হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পাঠশালার মজার গল্প
প্রকাশিত : ১৫:৫১, ১২ জুলাই ২০১৯ | আপডেট: ১৫:১৬, ১৪ জুলাই ২০১৯
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। বিচিত্র জীবনে বৈচিত্রময় লেখা দিয়ে তিনি দেশের সব শ্রেণীর পঠকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। সেই হুমায়ূন কুয়া এবং মাকড়সা ছাড়া বাকিটা শৈশব কাটিয়েছেন আনন্দময় ও স্বাধীনভাবে।
আজকালের মায়েরা সন্তান চোখের আড়াল হলেই চোখ যেমন কপালে তুলে হৈচৈ শুরু করেন, তাদের সময় অবস্থাটা ছিল ভিন্ন। শিশুদের খোঁজ পড়ত শুধু খাওয়ানোর সময়। তাদের পড়াশোনা নিয়েও বাবা-মা’দের খুব একটা দুশ্চিন্তা ছিল না। একটি শিশুশিক্ষা এবং ধারাপাতের চটি একটা বই এবং স্লেট-পেনসিল কিনে দিলেই বাবা-মা’রা মনে করতেন অনেক করা হয়ে গেছে। বাকি পড়াশোনা ধীরেসুস্থে হয়ে যাবে। ক্লাস ওয়ান-টু’র পরীক্ষাগুলিতে ফার্স্ট হতে হবে এমন কোন কথা নেই। পাশ করে পরের ধাপে উঠতে পারলেই হলো। না পারলেও ক্ষতি নেই, পরের বার উঠবে। পুরো ব্যাপরটা এক ধরণের ঢিলেঢালা ভাব।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটিতে এভাবেই তার সময়কার বর্ণনা দিয়েছেন। তার প্রথম পাঠশালা নিয়ে যতটুকু জানা যায়- তার বাঁদরজীবনের সমাপ্তি ঘটানোর জন্য তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম স্কুলে যাওয়া উপলক্ষে একটি নতুন খাকি প্যান্ট কিনে দেওয়া হয়। যে প্যান্টের কোনো জীপার নেই। সারাক্ষণ হাঁ হয়ে থাকে। অবশ্য এটি নিয়ে তিনি খুব একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না।
নতুন প্যান্ট পরেছেন এতেই আনন্দে আত্মহারা।
হুমায়ূন আহমেদের মেজো চাচা তাকে কিশোরীমোহন পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে প্রধানশিক্ষককে বলে আসেন- বড়ই দুষ্ট ছেলে। চোখে চোখে রাখবেন।
তিনি অতি সুবোধ বালকের মতো ক্লাসে গিয়ে বসলেন। মেঝেতে পাটি পাতা। সেই পাটির উপর বসে পড়াশোনা। ছেলেমেয়ে সবাই এক সঙ্গে পড়ে। মেয়েরা বসে প্রথম দিকে, তাদের পেছনে ছেলেরা।
মাজার বিষয় হচ্ছে- হুমায়ূন খানিকক্ষণ বিচার-বিবেচনা করে সবচে রূপবতী বালিকার পাশে ঠেলেঠুলে জায়গা করে বসে পড়লেন। রূপবতী বালিকা অত্যন্ত হৃদয়হীন ভঙ্গিতে তুই তুই করে সিলেটি ভাষায় তাকে বললেন- ‘এই, তোর প্যান্টের ভেতরের সবকিছু দেখা যায়।’
ক্লাসের সবক’টা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হেসে উঠলেন। মেয়েদের আক্রমন করা অনুচিত বিবেচনা করে সবচে উচ্চস্বরে যে-ছেলেটি হেসেছিল, হুমায়ূন আহমেদ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাতের কুনইয়ের প্রবল আঘাতে রক্তারক্তি ঘটিয়ে ফেললেন। দেখা গেল ছেলেটির সামনের একটি দাঁত ভেঙে গেছে। হেডমাস্টার হুমায়ূনকে কান ধরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে নির্দেশ দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের উপদেশ দিলেন- এ মহাগুণ্ডা, তোমরা সাবধানে থাকবে। খুব সাবধান। পুলিশের ছেলে গুণ্ডা হওয়াই স্বাভাবিক।
ক্লাস ওয়ান বারোটার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। এই দুই ঘন্টা তিনি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। পুরো সময়টা যে তার খুব খারাপ কেটেছে তা কিন্তু নয়। স্কুলের পাশেই ছিল আনসার ট্রেনিং ক্যাম্প। তাদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। লেফট রাইট, লেফট রাইট। দেখতে তার বড়ই ভালো লাগছে। তাই মনেমনে ঠিক করে ফেললেন, বড় হয়ে আনসার হবেন।
ক্লাসের দ্বিতীয় দিনেও শাস্তি পেতে হয় তাকে। শিক্ষক অকারণেই তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। সম্ভবত প্রথম দিনের কারণে তার উপর রেগে ছিলেন। মাস্টারসাহেব মেঘস্বরে বলেন, ‘গাধাটা মেয়েদের সঙ্গে বসে আছে কেন? এই তুই কান ধরে দাঁড়া।’
দ্বিতীয় দিনেও সারাক্ষণ কান ধরে দঁড়িয়ে ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার তৃতীয় দিনেও একই শাস্তি। কারণ এই শাস্তি তার প্রাপ্যই ছিল। একটা ছেলের স্লেট ভেঙে ফেলেছিলেন। ভাঙা স্লেটের টুকরায় তার হাত কেটে গেয়েছিল। আর তাই আবারও রক্তপাত, আবারও কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি পেতে হয়।
হুমায়ূন বিষয়টি স্বীকার করে নিলেন। তিনি ভেবেই নিলেন যে স্কুলের দুই ঘন্টা তাকে কান ধরেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। মাস্টারসাহেবেরও ধারণা হল যে তাকে কান ধরে দাঁড়িয়ে রাখলে সে আর অন্যদের বিরক্ত করার সুযোগ পাবেন না।
অনেকে হয়তো বিশ্বাসই করবেন না যে- হুমায়ূন আহমেদ তার পাঠশালার প্রথম শ্রেণীটি কান ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটিয়েছেন। তবে তিনি একা ছিলেন না, বেশিরভাগ সময় তার সঙ্গী ছিলেন শংকর নামের একজন। তার ক্লাসে দুজন শংকার ছিল। এই শংকর হচ্ছে মাথামোটা শংকর। মোটা বুদ্ধি অর্থে মাথামোটা সেটা নয়, আসলেই শরীরের তুলনায় এই শংকরের মাথাটা অস্বাভাবিক বড় ছিল। ক্লাস ওয়ানে সে যতখানি লম্বা ছিল, ক্লাস ফাইভে ওঠার পরও ততখানি লম্বাই রইলেন। তবে মাথাটা বড় হতে শুরু করলো। ক্লাসে শংকর ছাড়া হুমায়ূনের আর কোন বন্ধু জুটল না। তিনি (শংকর) তার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতেন। শংকরকে নিয়ে শিশুমহলে মোটামুটি ত্রাসের সঞ্চার করে ফেলেন হুমায়ূন।
ক্লাস টু’তে উঠে হুমায়ূন আহমেদ আরেকটি অপকর্ম করেন। যে রূপবতী বালিকা তার হৃদয় হরণ করেছিলেন, তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন। গম্ভীর গলায় হুমায়ূন তাকে জিজ্ঞাস করেন যে- বড় হয়ে তাকে বিয়ে করতে রাজি আছেন কিনা! প্রকৃতির কোনো এক অদ্ভুত নিয়মে রূপবতীরা শুধু যে হৃদয়হীন নয় তা ই না, খানিকটা হিংস্র স্বভাবেরও হয়। সে তার প্রস্তান প্রত্যাখান করে বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়েন। খামচি দিয়ে হাতের দু’তিন জায়গায় চামড়া তুলে ফেলেন। সেই সঙ্গে ক্লাসের স্যারের কাছে নালিশও করেন। শাস্তি হিসেবে দুই হাতে দুটি ইট নিয়ে হুমায়ূনকে নীলডাউন হয়ে বসে থাকতে হয়।
চলবে …
এসএ/