’জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নারী’ ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত
প্রকাশিত : ১৮:১৫, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০
নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে ওয়েবিনার ‘জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নারী’’। সভাপতি ছিলেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ও বহুমাত্রিক লেখক ড. রকিবুল হাসান। সঞ্চালনা করেন বাংলা বিভাগের শিক্ষক শারমিন জামান তন্বী। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আনন্দ মোহন সরকারি কলেজের অধ্যাপক কবি আল মাকসুদ।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত সচিব কবি ও গবেষক কাবেদুল ইসলাম। সম্মানিত অতিথি ছিলেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. শাহাদত কবীর, বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি ও গবেষক ড. নাসিমা আকতার। আলোচনা করেন প্রফেসর ড. মাহবুব রাব্বানী, ড. শাফিক আফতাব ও ড. জ্যোৎস্নালিপি।
মূল প্রবন্ধে কবি আল মাকসুদ বলেন, কবিতায় নারী অন্যতম অনুষঙ্গ। কবিতা শব্দটিই নারীবাচক। নারী এখানে প্রসন্ন দ্যুতির প্রতীক। তবে বিষণ্নতা তার মহিমা। জীবনানন্দ দাশ কবিতায় নারীকে ব্যক্তিক করে তুলেছিলেন; মানে তাঁর নারী নৈর্ব্যক্তিক নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘হঠাৎ দেখা’ ‘কৃষ্ণকলি’র চিত্রিত নারী ব্যতীত সবাই অধরা নৈর্ব্যক্তিক। জীবনানন্দের কবিতায় কখনো একই নারী বিভিন্ন নামে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি-মানসের অন্তঃশীলিত বেদনাবোধকে তিনি আড়াল করতে চাননি। তাঁর প্রেয়সী বা কাব্যনারী কুয়াশাবৃত কিন্তু রাবীন্দ্রিক অধরা মানসী নয়; বরং দেখি তিনি সখেদে উচ্চারণ করেন: ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,/ অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,/ ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমোনুষেরে (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ৭৯)।
তাঁর সমকালীন কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্ল্যাটোনিক ছিলেন না মোটেও। তবে জীবনানন্দ দাশ কি প্ল্যাটোনিক ছিলেন? এখানে একটি প্রমাণ দাঁড় করানো যায়- ‘... তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’। অভিমানক্লান্ত প্রশ্ন। এবং খুবই কাছাকাছি হয়েই এ প্রশ্ন করা হয়েছে- তাও আবার অন্ধকারে। এখানে প্ল্যাটোনিক থাকার সুযোগ ছিলো কি? অন্ধকারে যাকে দেখলেন, তিনি পূর্ব পরিচিতা; অন্ধকার নামলেও তখনো খুব কাছ থেকে কারও মুখের আদল চোখ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে; যেমন- ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’ অন্ধকারে দেখা ‘বনলতা’র চোখ চুল মুখ কবির কাছে বিভিন্ন উপমা পেয়েছে। কবি প্রেমিক, অন্তর্দ্রষ্টা- এটা মানলে অবশ্য কোনো বিতর্ক থাকে না।
জীবনানন্দ দাশের নারী-ভাবনার দুটি স্তর :
সংশয় ও স্বস্তির :
আমারে চাও না তুমি আজ আর,-জানি;/ তোমার শরীর ছানি/ মিটায় পিপাসা/ কে সে আজ!- তোমার রক্তের ভালোবাসা/ দিয়েছ কাহারে! (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২: ৯৯)
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,/ বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;...ফিরে এসো হৃদয়ে আমার(আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ২০৫)
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ১৫৩)
স্মৃতির সাম্পানে- দূর-অনতিদূরের :
এলোমেলো কালো চুল খ’সে গেছে খোঁপা তার,- বেণী গেছে খুলি!/ সাপিনীর মতো বাঁকা আঙুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ,/ ভেঙেছে নাকের ডাঁশা,-হিম স্তন,-হিম রোমকূপ! (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২: ২৬)
যে কামনা নিয়ে মধুমাছি ফেরে বুকে মোর সেই তৃষা!/ খুঁজে মরি রূপ, ছায়াধূপ জুড়ি,/রঙের মাঝারে হেরি রঙডুরি!/ পরাগের ঠোঁটে পরিমল-গুঁড়ি-/ হারায়ে ফেলি গো দিশা! (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ৪৬)
তুমি তো জান না কিছু, না জানিলে,-/ আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে! (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২: ৫৫)
চোখে তার / যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!/ স্তন তার/ করুণ শঙ্খের মতো –দুধে আর্দ্র,- কবেকার শঙ্খিনীমালার! (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ১৫৮)
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে/ অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখেনি (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২: ১৫৮)
এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন/ তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো;/ সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে/ সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত। (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ১৬২)
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের-ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;/মনে আছে/’ শুধাল সে-শুধালাম আমি শুধু ‘বনলতা সেন?’ (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ১৬৯)
আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে;/বলেছিল :‘এ নদীর জল/ তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল;(আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২: ৫৯৮)
যে নারীর মতো এই পৃথিবীতে কোনো দিন কেউ/ নেই আর – সে এসে মনকে নীল- রৌদ্রনীল শ্যামলে ছড়ালো।/ ভুলে গেছি পটভূমি- ভুলে গেছি কে যে সেই নারী/ আজকে হারিয়ে গেছে সব; (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ৬০১)
উপর্যুক্ত কিছু দৃষ্টান্তের আলোকে এই প্রতীতি জন্মে জীবনানন্দ কাব্যঅভিসারে নারীকে প্ল্যাটোনিক ভাবেননি। তারা রক্তমাংসের। তাদের লাবণ্য-মাধুরী কবির অন্তঃসত্তাকে আলোড়িত করেছে। তারা কবিকে আচ্ছন্ন করে থাকতো বেলা-অবেলায়। তবে, এদেরকে নিয়ে জীবনানন্দের শারীরবৃত্তিক বাসনা ভালগার হয়ে উঠেনি কোথাও; বরং আত্মসর্বস্ব বিলীন করে দিয়ে এক মোহময় স্বস্তির জয়-মধুরিমা খোঁজে পাওয়ার সাধ জাগে-এই কবিতাসমূহ পাঠান্তে। কবিতার নারী আর জীবনের নারী এক ও অভিন্ন কি? এই নিয়ে তর্ক আছে বিস্তর। জীবনানন্দ তাঁর শোভনাকে (খুড়তুতো বোন) কবিতার হৃৎসূত্রই মনে করতেন বলে মনে হয়। উচ্চারিত সুন্দরের মতো তিনি নারীকে দেখেছেন। আর, অবলোকন করেছেন একজন কামনা-তাড়িত তৃষিত পুরুষের মতো। একটু স্মরণ করি পুনঃ : [...]এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন/ তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো;/ সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে/ সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত। [...] (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২: ১৬২)
ব্যথাদীর্ণ হৃদয়ের আর্তি : ‘জানি আমি তোমার দু চোখ আজ আমাকে খোঁজে না/ আর পৃথিবীর ‘পরে- (আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০১২ : ১৭৩)
জীবনানন্দ সর্বার্থেই কাতর-প্রেমিক; গৃহী কিন্তু অসুখী। এই অসুখী গৃহীরূপ তাকে প্ররোচিত করেছে, কবিতায় ‘তুমি’ এবং ‘নারী’কে বিশেষায়িত করতে। এ ভাবনা হয়েতো কবিমাত্রই থাকে। সুখী অসুখী কোনো প্রেরণা-সত্য নয়। হতে পারে- তবে জীবনানন্দের নারীরা (বনলতা শঙ্খমালা সুরঞ্জনা শ্যামলী সুচেতনা) লাবণ্যের প্রতিরূপ হয়ে,- শোভনার ছায়াসঙ্গী হয়ে এসেছে বলে তারা সবাই সুনিপুণা, কান্তিমতী, কামনাময়ী। তাঁর বোধ-পরিধি যে নারীকে দেখেছে এবং ভেবেছে- সে শুধু কল্পনার আঁধারাচ্ছন্ন কেউ নয় বলে মনে করি। তাঁদের সাথে তাঁর মনোদৈহিক সংযোগ ছিলো-, এতে তার বর্ণনার যোগফলে কোনো ভুল থাকে না; বরং যাকে পরাবাস্তব বলে চালিয়ে দিই- তা অনেকটাই ডাহা মিথ্যে হয়ে পড়ে।প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করতে পারি তাত্ত্বিক বেগম আকতার
কামালের এই উক্তি :
‘জীবনানন্দ ছিলেন কিনারার মানুষ, অনেক কেন্দ্র বিনির্মাণ করে করে ক্লান্তি অবসাদ বিষাদে মগ্ন হয়েছেন, অস্ত্বিত্বের অবলুপ্তিও ঘটাতে চেয়েছেন মাঝে মাঝে। এই প্রসারণশীলতা, ক্রিয়ামানতা আর কেন্দ্র-সন্ধিৎসা তাঁকে স্থিরতর থাকতে দেয়নি বলেই বারংবার স্থিরতা লাভের কাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। (বেগম আকতার কামাল ২০১৮ : ৩৮)।
প্রবন্ধপি পাছঠর পরে আলেঅচকবৃন্দ সাবলীল প্রাণবন্ত ও মনোগ্রাহী আলোচনা করেন। তাতে জীবনাননন্দ দাশের কবিতায় নারী বিষয়ক নানা প্রশ্ন যেমন উপস্থাপিত হয়েছে, আবার তাদের প্রকৃত ও বাস্তবস্বরূপও আবিষ।কারের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতার নারীরা-জীবনানন্দ দাশের কবিতার নারীদের সাথে তাদের মিল-অমিল-বহুমাত্রিকতা।
আরকে//