বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প-সাহিত্য চর্চা
প্রকাশিত : ২০:১১, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ২০:১২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
যে কোনো দেশ বা জাতির আত্মপরিচয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিল্প-সাহিত্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। বাঙালির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। এদেশে বর্তমানে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ধারা তৈরি হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ব্রাহ্মণীয় সম্মানে বা জাতে উঠতে পারেনি বলে অনেকে মনে করেন। আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্রাহ্মণীয়’ অনেক শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত আছেন। ফলে এখানেও একটা মিশ্রণ প্রক্রিয়া আছে।
কালের যাত্রায় এদেশে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একদিন উচ্চশিক্ষাঙ্গনে নেতৃত্ব দেবে সেদিনও হয়তো বেশি দূরে নয়, আবার খুব কাছে সেটাও বলতে পারি না। তবে সম্ভাবনা ব্যাপক। এসব উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বাংলা ভাষা-শিল্প-সাহিত্য কতোটা নিষ্ঠার সাথে চর্চা হয় সেসবও ভাবার ব্যাপার। গতানুগতিকভাবে যা চলে আসছে, অনেকটা সেভাবেই চলছে। কোন প্রবল তরঙ্গাভিঘাতের সৃষ্টি করতে পারছে সেরকম কিছু বোধগম্য হয় না। এ আলোচনা মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প-সাহিত্যের চর্চার ব্যাপারটি নিয়েই। তবে তার আগে বাংলা শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে সামান্য আলোচনা জরুরি মনে করি। যেখানে বাঙালির শেকড় প্রোথিত।
আমরা প্রায় সবাই জানি, বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। চর্যাপদের পরে দেড় শত বছর বিশেষ করে ১২০০ খ্রি. থেকে ১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ হিসেবে অভিহিত হলেও, বর্তমানে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই সময়কালের মধ্যে রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরান’, হলুয়াদ মিশ্রের ‘সেক শুভোদয়া’, ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ ও ‘দোঁহাকোষ’ প্রভৃতি আবিষ্কারের খবর বোদ্ধামহলের প্রায় সবাই জ্ঞাত। এরপরে বড় চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’ বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ আর এক আবিষ্কার। চর্যাপদ থেকে ভাষা ক্রমান্বয়ে সহজ ও সাবলীল হয়ে উঠেছে এসব কাব্যগ্রন্থে। মধ্যযুগের অবসান ঘটে প্রবল প্রতাপশালী মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নবসৃষ্টিতে। বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ তার হাতেই। এর পর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ সহ অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে দেশ পেরিয়ে-দেশের বাইরেও উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যেমন সময়ের স্রোতধারায় ক্রমধারায় বিকশিত হয়েছে, এই ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ নোবেল পুরস্কার লাভ করেছে, আবার এই ভাষার মর্যাদা রক্ষায় এ দেশের সূর্যসন্তানেরা রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে জীবন দিয়েছে। এমনি এমনি এই ভাষাটা আমরা পাইনি।
এই ভাষার শরীরে এদেশের সোনার টুকরো সন্তানদের বুকের তাজা রক্ত লেগে আছে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীকারের আন্দোলন অগ্নিরূপ ধারণ করে তা মুক্তিযুদ্ধতে পরিণত হয়েছিল, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল। ’৪৭ এর দেশভাগের সময় বাংলাকে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাকে ভারতের সঙ্গে রেখে, শুধু পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এই পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক তেইশ বছর ভয়াবহ দুঃশাসনের শিকার হয়েছে। আমাদের ভাষার অধিকার হরণের নির্লজ্জ চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের শিল্প-সাহিত্যের উপর আগ্রাসন চালানো হয়েছে। