কবি-কথাশিল্পী রকিবুল হাসান: সৃজনে গৌরীস্রোত
প্রকাশিত : ১৭:০৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৭:১২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০
বাংলা কথা সাহিত্যে এই সময়কালে রকিবুল হাসান গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার সৃষ্টিস্রোত প্রবাহিত। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা, কলাম ও সম্পাদনা সর্বক্ষেত্রেই তিনি দক্ষতার স্বাক্ষর দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে স্বকীয় অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। সেকারণে রকিবুল হাসানের কবি-কথাশিল্পী অভিধা যুক্ত করলেও, তা অসম্পূর্ণ। আসলে কোনটা বেশি যুতসই সেটা এককথায় বলা মুশকিল। কারণ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই তিনি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে যেকোনো একটি অভিধায় তাকে বন্দি করে ফেলা বা সীমাবদ্ধ করে ফেলা কঠিন। তবুও আমি ‘কবি-কথাশিল্পী’ যুক্ত করে দিয়েছি।
প্রাবন্ধিক বা গবেষক হিসেবে তিনি হয়তো এর চেয়েও বড়। তবুও আমার কাছে তিনি কবি ও ঔপন্যাসিক হিসেবেই বড়। সেকারণেই আমি এ অভিধাটিই তার নামের সাথে ব্যবহার করেছি। কতোটা ঠিক বেঠিক হলো অত হিসেব করিনি।
রকিবুল হাসান পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। নানা কারণে এ গ্রামটি বিখ্যাত। গড়াই নদীর তীর ঘেঁষা এ গ্রামের ইতিহাস দীর্ঘ। বিশেষ করে বিখ্যাত অনেক ব্যক্তির জন্ম এই ছোট্ট গ্রামটিতে। লেখক, রাজনীতিক, বিপ্লবী, অভিনেতা ও আইনজীবী, চিকিৎসক এখানে জন্মেছেন। বিশেষ করে বিপ্লবী বাঘা যতীন ও ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের নাম উল্লেখ করতেই হয়। কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতৃভূমি এই গ্রামে। সাহিত্যিক ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, কবি শরৎশশী দেবী এ গ্রামের বিখ্যাত সন্তান।
এ রকম বিখ্যাত অনেক নাম উল্লেখ করা যাবে। এ গ্রামের আর এক কৃতী সন্তান প্রফেসর ড. আজিজুল ইসলাম। তিনি ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের অনুজ। এ সবই গ্রামের আলোর কথা, স্বর্ণ-ঝর্ণাধারার কথা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ গ্রামে এসেছিলেন। এখানে কবিতা লিখেছেন। ‘ধূলামন্দির’ কবিতার নিচে তিনি তা উল্লেখও করেছেন। এত কথা বলছি এর একটা কারণ আছে। আমি মূলতঃ এ লেখায় রকিবুল হাসানের কথা বলবো। কয়া গ্রামের রকিবুল হাসান। কয়া গ্রামের অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য এখন আমরা জানি। সেই জানাটা কিছুকাল আগেও আমরা জানতাম না। জেনেছি রকিবুল হাসানের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
বলা যায়, তিনিই জানিয়েছেন, জানানোর চেষ্টা করেছেন, এখনো চেষ্টাটা করে যাচ্ছেন। কয়া গ্রামকে কতোটা ভালোবাসলে তিনি তা করতে পারেন, তা তার লেখা পড়লেই বোঝা যায়। রকিবুল হাসান তার একটা বইয়ের নামই দিয়েছেন নিজের গ্রামের নামে ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন’। অর্থাৎ এই বইয়ে যা কিছু আছে, তা কয়া গ্রামের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আকবর হোসেনের যে সাক্ষাৎ ঘটেছিল কয়ায়, সে ইতিহাসও তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। আরও অবাক হওয়ার মতো ঘটনা, আকবর হোসেন ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি পেলেও, তিনি আসলে কবি ছিলেন। কবিতা চর্চা দিয়েই তার সাহিত্য জগতে তার প্রবেশ হয়েছিল। এসবই রকিবুল হাসানের নিরলস চেষ্টার ফলে আমাদের জানা সম্ভব হয়েছে। এ এক বিরল ভালোবাসা গ্রামের প্রতি। বাংলা সাহিত্যে এরকম উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
রকিবুল শিক্ষাজীবনেও কয়াগ্রামকে বুকের ভেতর পরম মমতায় গেঁথে রেখেছিলেন। এমএ ক্লাসে মেধাবী ছাত্র হিসেবে গবেষণা করেছেন, তার গ্রামের কৃতী সন্তান ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনকে নিয়ে। রকিবুল হাসানই প্রথম আকবর হোসেনকে লেখক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি পিএইচডি-এর বিষয় হিসেবেও মীর মশাররফ হোসেন ও মোহাম্মদ নজিবর রহমানের সঙ্গে আকবর হোসেনকে যুক্ত করেন।‘আকবর হোসেনের উপন্যাসের চারিত্র্যবিচার’ শিরোনামে দীর্ঘ অধ্যায় রচনা করেন।
পরবর্তীতে তিনি আকবর হোসেনকে নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায় ‘আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি’ এবং ‘পঞ্চাশের সাহিত্যে জনপ্রিয় যুবরাজ’ দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম। বর্তমানে ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনকে নিয়ে অনেকে গবেষণা করছেন। সে-পথ রচনা করে দিয়েছেন রকিবুল হাসান। আকবর হোসেনের উপন্যাস বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সিলেবাস অন্তর্ভূক্ত হতে পেরেছে তার প্রয়াসেই।
বিপ্লবী বাঘা যতীন মারা গেছেন ১৯১৫ সালে, একশ বছরেরও বেশি সময়কাল আগে। এ গ্রামে বাঘা যতীনকে নিয়ে কথা শুরু হয়েছে মাত্র দশ-পনের বছর আগে। সেটাও রকিবুল হাসানের কারণেই। এই গ্রামে বড় বড় মানুষ জন্মালেও বাঘা যতীনকে কেউ তুলে ধরেননি বর্তমান প্রজন্মের কাছে। অথচ বাঘা যতীন কত বড় মানুষ, কত বিখ্যাত মানুষ, তা এই গ্রামের মানুষই জানতো না।
রকিবুল হাসান প্রথম তা জানালেন। রীতিমত ‘বিপ্লবী বাঘা যতীন’ বই লিখে। তাকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। কবিতা লিখেছেন। টিভিতে বাঘা যতীনকে নিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। অনুষ্ঠান করেছেন। শুধু গ্রাম নয়, গোটা দেশের মানুষকে জানিয়েছেন তিনি, বাঘা যতীন কয়া গ্রামের বিখ্যাত সন্তান। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অগ্নিকালের মহানায়ক।
রকিবুল হাসানের গবেষণা গ্রন্থ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহায়কগ্রন্থ হিসেবে পড়ানো হয়। তার গবেষণা ও প্রবন্ধ গ্রন্থ: বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন, বিপ্লবী বাঘা যতীন, আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি, কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন, পঞ্চাশের সাহিত্যে জনপ্রিয় যুবরাজ, পথের কথা, গড়াই নদীর পাড়, পথে যেতে যেতে, সাহিত্যের নন্দনচর্যা, প্রবন্ধ-প্রমূর্ত: ভিতর-বাহির এবং রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন।
কথাশিল্পী হিসেবেও তিনি বাস্তবজীবনমুখী ও সমাজজীবনের বহুমাত্রিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে উপন্যাস রচনা করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তার উপন্যাস: ‘জীবন দিয়ে ভালোবাসি’, ‘কেকা প্রকাশনী’, ‘এ কী তৃষ্ণা এ কী দাহ’, ‘নবীরন’, ‘ভাঙন’, ‘ছায়াবন্দি’ ও ‘অহনাবউ’।
‘ভাঙন’ তার সাড়া জাগানো উপন্যাস। এ উপন্যাসটি নিয়ে লিখেছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তার ছোটগল্প গ্রন্থ ‘মেয়েটির চোখে শিশির জমেছিল’ ও ‘প্রেমের বেলা নেই’। তার গল্পের বড় দিক হলো, গল্পগুলো জীবন থেকে তুলে আনা। গল্পগুলো গল্প নয়, যেন জীবনেরই হুবহু এক নান্দনিক প্রকাশ।
তিনি গবেষণা বা উপন্যাস গল্পে যেমন দক্ষতা দেখিয়েছেন, একইভাবে কবিতার ক্ষেত্রেও অসামান্য তিনি। বরং কবিতাতেই তার শক্তি বেশি। পাঠকপ্রিয় অনেক কবিতার স্রষ্টা তিনি। কাব্যগ্রন্থ : ‘অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে’, ‘এক ধরনের অহংকার’, ‘দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত’, ‘দেবতীদেউল’, ‘রহস্যস্বাক্ষর’, ‘রকিবুল হাসানের প্রেমের কবিতা’, ‘ব্যর্থ ভয়ঙ্কর দৌড়ের কাছে’, ‘ধূলিমাটির ঘ্রাণ’ ও ‘স্বদেশলক্ষ্মি তিমিররাত্রি (যৌথ)’।
রকিবুল হাসান সম্পাদনা করেছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তার কবিতা ও প্রবন্ধ বিভিন্ন সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। তার বহু কবিতা, প্রবন্ধ, কলাম ও গল্প ছাপা হয়েছে দেশ-বিদেশের জার্নালে গবেষণা-প্রবন্ধ লেখেন তিনি। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জার্নাালে তার গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার গ্রন্থ নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অনুষ্ঠান হয়েছে। সেসব অনুষ্ঠানে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, প্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরী, কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন, কথাশিল্পী আতা সরকার, প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরী, অভিনেতা লেখক খায়রুল আলম সবুজ ও প্রফেসর ড.রাশিদ আসকারীর মতো বিখ্যাতজনের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল।
রকিবুল হাসানের গ্রন্থ নিয়ে লিখেছেন দেশবরেণ্য অনেক কবি-সাহিত্যিক। বিশেষ করে এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ গল্পকার হাসান আজিজুল হক, কবি ওমর আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন ও কবি প্রফেসর ড. অনীক মাহমুদ, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. রাশিদ আসকারী, প্রফেসর আবু তাহের মজুমদার, প্রফেসর জুলফিকার মতিন, প্রফেসর অমৃতলাল বালা, ড. তপন বাগচী, কবি-গবেষক বিলু কবীর, প্রফেসর ড. শহীদ ইকবালসহ খ্যাতিমান অনেকেই।
রকিবুল হাসানের কবিতার সিডি ‘একটু ভালোবাসলে কী এমন হয়’ বেরিয়েছে বেশ আগেই। মোবাইলে টিউন হিসেবে তার কবিতা ব্যবহৃত হয়। তিনি সাহিত্যকর্মের জন্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন। কবি ওমর আলী স্বর্ণপদক, লালন সাঁই পুরস্কার, শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, স্যার সলিমুল্লাহ পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
তিনি দীর্ঘকাল সাংবাদিকতা করেছেন। সাপ্তাহিক অর্থবিত্ত পত্রিকা বের করছেন ১৯ বছর ধরে। সাহিত্য পত্রিকা গৈরিক ও একক এর সম্পাদক তিনি।
রকিবুল হাসান কয়া গ্রামের সাধারণ এক সন্তান। এ গ্রামের ধূলাবালি তার গায়ে মাখা। গড়াই নদীর পানি লেগে আছে তার শরীরে। কয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন। কয়া হাইস্কুলে পড়েছেন। তিনি পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহীতে পড়েছেন। একে একে উচ্চশিক্ষার সব বৈতরণী পার হয়েছেন। কঠিনকেই জয় করেছেন তিনি।
রকিবুল হাসান ঢাকা শহরে লেখালেখি বা বাণিজ্যে সর্বক্ষেত্রেই উজ্জ্বল একটি অবস্থান তৈরি করে নিলেও, ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিভৃতচারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করে, সাহিত্যচর্চার সুবাদে তিনি এ শহর দাপিয়ে বেড়াতে পারেন, কিন্তু তিনি বিনয়ের সাথে বিভিন্ন আড্ডা-উৎসব এড়িয়ে দিনের সব দায়িত্ব পালন শেষে ঘরে ফিরতেই বেশি পছন্দ করেন। এ যেন কবি ওমর আলীর ‘আমি গৃহকাতর মানুষ’, রকিবুল হাসাওেনর সত্ত্বায়ও একই বোধ।
আবার এই হিসেবের উল্টোটাও তো আছে তার। প্রচণ্ড রকমের সাহস ও প্রতিবাদের আগুন তার ভেতর প্রখরভাবে লক্ষণীয়। সস্তাস্রোতে কখনোই গা ভাসান না তিনি। ব্যক্তিস্বার্থে কখনো শির নত করে কিংবা চাটুকারিতা করে চলেন না। তার লেখালেখিতেও তা স্পষ্ট দিবালোকের মতো। এক কঠিন দৃঢ়তা শ্রমে আদর্শে সংগ্রামে পথ হাঁটেন-পেশাদারিত্ব বা সাহিত্যচর্চা সে যেটাই হোক। সত্যই তার কাছে সুন্দর। এই সুন্দরই তার সাধনা। তার সাহিত্যকর্ম সে-সত্যই বহন করে।
শাফিক আফতাব: কবি-গবেষক। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এআই/আরকে