস/