ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বরিশালের স্মৃতি

ড. সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৫:০৫, ১৪ মে ২০২০ | আপডেট: ১৫:০৭, ১৪ মে ২০২০

ড. সেলিম জাহান

ড. সেলিম জাহান

আমার শৈশব-কৈশোরে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বরিশাল শহরেরে পাঁচটি বইয়ের দোকানের সঙ্গে আমার পরিচিতি ছিল। তার দুটি বাবার কল্যাণে আর বাকি তিনটির সঙ্গে আমি নিজেই সংযোগ স্থাপন করেছিলাম। তবে স্বীকার করা ভালো যে শেষের তিনটির সঙ্গেও প্রাথমিক পরিচিতি আমার অধ্যাপক পিতাই করে দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে এটাও উল্লেখ্য যে সবগুলো বইয়ের দোকানই সদর রোডের ওপরেই ছিল - জেল খানার পুকুরের সামনে থেকে বিবির পুকুরের কোণা পর্যন্ত।

কালীবাড়ী রোড যেখানে সদর রোডের সঙ্গে মিশেছে, রূপায়নের দোকান পেরিয়ে ওই মোড়ে এসে দাঁড়ালেই হাতের বাম দিকেই ছিল ‘পপুলার লাইব্রেরি’। জেলখানার পুকুরের উল্টোদিকে। তার স্বত্বাধিকারী হারান চক্রবর্তী জমি-জমার দালালী করতেন বলেই আমার। গরম কাপড়ের বাদামী রঙের পাঞ্জাবী, সাদা ধুতি ও সরু নিকেলের চশমায় সুবেশই ছিলেন তিনি।

১৯৬০ সালে যখন অধ্যাপক বিপিন বিহারী গুহ (বিপিজির) বাড়ি ‘শক্তি-সদন’ বাবা যখন কেনেন, তখন বহু দলিল-পত্র নিয়ে বাবা পপুলার লাইব্রেরিতে গেছেন হারান বাবুর সঙ্গে কথা বলতে। সঙ্গে গাধা-বোটের মতো আমাকেও নিয়ে গেছেন। হারান বাবুও বেশ ক’বার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। অকৃতদার হারান বাবু আমার সঙ্গে বড় একটা কথা-টথা বলতেন না। স্কুল-কলেজের পাঠ্য-পুস্তক বিক্রেতা পপুলার লাইব্রেরি আমার কাছেও পপুলার ছিলো না মোটেই।

সদর রোডের মাঝামাঝি জায়গায় অশ্বিনী কুমার টাউন হল পর্যন্ত আসার আগেই রাশেতার বাঁয়ে ছিল ‘ওরিয়েন্টাল বুক ডিপো’ - পঞ্চাশ দশকে বাবার বইয়ের প্রকাশক। ১৯৫১ সনে বাবার বই ‘Principles
of Civics and Economics এর প্রকাশক ছিল ওরিয়েন্টাল বুক ডিপো। প্রকাশক বরিশালের হলেও বইটি মুদ্রিত হয়েছিল কলকাতায়। বাবা প্রায়ই ওখানে যেতেন - সঙ্গে আমি।

ভারী মিষ্টভাষী ছিলেন সেখানকার লোকজন। গেলেই চা-মিষ্টির ব্যবস্থা ছিল। ওটা পেরিয়ে আর একটু সামনে গেলেই ‘নূরমহল সিনেমা হল’ ও ‘রুচিরা ক্যাফে’। নানাবিধ বই ছিল ওরিয়েন্টাল বুক ডিপোতে - প্রচুর ইংরেজি বই। পাঠ্যবই, গল্প-উপন্যাসও পাওয়া যেত সেখানে। আমি যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি, তখন একদিন বাবা ও আমি সেখানে গিয়ে দেখি যে বাবার সহকর্মী অধ্যাপক এম. সামসুল হকও সেখানে উপস্থিত (পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক)। অধ্যাপক হক আমাকে একটি ছোট অক্সফোর্ড অভিধান কিনে দিয়েছিলেন। কেন, মনে নেই। পরবর্তী সময়ে বহু বছর পর্যন্ত দোকানটি দেখেছি, এখনও আছে
কি না, জানি না।

দীর্ঘদিন ধরে আমার প্রচুর যাতায়াত ছিল সদর রোড ওর লাইন রোডের মোড়ে ‘স্টুডেন্টস লাইব্রেরিতে’। দোকানটির সামনে ছিল জেলখানার পুকুর, পাশে ডাক্তার এস.সি. রায়ের ‘দি মেডিকাস্’, রাস্তার উল্টোদিকে আলম সাহেবের মনোহারী দোকান। আমার বন্ধু বিভা মিশ্রর মামা ডাক্তার রায় ছিলেন আমাদর পারিবারিক চিকিৎসক। আলম সাহবের দোকান ছিল আমাদের নানান নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎস।

