ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

মনের আয়না

আহসান হাবিব

প্রকাশিত : ২২:৪৮, ২৫ অক্টোবর ২০১৯ | আপডেট: ২২:৫০, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

সন্ধ্যাটা গড়িয়ে রাতের প্রথম প্রহর চলছে। এলেমেলো বাতাসে গাছের পাতাগুলো শনশন শব্দে দুলছে। চাঁদের আলোতে তা স্পষ্ট। চাঁদটা ঠিক পড়েছে তুরাগ নদীর মাঝে। টলমল পানিতে চাঁদটি যেনো নিজ স্বভাবের চেয়েও শান্ত। নদী তার বক্ষটি প্রশস্ত করে চাঁদকে বেশ আপন করে নিয়েছে। ঠিক যেনো দুজন দুজনার চিরচেনা। আশপাশের বাতিগুলো জানান দিচ্ছে এক বাধাহীন সখ্যতা। মনের মাঝে এই নদীর ছুটে চলা, চাঁদের আলো আর দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলো উদয় করেছে এক অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব। দাড়িয়ে থাকা আলোতে মোড়ানো থাম্বাগুলোও সাক্ষী হয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে রয়েছে!

দুমাস পার হলেও বন্ধুর বাড়িতে যেতে পারছি না৷ ছেলেটা মুখ গোমড়া করে অপেক্ষা করছে। তার অভিমানের মাত্রাটা বরাবরই সীমা অতিক্রম করে ছুতে চায় আসমান। তাই ভাবলাম ঘুরে আসি ওর বাড়ি থেকে। অন্তত তার অভিমানের রাজ্য থেকে কিছুটা অভিমান কুহেলিকা হয়ে ঝরে পড়ুক!

বেরিয়ে পড়লাম। খানিকটা পথ হেঁটে গিয়ে উঠে পড়লাম বাসে। রাস্তা ফাঁকা হওয়ায় একঘন্টার পথ পাড়ি দিলাম মাত্র ২৫ মিনিটে। আহা! কীযে স্বর্গসুখ! বাস থেকে নেমে আবারও হাঁটা শুরু। তিন মিনিট হেঁটে ওঠলাম লেগুনাতে। লেগুনার ড্রাইভার তখন পাশের বিড়ি ফুকছিলেন। আমি সামনের ছিটটা ফাঁকা পেয়ে বসে পরলাম। ওদিকে ড্রাইভার সিগারেট ফুকতে ফুকতে সামনের সিটটা অন্যের কাছে লিজ দিয়েছে। পাঁচ মিনিট পর এসে আমার ব্যাগটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো।

আমি বললাম, মামা এটাতো অন্যায়। সে বললো, কী বললেন! এটা অন্যায়? যা বলেছেন আর বলিয়েন না। আমি বাপু কথা না বাড়িয়ে অবুঝ ছেলের মতো পরের লেগুনাতে জায়গা করে নিলাম। কথা বেশি বাড়াইনি। আর ওসব মানুষদের সাথে বেশি কথা না বাড়ানোই ভালো। মেজাজ খুব চড়া। নেশাটেশা করে কীনা তার বাড়ির গিন্নি ভালো বলতে পারবে। হুটহাট করে আমার গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলে আমার চিল্লানিতে কোনই ফায়দা হবে না!

লেগুনা চলতে শুরু করলো। মোড়ের পর মোড় পেড়িয়ে তুরাগ নদী ঘেঁষে ঘো...ঘো… শব্দে ছুটছে তো ছুটছেই। নদীতে ভাসমান নৌকাগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ওদিকে কিছু জায়গা পর পর অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তলোনের মহাউৎসব দৃশ্যমান! লোকে বলে ওসব নাকি দেশ মার্তৃকার শিল্পপতিদের কারবার! যখন যে দল ক্ষমতায় সেই দলের কিছু নেতাজি এ কার্য সম্পাদন করতে খুব আগ্রহী হয়ে পড়ে।

বন্ধুর বাসায় পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রামান্তে বেড়িয়ে পড়লাম। একান্তে হাঁটবো বলে। গল্প হবে, আড্ডা হবে, হাসিতামাশা হবে। এভাবেই কেটে যাবে পাঁচ-সাত ঘন্টা। পাশের একটা দোকান থেকে ছয় প্রকারের ভাজা সংগ্রহের কাজ এরই মধ্যে শেষ। রিকশায় উঠে পড়লাম। ভাড়া ঠিক হলো ৩০ টাকা। নামিয়ে দেবে ঠিক দিয়াবাড়ি ব্রিজের মাঝ বরাবর। ওপারের মোড়ে যাওয়া যাবে না। কারণ,এইটুকুতেই মামাকে টোল বাবদ ১০ টাকা সরকারি তহবিলে জমা দিতে হবে। বেচারার টিকবে মাত্র ২০ টাকা।

যাত্রা শুরুর সাথে সাথেই গল্প শুরু হলো। বন্ধু বললো, দোস্ত পড়াশুনা শেষে কী করবো ভাবছি! চাকরির যে অবস্থা! কতশত মেধাবিরা রাস্তা ঘাটে ঘুরছে একটা চাকরির জন্য। ওই যে গত বছর ঢাকা ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট তানভীর তো চাকরির না পাওয়ার শোকে আত্মহত্যা করলো! কী যে করি চিন্তায় আছি! আমি বললাম, 'দেখ জীবন তো একটায়। আত্মহত্যার পথ যারা বেছে নেয় তারা সিদ্ধান্ত ভুল। যেকোন একটা কর্ম করলে জীবন চালিয়ে নেয়া যাবে। পড়াশুনা মানে তো শিক্ষা নেয়া! বড় চাকরি ও অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া এর লক্ষ নয়! মানবিকতা, ভালোবাসা ও উদারতায় এর মূল লক্ষ হওয়া উচিত। আর এগুলো অর্জন করতে পারলেই মহাকাল আমাদের স্মরণে রাখবে।

বলতে বলতেই ঠিক দাঁড়ালাম বিরুলিয়া ব্রিজের মাঝখানে। মামাকে সিমের বিচি ভাজা সহ বিদায় দিলাম। সে তাতে অনেক খুশি। কদিন আগে এক বন্ধুর সাথে বার্গার খেতে বসেছিলাম। দুইটা নেয়ায় একটা রয়েই গেলো! বন্ধু বললো, 'প্যাকেট করে নাও। বাসায় গিয়ে খেও।' আমি অবশ্য সেটা বাসায় নিইনি। রাস্তার ধারে বসা বুড়ি মাকে দিলাম। সে যে খুশিটা হলো! মনে হয়েছিলো এটা এক জান্নাতসম তৃপ্তি। 

দাঁড়ালাম ব্রিজের ওপরে। ব্রিজ তখন কাঁপছিলো। মালবাহী ট্রাকগুলো ব্রিজের উপর দিয়ে যাওয়া-আসায় এমনটা হচ্ছে। আসলে ব্রীজটা তৈরিতে বরাদ্দকৃত টাকার সঠিক ব্যবহার হয়েছে কী-না? সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। হোক বা না হোক, এই আধমরা জাতির সেদিকে দৃষ্টি নেই।

আমরা আমাদের স্বপ্নের বেচাকেনায় তখনও বিভোর। আহ কত যে স্বপ্ন! এই ছোট্ট জীবনের জন্য! সব ঠিক মতোই চলছিলো। বাঁধ সাধল পাশেই দাঁড়ানো একটা কালো কার গাড়ি। দুজন তরুণ-তরুণী নামলো গাড়ি থেকে। ৫০ গজ দূরে বসে পড়লো ব্রিজের পাখায়। মিউজিকের তালে তালে দুজনের চুম্বনের দৃশ্য চাঁদনী রাতে স্পষ্ট। একি দৃশ্য! আমরা দুজনে বারবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলাম। চলমান গাড়ির আলো ছাড়া তাদেরকে কোন কিছুই আলাদা করতে পারছিলো না! মাঝে মাঝেই গাড়ির গেইট খুলে ভেতরে ঢুকছিলো আবার বেরিয়ে আসছিলো! ওকি! এই চাঁদনি রাতে খোলা আকাশের নিচে কী করে ওরা? পাশেই দুজন পুলিশ রাত্রীকালীন ডিউটি পালনে ব্যস্ত।

আমরা জায়গা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলাম। সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেই ফোনে বলা কিছু কথা কর্ণে এসে আঘাত করলো, "আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আছি। একটু পরে কথা বলছি। কথা শেষ করেই ছেলেটিকে বললো- এই চলনা, বাসায় যেতে হবে তো! আম্মু কিন্তু আমাকে বকবে।" আমি ভাবলাম, এই দৃশ্য থেকেও তো হতে পারে আগামী দিনের দৈনিক পত্রিকায় ধর্ষনের হেডলাইন। আরও ভাবলাম, এ দেশের মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ আর ছেলেদের ২১। এর চেয়ে কমে এ কাজ সম্পন্ন করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় ভাবে নিষেধ। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কারণে বাল্য বিবাহের অভিযোগে অনেকেই যে হাজতবাস করেছে তাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অন্যদিকে মেয়ের বাবার প্রয়োজন সরকারি চাকরি। আর ছেলের বাবার দরকার মোটা অংকের যৌতুক। অথচ এটি হতে পারতো একটি স্বার্থক চাঁদনি রাত। যদি এই বন্ধনটি হতো স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন! মনের আয়না এ দৃশ্য ধরে রাখতো কয়েক যুগ।

সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, দুটো ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে। অনেকদিন হলো ঘোড়া দেখিনি। তাই দেখতে খুব ভালো লাগছে। সারাদিন পরিশ্রম করে ঘড়াগুলো খুবই ক্লান্ত। ওরা কী যেনো দেদারচে খাচ্ছে। আমরাও ৫ টাকা দামের নারকেলের নাড়ু তৃপ্তি সহকারে খেলাম। সাথে গরুর দুধের চা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ইয়াকুব বললো- 'এবার ফিরে যেতে হবে, অনেক রাত হয়েছে।'

#লেখক ও সাংবাদিক 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি