হুমায়ূন আহমেদের নানা বাড়ির গল্প
প্রকাশিত : ১৫:১৪, ১৪ জুলাই ২০১৯ | আপডেট: ১০:৪১, ১৯ জুলাই ২০২০
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। আজ তার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। বিচিত্র জীবনে বৈচিত্রময় লেখা দিয়ে তিনি দেশের সব শ্রেণীর পঠকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটিতে তিনি নানা বাড়ির বেশ কিছু স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন। যা একুশের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :
‘একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখি-মা’কে আজ অন্যরকম লাগছে। তাঁর চেহারায় খুকি-খুকি ভাব চলে এসেছে। কথা বলছেন অনেকটা সুরেলা গলায়। ব্যাপারটা কী?
অসাধারণ ব্যাপার একটা ঘটেছে-আমার নানার বাড়ি এবং দাদার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। আমার শৈশবের সবচে আনন্দময় সময় হচ্ছে এই দু জায়গায় বেড়াতে যাওয়া। প্রতি দু বছর পরপর একবার তা ঘটত। আমার মনে হত, এত আনন্দ এত উত্তেজনা সহ্য করতে পারব না। অজ্ঞান হয়ে যাব। আমরা ছুটিতে যাচ্ছি। ছুটিতে যাচ্ছি। ছুটিতে যাচ্ছি।
সিলেট মেলে রাতে ছড়ব। গভীর রাতে সেই ট্রেন বৈরবের ব্রিজে উঠবে। আমরা যদি ঘুমিয়ে পড়ি আমাদের ডেকে তোলা হবে। গভীর বিস্ময়ে দেখব ভৈরবের ব্রিজ। ভোরবেলায় ট্রেন পৌঁছবে গৌরীপুর জংশন। ঘুম ভাঙবে চাওয়ালাদের অদ্ভুত গলা জা-গ্রাম চা-গ্রাম শব্দে। মিষ্টি লুচি দিয়ে সকালের নাশতা। চার থেকে পাঁচ ঘন্টা গৌরীপুর জংশনে যাত্রাবিরতি। কী আনন্দ। কী আনন্দ! স্টেশনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে বেড়াও।ওভারব্রিজে উঠে তাকিয়ে দ্যাখো পিপীলিকার সারির মতো ট্রেনের সারি। দূরের দিগন্তে বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। সেই ক্ষেতে নেমেছে সাদা বকের দল। তারা উড়ে উড়ে যাচ্ছে-আবার এসে বসছে। আরও অনেক দূরে মেঘের কোলে নীল রঙা গারো পাহাড়। এইগুলি কি এই পৃথিবীর দৃশ্য? না, এই পৃথিবীর দৃশ্য নয়-ধুলোমাটির এই পৃথিবী এত সুন্দর হেতে পারে?
নানার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে নিশুতিরাত। কিন্তু স্টেশন গমগম করছে। নানার বাড়ির এবং তাদের আশেপাশের বাড়ির সব পুরুষ চলে এসেছেন। মহিলারাও এসেছেন। তাঁরা স্টেশনে ঢোকেননি, একটু দূরে হিন্দুবাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন।
দরজা দিয়ে নামার সুযোগ নেই। তার আগেই আমাকে কেউ হাত বাড়িয়ে জানালা দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন। একজনের কোল থেকে আরেকজনের কোলে ঘুরছি। মা খুশিতে ক্রমাগত কাঁদছেন। আহা কী আনন্দময় দৃশ্য।
দুটি হ্যাজাকবাতিতে রাস্তা আলো করে আমরা রওনা হলাম। দু পাশের অন্ধকার-করা গাছপালায় রাজ্যের জোনাকি জ্বলছে, নিভছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে কালীবাড়ি। মা কালী জিভ বের করে শিবের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, নানার বাড়ি প্যেঁছাতে তা হলে দেরি নেই। অসংখ্য শিয়াল এক সঙ্গে ডাকছে-বাত্রির প্রথম প্রহর শেষ হল বোধ হয়।
একবার বলেছি, আবার বলি, আমার জীবনের সবচে আনন্দময় সময় কেটেছে নানার বাড়িতে। বাড়িটার তিনটা ভাগ-মূল বসতবাড়ি, মাঝের ঘর, বাংলা ঘর।
বাংলা ঘরের সামনে প্রকাণ্ড খাল। বর্ষায় সেই খাল কানায় কানায় ভরা থাকে। ঘাটে বাঁধা থাকে নৌকা। কাউকে বললেই নৌকা নিয়ে খানিকটা ঘুরিয়ে আনে।
মূল বাড়ির পেছনে ঘন জঙ্গল। এমনই ঘন যে গাছের পাতা ভেদ করে আলো আসে না। সেই জঙ্গলের ভেতর ‘সার দেয়াল’। সার দেয়াল হল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা নানাদের শক্তিমান পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। জঙআগলে কত বিচিত্র ফলের গাগ-লটকন, ডেউয়া, কামরাঙা….।
চারপাশে কত বিচিত্র চরিত্রের মানুষ। আমাদের মন ভুলানোর জন্যে সবার সে কী চেষ্টা। আমার এক মামা (নজরুল মামা) কোথ্যেকে ভাড়া করে ধোপাদের এক গাধা নিয়ে এলেন। গাধা যে আসলেই গাধা সেটা বোঝা গেল-সাত চড়ে দিকে যাওয়া নিষেধ। হঠাৎ লাথি বসাতে পারে।
বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্যে ঘুড়ি উড়ানো হবে। সেই ঘুড়ি নৌকার পালের চেয়েও বড়। েএকবার আকাশে উঠলে ফ্রেনের মতো আওয়াজ হতে থাকে। ঘুড়ি বেঁধে বাখতে হয় গাছের সঙ্গে, নয়তো উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে।
সন্দ্যাবেলা লাটিম খেলা। প্রকাণ্ড এক লাটিম। লাটিম ঘোরানোর জন্য লোক লাগে দু জন। লাটিম ঘুরাতে থাকে ভোঁ ভোঁ আওয়াজে। আওয়াজে কানে তালা ধরে যায়।
একটু রাত বাড়লে ফাডার টাক্কর (পাঁঠার টক্কর)। দুটি হিংস্র ধরণের বাঁকা শিংয়ের পাঁঠার মধ্যে যুদ্ধ। দ্রপ্রান্ত থেকে এরা ঘাড় বাঁকিয়ে ছুটে আসবে। প্রচণ্ড শব্দে এক জনের শিং এ অন্যজন আঘাত করবে। আগুনের ফুলকি বের হবে শিং থেকে। শুরু হবে মরণপণ যুদ্ধম ভয়াবহ দৃশ্য।
মামাদের কেউ গবীর রাতে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলেবেন। তারা ‘আউল্লা’ দিতে যাচ্ছেন। সঙ্গে যাব কি না। ব্যাপারটা হল আলো দিয়ে মাছ মারা। অল্প পানিতে হ্যাজাকের তীব্র আলো ফেলা হয়। সেই আলোয় দেখা যায় শিং, মাগুর শুয়ে আছে। আলোতে এদের চোখ ধা*ধিয়ে যায়-নড়তেচড়তে পারে না। তখন থোর দিয়ে তাদের গেঁথে ফেলা হয়।
খুব ভোরে নানাজানের সঙ্গে ভ্রমন। নানাজানের হাতে দু নলা বন্দুক। তিনি যাচ্ছেন বিলের দিকে, আমরা পেছনে পেছনে আছি। ছররা গুলিতে তিন চারটা বক এক সঙ্গে মারা পড়ল। মৃত পাখিদের ঝুলিয়ে আমার এগুচ্ছি-নাকে আসছে মাটির গন্ধ, মৃত পাখিদের রক্তের গন্ধ, বারুদের গন্ধ।
সারাদিন পুরুরে ঝাঁপিঝাঁপি, নিশুতিরাতে ঘুম ভেঙে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শোনা- এই আনন্দের যেমন শুরু নেই তেমনি শেষও নেই। ছোটদের শোবার ব্যবস্থা মাঝের ঘরে। ঢালাও বিছানা। বিছানার এক প্রান্দে মা বসে আছেন, পরিচিতজনরা আসছে। গল্প হচ্ছে, পান খাওয়া হচ্ছে, রাত বাড়ছে। কী চমৎকার সব রাত!
নানার বাড়ি ঘিরে আমার অদ্ভুত সব স্মৃতি। মাঝে মাঝে স্বপ্নদৃশ্যের মতো এরা উঠে আসে। জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারি না। কয়েকটি স্মৃতি উল্লেখ করছিঃ
ক) সাপে-কাটা রুগিকে ওঝা চিকিৎসা করছে। এই দৃশ্য নানার বাড়িতেউ প্রথম দেখি। রুগি জলচৌকিতে বসে আসে, ওঝা মন্ত্র পড়তে পড়তে হাত ঘোরাচ্ছে। সেই ঘুরন্ত হাত অতি দ্রুত নেমে আসছে রুগির গায়ে। চিকিৎসার মেষ পর্যন্ত কাঁইক্যা মাছের কাঁটা দিয়ে রুগির পা থেকে দূষিত রক্ত বের করা হচ্ছে।
খ) মেঘের ডাক শুনে ঝাঁক বেঁধে কইমাছ পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠে আসছে এবং প্রাণপণ চেষ্টা করছে শুকনো দিয়ে কোন-এক গন্তব্যে যেতে। কেন তারা বর্ষার প্রথম মেঘ গর্জনে এমন পাগল হয়, কে বলবে!
গ) ভূতে-পাওয়া রুগির চিকিৎসা করতেও দেখলাম। ভূতের ওঝা এসে রুগির সামনে ঘর কেঁটে সেই ঘরে সরিষা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। রুগি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বলছে আর মারিস না। আর মারিস না।
ঘ) এক হিন্দুবাড়িতে নপুংসক শিশুর জন্ম হলো। কোন্থেকে খবর পেয়ে একদল হিজড়া উপস্থিত। শুরু হল নাচানাচি। নাচানাচির এক পর্যায়ে এরা গা থেকে সব কাপড় থুলে ফেলল। ঝুড়ি ভরতি করে ডিম নিয়ে এসেছিল, সেই সব ডিম ছুঁড়ে মারতে লাগল বাড়িতে। এক সময় শিশুটি তাদেরকে দিয়ে দেয়া হল। মহানন্দে তারা চলে যাচ্ছে। ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে শিশুটির মা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় এমন একটি দৃশ্য। আমার নিজের চোখে দেখা।
ঙ) এক সন্ধ্যায় নানার বাড়িতে ঢিল পড়তে লাগল। ছোট ছোট ঢিল নয়-ক্ষেত থেকে উঠিয়ে আনা বিশার মাটির চাঙড়। নানিজান বললেন, কয়েকটা দুষ্ট জিন আচে। মাঝে মাঝে এরা উপদ্রব করে। তবে ভয়ের কিছু নাই, এই সব ঢিল কখনও হায়ে লাগে না।
ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে উঠোনে খারিকক্ষন ছোটাছুটি করলাম। আশেপাশে ঢিল পড়ছে, গায়ে পড়ছে না-বেশ মজার ব্যাপরা।
নিশ্চয় এর লৌকিক কোন ব্যাখ্যা আছে। ব্যাক্যা থাকলেও আমার জানা নেই। জানতেও চাই না। নানার বাড়ির আনেক রহস্যময় ঘটনার সঙ্গে এটিও থাকুক। সব রহস্য ভেদ করে ফেলার প্রয়োজনই-বা কী?’
(তথ্য সূত্র: লেখাটি হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার ছেলেবেলা’ থেকে নেওয়া)
এমবি/