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর বহুবার বহুভাবে বহুকৌূণিক রাজনৈতিক আঘাত এসেছে। কিন্তু এদেশের মানুষ তার নিজের ভাষা-শিল্প-সাহিত্যে কখনো কোন আপস করেনি। নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেনি। হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এসব জাতধর্মের চেয়ে বড় উঠেছে বাঙালির বাঙালিত্ব। এটি আমাদের প্রাণের মূল শক্তি। যত সংকট আসুক, যত সমস্যা আসুক বাঙালির শক্তি তার ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের চেতনা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষিত কি? এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক। আমরা কি আগের চেতনায় অটুট আছি নাকি সময়ের সাথে আত্মবিক্রয়ে উন্মাদ আনন্দে মেতে উঠেছি, অন্যের ভাষা-শিল্প-সাহিত্যে পরনির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি? আমাদের ভবিষ্যৎ বলতেও কি সেই ব্যাপারটিই ধ্যান-ধারণায় গুরুত্ব পাচ্ছে? আমাদের শিল্প-সাহিত্য নিজেদের কাছে কতোটা আদরণীয় নাকি অবহেলা-অবজ্ঞা-তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয় হয়ে উঠেছে এ প্রশ্ন এই সময়কালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এসব চেতনা কতোটুক ধারণ করে, আদৌ করে কিনা, তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে এসব বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত আছে কিনা, ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করছে কিনা, এসব চর্চার ভেতর শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলছে কিনা, এসব এখন সময়ের শাণিত প্রশ্ন। রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা এখন পণ্য হিসেবে অংকের খাতায় যুক্ত হয়ে গেছে। মানববিদ্যা ব্যাপারটি এ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রযোজ্য মনে করে না। অবক্ষয়ের ভয়ঙ্করতা এ সুযোগটিই গ্রহণ করে আমাদের মধ্যবিত্ত আদর্শিক জীবনব্যবস্থাকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ফলে শিক্ষা হয়ে উঠছে পুঁজি বিকাশের হাতিয়ার।
বাংলাদেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবল এক জোয়ার চলছে। দিন যত এগুচ্ছে, সংখ্যা বাড়ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের মাতৃভাষা-শিল্প-সাহিত্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়, আদৌ হয় কিনা, এসব খুব কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। কোথাও কোথাও এসবের সাথে যুক্ত থাকার আনন্দদায়ক ও বেদনাদায়ক স্মৃতিও আছে। দেশে বর্তমানে ১০৬ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যমান। বেশিও হতে পারে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টিতে বাংলা বিভাগ আছে? কয়টিতে বাংলা পড়ানো হয়? শিল্প-সাহিত্যের চর্চা কি হয়? আমার জানা মতে, হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু আছে। সেগুলোরও আবার সব কয়টিতে পূর্ণ বাংলা বিভাগ নেই। ইউজিসি বেসরকারি প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগেই ১০০ নম্বরের ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ ও ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ নামে দুটি পূর্ণ কোর্স পড়ানো বাধ্যতামূলক করলেও, এটা কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকরি হয়েছে? অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই কোর্স দুটি পড়ানো হয় না। কেন হয় না? হয় না এ কারণেই সবার ধারণা বাংলা পড়ে কি হয়? বাংলা আবার পড়ার মতো কোন ব্যাপার হলো? বাংলা পড়িয়ে তো টাকা আসে না। আর ও তো আমরা জানিই। যেটা ভয়াবহ, তাহলো বাংলা পড়ালে তো পুঁজি বাড়বে না। ব্যবসা হবে না। ইউজিসি বারবার কেন যে এসব চাপ প্রয়োগ করে! পারলে তাদের নির্দেশনামা সীমানার বাইরে রাখে, যতদিন চালু না করে পারা যায়। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাসও সংশোধন করে অনুমোদনের জন্য পাঠায় না। কারণ ‘ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ ও ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ কোর্স দুটি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত না করলে সংশোধিত সিলেবাসের আনুমোদন ইউজিসি দেবে না। ফলে সিলেবাস না পাঠিয়ে জোড়াতালি দিয়ে যতদিন চালানো যায়। তবুও বাংলা পড়াবে না। চলছেও এভাবে। দু একটি ব্যতিক্রম ব্যতিত। অদ্ভুত। ভাবাও যায় না। সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে এভাবে চলছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। নিজের দেশ, নিজের দেশের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ন্যূনতম একটা ধারণাও শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে না। কোন সাবজেক্টের বাজারমূল্য বেশি, সেটি চালু করা বা সেটিকেই লালন-পালন করা তাদের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়। কারণ এতে পুঁজি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই কমবেশি এ কথা প্রযোজ্য। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে তারা ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় হোক বা বিশেষ কোন কারণেই হোক বাংলা বিভাগ চালু করেছেন। চালু রেখেছেন। সঙ্গে বন্ধ করে দেয়ার হুমকি ধামকিও আছে। প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একবার নড়ে উঠেছিল যখন হলি আর্টিজান জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। তার পর পরই সরকার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা, অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সঙ্গীত বাধ্যতার ভেতর এনেছিল। সে সময় বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ চালু করার কথা চিন্তা-ভাবনা করলেও সময়ের সাথে সাথে এখন তা প্রায় পুরোটাই নিভে গেছে। জাতীয় সঙ্গীত তখন অনুষ্ঠানে শুরুতে গাওয়া বা বাজানো হলেও, কিছুদিন পরে সেটাও আর চালু থাকেনি। পূর্বের অবস্থানে সব ফিরে গেছে। সে সময় বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে-বাংলা ভাষা নিয়ে-বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান লক্ষ করা গেলেও, তাও একসময় জলে ভেসে গেছে।
হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ বৈরিতার ভেতরও চলছে। সেখানে কর্তৃপক্ষের কপালে ভাঁজ পরা অবস্থার ভেতর দিয়েও দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কাজকর্ম হয়। যদি বাংলার শিক্ষকরা চরমভাবে বেতন বৈষম্যের শিকার। এরকম পরিস্থিতির শিকার যারা, তাদের কাছে বাংলা পড়াটা ‘পাপ’ হিসেবে যদি গণ্য হয় বা ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত বলে যদি বিবেচিত হয়, সেখানে এর বিপক্ষে জবাব মেলানো কঠিন আছে-যতই মন-মনন-শিল্পপ্রেমের দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে শান্তনার অমিয়ধারা নিবেদন করা হোক না কেন। ওসব একরকম ফাঁকিবাজি, জীবনযুদ্ধে নামলেই তা বোঝা যাবে, প্রকৃত সম্মানটাও সেখানে রক্ষিত হয় না। পেটে ভাত নেই-বাসা ভাড়ার টাকা হয় না-উসকুখুসকো শিক্ষকের যে ছবি আমরা দেখে আসছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষকরা কি এর চেয়ে ভালো আছেন? অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে-বিশেষ করে যেখানে বাংলা বিভাগ আছে-সেখানে একই যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য বিভাগের শিক্ষকের চেয়ে বাংলা বিভাগের বেতন তুলনামূলক অনেক কম। কেন? দারিদ্রের সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে শিল্প-সাহিত্যের সাধক তিনি! পেছনে উপহাস আর অবহেলা। তবুও কিছুই না হওয়ার চেয়ে কিছু হওয়া ভালো। এ সব বিশ্বববিদ্যালয়ের বিশেষ করে যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ আছে, তাদের শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচক বিবেচনা করলে, হতাশার পরিবর্তে কিছুটা হলেও আশার আলো অনুধাবন করে নেয়া যায়। যদিও সেসব কর্মকাণ্ড কর্তৃপক্ষের তুচ্ছতাচ্ছিল্য আছে, দয়া দেখানোর মতো একটা ভাব আছে। বৈষম্যমূলক আচরণ আছে। ‘দেখানো’র একটা নাটক আছে। দেখানোটা কি? বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা ধারণ করে। যদিও ভেতরে ভেতরে বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের রীতিমতো শোষন করা হয়-অগুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। এরপরও এটাকে ভালো দিক বলেই মানতে চাই। অন্তত বাংলা বিভাগ তো চালু করেছে-টাকা-পয়সা যেটুকু দেয় দিক। বাংলার শিক্ষকেরা তো উদার! ক্ষুধা সহ্য করার অপরিসীম ক্ষমতা তাদের রয়েছে। বিধাতা প্রদত্ত এ শক্তি অন্য বিভাগের শিক্ষকদের নেই-বোধ হয় সে কারণেই তাদের সুযোগসুবিধা অত্যাধিক পরিমাণে প্রদান করা হয়। ব্যাপারটা কি সত্যি তাই? আমি বলি-অপমান-রীতিমতো অপমান-নিজের মাতৃভাষার প্রতি। আর যারা বাংলা পড়ানোটাই প্রয়োজন মনে করে না, তাদের জন্য নিবেদিত মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিমের কবিতা- ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী? সেসব কাহার জন্ম র্ণিয় ন জানি’।
যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ আছে. সেখানে বাংলাটা পড়ানো হয়। বাঙালি সংস্কৃতি পড়ানো হয়। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য পড়ানো হয়। বিদেশি সাহিত্যও কমবেশি পড়ানো হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান-সমাজবিজ্ঞান-তথ্যপ্রযুক্তি পড়ানো হয়। ইংরেজিও পড়ানো হয়। মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলসহ বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী এবং তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। কিছু শিক্ষার্থী হলেও তাদের মনে-মননে-স্বপ্নে নিজের ভাষা-নিজের দেশ-নিজের সংস্কৃতিবোধ গড়ে ওঠে। যখন নিজের ভাষা পর-ভাষার রাহুগ্রাসের শিকারে পরিণত হয়, পেশাদারিত্বে যখন নিজের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি গুরুত্বহীন হয়-বাঙালি মূল্যবোধ যখন অবক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যায়-ভোগবাদি স্বার্থান্ধ সমাজ যখন ভয়ঙ্কর বিষধর ফণা তুলে দংশন করে, তখন কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ছোট ছোট আয়োজনগুলোকে আর ছোট ভাবার সুযোগ থাকে না- ক্ষুদ্রভাবে দেখার সুযোগ নেই। আলোটা হয়তো অনেক বড় নয়, আলোর জ্বালানি হয়তো অনিচ্ছায় দেয়া হচ্ছে-তবুও তো আলোটা জ্বলছে-জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে, সেটা মঙ্গল ও কল্যাণের আলো হিসেবেই জ্বলছে। এটাকে অনেক বড় করে দেখতে চাই। অনেক বড় কৃতিত্ব দিতে চাই। সেই অনিচ্ছাকেও সম্মান জানাই। বেসরকারি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই জার্নাল প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাংলা গবেষণা পত্রিকা কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়? এক দুই করে তিন চার করে এর বেশি খুব একটা এগুবে না। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। ভাবা যায়, বাংলা ভাষাচর্চা বিকাশের পথ কতো দৈন্যে ভরা-কতো বিদীর্ণ বাংলার বুক। তবুও আলো দেখতে চাই। দু চারটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলেও তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা বেরোয়-হোক তা নিয়মিত কিংবা অনিয়মিত। এটা করতেও বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা ও অবজ্ঞাকে ভালোবাসা ভেবে গ্রহণ করে নিতে হয়। কবিতাপাঠ, সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা-শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে সেমিনার-একক বক্তৃতা- কিছুটা হলেও হয় তো। হয় বলেই তো সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো মনীষী বারবার ছুটে গিয়েছেন। জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, বিখ্যাত কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, কবি রুবী রহমান, কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন, কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী, অধ্যাপক জুলফিকার মতিনের মতো দেশবরেণ্য মনীষীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত হন। বাংলা শিল্প-সাহিত্যচর্চাটাকে তাঁরা ভালোবাসেন বলেই তো এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাণের টানে ছুটে আসেন। এটাই বাঙালির শেকড় ও শক্তি। কোনভাবেই এটাকে উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু বাস্তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা চরমভাবে উপেক্ষিত-এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এর পরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈশাখী উৎসব, বসন্তবরণ, পিঠা উৎসব-এসবের আয়োজন হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহীদ মিনারে পুষ্প অর্পণে খুব একটা গুরুত্ব না থাকলেও লোক দেখানোর মতো আলোচনার আয়োজন থাকে।
একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমি কয়েক বছর আগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেই। তার আগে অন্য আর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দেয়ারই প্রচলন ছিল না। দিনটা পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থাকতো। একুশে ফেব্রুয়ারির পরে কোন একদিন একটা আলোচনা অনুষ্ঠান করেই দায়িত্ব শেষ হতো। তাতেও যতো কম টাকা ব্যয় করা যায়। অথচ অন্য কোন বিভাগের সামান্য একটা সেমিনারেও এর চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ বরাদ্দ থাকতো। নতুন দায়িত্ব নিয়ে যখন অন্য আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি, এখানে এসে যখন জানলাম, একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়, মনটা ভরে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়টার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। যোগদানের পরে প্রথম ফেব্রুয়ারি আমরা বিভাগের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের লেখা সংবলিত দেয়ালিকা প্রকাশ করলাম-শিক্ষার্থীদের কবিতা নিয়ে কবিতা সংকলন করলাম-কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাব্যগ্রন্থ বের করার ব্যবস্থা করলাম পরিচিত বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে। পুরো বইমেলা মাস জুড়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের আনন্দমুখর পদচারণা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব তরুণ কবিদের জন্য ছোট পরিসরে অভিবাদন জানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তাদের ফুল দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিল। ভালো আপ্যায়ণ ছিল। এতে দারুণ অনুপ্রাণিত হলো এসব শিক্ষার্থী। মনে হলো কবিতার দাম আছে-কবি’র সম্মান আছে-বুক ফুলে মাথা উঁচু করে শিক্ষার্থী-কবিরা ক্যাম্পাসে গর্ব করে হাঁটতে পারে। আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ই লোকসানের কারণ দেখিয়ে কয়েকবার বাংলা বিভাগ বন্ধ করার উদ্যোগও নিয়েছে। বাংলার শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম দেয়া হয়। কোনরকমে ‘জান’টা যেন থাকে-অনেকটা সেরকম। যা হোক, একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল সাতটায় ক্যাম্পাসের অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্প অর্পণের সিদ্ধান্ত হয়। সাড়ে ছয়টায় আমি, আমার স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে যখন ক্যাম্পাসে গিয়ে উপস্থিত হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে তালা ঝুলছে। একটা মানুষও নেই। নিজের কাছে ভালো রকমের একটা ধাক্কা খাই। যে ছবিটা কল্পনা করে এসেছি, তার সাথে পুরোটাই অমিল, আমরা ফুল হাতে দাঁড়িয়ে মূল ফলকে ধাক্কা দিতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে এটা খোলা হয়। একটু পরেই বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করে। সাড়ে সাত আটটার দিকে বড় বড় কর্মকর্তা এলেন-সব মিলে পনের-বিশ জন। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দশ হাজার বলে গর্ব করা হয়। আড়াই শ’র বেশি শিক্ষক-কর্মকর্তা। সেখানে এই হলো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশের ভোরের ছবি। তবুও তো এখানে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধায় পুষ্প অর্পণ করা গেলো। এক দেড়শ গজ পথ ঘুরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গাইতে তো পারলাম। হোক পনের বিশ জন। কিন্তু ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় এতটুকুও করতে পেরেছে বা করেছে? পরবর্তীতে আমি উপাচার্য মহোদয়ের মিটিংয়ে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, নিয়ম করে দেয়া হয় একুশের ভোরে শহীদ মিনারে প্রত্যেক বিভাগ থেকে ন্যূনতম পঞ্চাশজন শিক্ষার্থী এবং প্রত্যেক বিভাগের প্রধান ও ন্যূনতম দুজন করে শিক্ষক অংশ করবে। উপাচার্য-উপউপাচার্য-ডিন-রেজিস্ট্রার তো থাকবেনই। আর বাংলা বিভাগের সমস্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। ভাষা আন্দোলন কি শুধু বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য? অন্যদের কেন নিয়মের ভেতর বেঁধে উপস্থিত করানো? অবাক করার মতো ব্যাপার পরের বারে একুশের ভোরের দৃশ্য অবশ্য গতবারের থেকে খানিকটা হলেও ভিন্ন হয়ে ওঠে। বাংলা বিভাগের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে অন্যদের উপস্থিতি মিলে দেড় দুশো হতে পেরেছিল। এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। বাংলা বিভাগটা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকলে, এ দৃশ্যটাও হয়তো তৈরি হতো না। অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর ছবি দেখে অন্তত সে ধারণাই হয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিআর রিভিউ জার্নাল প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করলে, মিটিংয়ে তা উপস্থাপন করলে, ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘এসব হাবিজাবি করে শুধু টাকা নষ্ট। এসব করে কি লাভ? বাংলা কি পড়ার মতো কোন বিষয়? বাদ দেন এসব।’ উপাচার্য মহোদয়ের সহযোগিতায় একরকম প্রতিবাদ করে এর অনুমোদন নেয়া সম্ভব হলেও, প্রত্যেকটি সংখ্যা প্রকাশের আগে অনুমোদন নিতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হতে হতো-হাজার কথা শুনতে হতো। যেন পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষার জন্য যুদ্ধ! আসলে যুদ্ধটা যে চার চেয়েও বড়-সেই বোধ-তাড়না ও দায় নিয়ে, অবজ্ঞা অপমানকে ভালোবেসে এসব করতে হয়েছে। অথচ অন্য বিভাগগুলো কতো স্বাচ্ছন্দ্য ও কতো সম্মানের সঙ্গে তাদের জার্নাল করেছে। আমি যেন এসব করে এক ‘মহাপাপ’ করেছি, ভাবখানা এমন। আর আমার মাথার উপরে যারা বিদেশের বড় বড় ডক্টরেট-তারা নিজের চেয়ার বাঁচানোর জন্য মেরুদণ্ডহীন ‘অ্যামিবা’ প্রাণী হয়ে নীরব থেকেছেন-টু শব্দটিও করতে চান নি-যদি মালিকপক্ষ অখুশি হন-চাকরিটা যদি চলে যায়! আবার এরাই ভাষার আলোচনায় মহাবাক্য আওড়ান। অদ্ভুত সব ছবি! বিভিন্ন বিভাগের অনুষ্ঠানে বাইরে থেকে মান্যবর কোন অতিথি আনা হলে, তাদের জন্য ভালো অংকের সম্মানি-অর্থ বরাদ্দ থাকে। আপ্যায়নের উন্নত ব্যবস্থা থাকে। বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠানের অনুমতি পেতেই ‘মলনমলা মেওয়া’ গরুর মতো ঘুরতে ঘুরতে নাভিশ্বাস উঠে যেতো। অনুমতি মিললেও বরাদ্দ নেমে আসে তলানিতে, যা দিয়ে সাধাসিধে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করাই কঠিন হয়ে পড়তো। আপ্যায়নের মান কমে যেতো-সম্মানির অংক কমে যেতো-কোন কোন সময় থাকতোও না। বিশ্রিরকমের বৈষম্য। এসব নিয়ে মিটিংয়ে কথা বললে, ‘বলা হতো এসব রাজনৈতিক বক্তব্য থামাও।’ আচ্ছা, রাজনীতি ছাড়া কি কিছু হয়? ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-এসব কি রাজনীতির বাইরের কোন কিছু? আসলে দাসত্ব জিনিসটা এখনো মহারথিদের অনেকেরই পছন্দ। সাহিত্য পুরস্কারের আয়োজন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করায় এটাকে চমৎকারভাবে করা সম্ভব হয়েছে। কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটা একটা দারুণ ব্যাপার ছিল। দেশের দেড় দুশ কবি-সাহিত্যিককে একসঙ্গে সমবেত করে একটা মিলনমেলায় পরিণত করতে পেরেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেখানেও নীরবে বৈষম্যের একটা বিশ্রি ব্যাপার ছিল। বিশেষ কিছু কবি-সাহিত্যিক-যাদের দেশজুড়ে নাম, তাদের জন্য গোপনে একরকমের বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা, একটু কম নাম-করা কবি-সাহিত্যিকদের জন্য সাধারণমানের আপ্যায়ন-এসব বেদনাদায়ক ব্যাপারও হজম করতে হয়েছে। তবুও আশার আলো, থাকুক বৈষম্য, অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব তো করেই না, এখানে তো তবু হচ্ছে। এটাই বা কম কিসের!
করোনাকালের এই সময়কালে যখন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষা ও শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক কোন ওয়েবিনার করেনি, তখন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এবং এটা নিয়মিতভাবে এখনো আয়োজন করা হয়। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং ভারতের বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ এসব ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেন। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রায় প্রত্যেকটি ওয়েবিনারে যুক্ত থেকেছেন। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, খ্যাতিমান অধ্যাপক-কবি-গবেষক এসব ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে আরো দু একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি এ ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে, বাংলা শিল্প-সাহিত্য বিকাশের ধারায় আরো বহু দূর এগিয়ে যাবে। তবে তার আগে প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা-মাতৃভাষার প্রতি গভীর মমত্ব ও দায়বোধ, তা সম্ভব না হলে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনন্দের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কাজ করা কঠিন। তিন চারটে বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি নির্ধারিত ১০০ নম্বরের বাংলা কোর্স পাঠদান করছে। কিন্তু সেখানে বাংলা বিভাগ নেই। কেন প্রত্যেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ নেই-এ প্রশ্নের উত্তর-পুঁজিবাদী চিন্তা-পুঁজির বিকাশ ঘটানোই মূল লক্ষ্য। মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য যে দেশের সন্তানেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে, যে রক্তের স্রোত মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে-স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে- সেই দেশের প্রত্যেকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা কি অপরিহার্য নয়? কিন্তু দুর্ভাগ্য, অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ নেই-ইউজিসি নির্দেশিত ও নির্ধারিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কোর্সটিও পাঠদান করা হয় না। আর হাতেগোনা যে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ আছে, তা যেন দয়া-দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছে, মরানদীর স্রোতহীন জীবন হয়ে। বিশ্বাস না হয় ভেতর থেকে আসল ছবিটা বের করে দেখার চেষ্টা করুন, দেখতে পাবেন করুণ ছবিটা। এরপরও বলি, না থাকার চেয়ে এরকম বাংলা বিভাগ থাকাটাও ভালো। এসব বিভাগ থেকে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক যেসব কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়, তা ক্ষুদ্র বা নগণ্য ভাবার সুযোগ নেই। বৈরিতা, প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার ভেতরও শিল্প-সাহিত্যচর্চার এই স্রোতটা যে কয়টা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবহমান করে রাখতে পেরেছে, রাখছে;, ভয়াবহ অবক্ষয়ের এই সময়কালে সেটা সামান্য নয়।
লেখক: নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান
এসি