স্টুডেন্টস লাইব্রেরির সঙ্গে আমার সম্পর্কের তিনটি মাত্রিকতা ছিল। প্রথমত: এরাও বাবার কোন কোন বইয়ের প্রকাশক হওয়ায় এদের নিত্য আনাগোনা ছিল আমাদের বাড়িতে। এর কর্মচারী ভ্রাতৃদ্বয় নীহার-তুষার সকাল সন্ধ্যা আসতো প্রুফ দিতে-নিতে, দোকানের স্বত্বাধিকারী মাখনলাল চক্রবর্তী আসতেন বাবার সঙ্গে নানান আলোচনার জন্য। আমাদের প্রতি বছরেরে নতুন শ্রেণীর বই আসতো স্টুডেন্টস লাইব্রেরি থেকে - অন্যথা করা নিষিদ্ধ ছিলো। দুই, মাখন কাকার পরিবার আর আর আমাদের পরিবারের মধ্যে পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিলো - সামাজিক অনুষ্ঠানে আসা-যাওয়া ছিলো। মাখন কাকা আমার মা-বাবাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। একাত্তরের দিনগুলোতে প্রতিরাতে গোপনে তিনি আমাদের বাড়িতে ঘুমোতেন। তিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ও পড়ানোর কালে বরিশালে গেলেই স্টুডেন্টস লাইব্রেরি ছিল আমার আড্ডার জায়গা। লাইব্রেরির সন্তোষ’দা ছিলেন, মাখন কাকার ছেলে বাবুল’দা ছিলেন, রবীন’দ (রবীন সমাদ্দর), মিন্টু’দা (মিন্টু বসু ) ও অন্যানেরা আসতেন - জোর গাল-গল্প চলতো।

তবে কৈশোর ও যৌবনে বইয়ের জন্যে বরিশালে আমার প্রিয় জায়গা ছিল ‘বুক ভিলা’। বিবির পুকুরের কোণায়, চার রাস্তার মোড়ে, আমার সহপাঠী মাহবুবদের (ঈমান আলী ডাক্তারের পুত্র) ও এন. হোসেন জুয়েলার্সের উল্টোদিকের বইয়ে ঠাসা ছোট্ট বিপণী। তার পাশেই ছিল ব্রাহ্ম সমাজের দালান। পাশে বা সে দালানেই সম্ভবত: একটি ছাপাখানা ছিল। ১৯৬২ সনে আমাদের সহপাঠী ফেরদৌসের বরিশাল ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে ওকে দেয়া বদায়-বার্তা আমরা ওখানে ছাপিয়েছিলাম। বলে নেই, লেখাটি আমার।

বুকভিলায় প্রথম যাই ১৯৬০ এর দিকে -মূলত: দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকী, শিব্রাম চক্রবর্তীর বই ও স্বপন কুমারের আট-আনা সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনী কেনার জন্যে। ফারুক ভাইয়ের বাবা তখনও দোকানে বসতেন, তবে সব কর্মকাণ্ডের হোতা ছিলেন ফারুক ভাই - যিনি তখনও ছাত্র। ফারুক ভাই নানান বইয়ের খবর দিতেন, ভালো বই রেখে দিতেন, ছাড়ও দিতেন মাঝে মাঝে। আমার পঠন-পাঠন, চিন্তাও মননে বুক ভিলার এক বিরাট ভূমিকা ছিল।

অনেক দিন পরে নিউ মার্কেটে ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁদের নতুন দোকানে। এখনও ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে যেগাযোগ আছে অবয়ব পত্র বন্ধু হিসেবে। মাঝে মাঝে বার্তার আদান-প্রদান হয়।

শেষবার বুকভিলায় গিয়েছি ২০০৯ সালে। সেবার ওখানে গিয়েছি কন্যা-জামাতা রোদেলা- মুনিরকে নিয়ে। তখন দোকানে বসত ফারুক ভাইয়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতা - আমার ছোট ভাই মঞ্জুর বন্ধু এ সহপাঠী। বুক ভিলায় বইয়ের সমারোহ দেখে রোদেলা হতবাক। বহুকাল আগে তার শৈশবে কিনে দেয়া ‘ছড়ার ছবি’ র সব ক’টি বই সেখানে পেয়ে সে হতবাক। কোথাও পাওয়া যায় না ওগুলো এখন। মনে পড়ল, আমার কৈশোর-যৌবনেও যে বই কোথাও পাওয়া যেত না, তাও পাওয়া যেত বুক ভিলায়।

যখন বেরিয়ে আসি, তখন একবার পেছন ফিরে তাকাই। দেখি, একদল কিশোরী হৈ হৈ করতে করতে বুকভিলায় ঢুকল। ঢুকেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল বইয়ের ওপরে। একটু হেসে কন্যার হাত ধরে আমি রাস্তায় পা বাড়াই।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক।

একে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি