জীবন সংগ্রামে জয়ী জবেদা
প্রকাশিত : ১৬:০৩, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১০:১৮, ২৫ জুলাই ২০১৮
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয়েছিল শেরপুরের মেয়ে জবেদার। তুষারের সঙ্গে যখন তার বিয়ে হয় যখন তার বয়স মাত্র ১৪। তাদের সংসারে চলছিল ভালোভাবেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জবেদার বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় একটি দুর্ঘটনায় তার স্বামীর মৃত্যু হয়। ততো দিনে তার কোলজুড়ে এসেছে এক ছেলে ও এক মেয়ে। এর মধ্যে ছেলেটি প্রতিবন্ধী।
দুই সন্তানকে নিয়ে স্বামীহারা জবেদা যেন দু’চোখে অন্ধকার দেখছেন। স্বামীর তেমন কোনো সম্পদ না থাকায় দুই সন্তানকে নিয়ে শেরপুর থেকে রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। কারওয়ান বাজার রেল লাইনের পাশের বস্তিতে এক রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
ঢাকায় আসার কয়েক বছর পর শফিক মিয়া নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পুনরায় বিয়ে হয়। তিনি নতুন সংসার করলেও তা গড়ায়নি বেশি দূর। নতুন করে গড়ে ওঠা সংসারেও রয়েছে তার এক সন্তান। সন্তান আর জোবেদাকে ফেলে রেখে চলে যান শফিক। অন্ধকার আরও ঘনিভূত হয়। কিন্তু এসব অন্ধকারকে বিদায় জানিয়ে আলোর দিকেই যেন ছুটছেন জোবেদা।
জবেদা এখন কাজ করেন কারওয়ান বাজারের পাইকারী কাঁচা বাজার মার্কেটে। দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে কাজ করেন। কাজ শেষে যে টাকা পান তা দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন সংসার। বেশি পরিশ্রম করায় এখন তার চেহারায় বাধ্যর্কের ছাপ এসেছে। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপরও তার সংগ্রাম থেমে নেই। কারণ তার আয়েই যে চলে চারজনের সংসার।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাইকারী মার্কেটে পড়ে থাকা সবজিগুলো নিজের সংগ্রহে রাখেন। কাজ শেষে এসব সবজি নিয়ে নিজেই দোকান নিয়ে বসে যান। অস্থায়ী দোকান থেকে প্রতিদিন ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা পর্যন্ত আয় আসে তার। কিন্তু এখানে তার আয়ে ভাগ বসায় বাজার কমিটি। প্রতিদিন বাজার কমিটিকে ১শ’ টাকা হারে চাঁদা না দিলে অস্থায়ী দোকান বসতে দেয় না বলে জানান তিনি।
তার মেঝ ছেলে হৃদয় এখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ২০ বছর বয়সী মেয়ে ময়নাকে খুব বেশি লেখা-পড়া করাতে পারেননি জবেদা। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে সে। এখন মেয়েটি একটি গার্মেন্টসে চাকরি করছেন। মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা বাসা ভাড়া আর ছেলে-মেয়েদের খরচ যোগাতে যেন হাপিয়ে উঠছেন তিনি। তারপরও মাসে মাসে খরচ বাঁচিয়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকা করে সঞ্চয় করে থাকেন।
তিনি এ প্রতিদেককে বললেন, তার সঞ্চয়ের কাহিনী। জবেদার সঙ্গে কথা হতেই হাসি মুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেও তার মাঝে যেন হতাশার ছাপ ছড়িয়ে আছে। সে জানাল, আমার এই সামান্য সঞ্চয়গুলো মেয়ের (ময়না) জন্য করা। তার বিয়ে দিতে হবে, ছেলের পড়াশোনার ব্যবস্থা করাতে হবে। এ জন্যই এ সঞ্চয়।
স্বামী বেঁচে না থাকলেও জবেদাই এখন সন্তানদের বাবা-মা। তাদের মুখে হাঁসি ফোটাতে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। প্রতিদিনই ভোর ৩টায় কাঁচাবাজারে আসেন। পাইকার ব্যবসায়ীদের কাজে সহযোগিতা করেন তিনি। বিনিময়ে তারা কিছু কিছু সবজি দেয় জোবেদাকে। এসব সবজি নিয়ে তিনি অস্থায়ী বাজার বসান। এ দিয়ে যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে চলছে সংসার, ছেলের পড়া আর সামান্য সঞ্চয়।
তিনি এ প্রতিবেদককে জানালেন, আমার সংসারের হাল কাউকে ধরতে হবে না। তবে আমার প্রতিবন্ধী ছেলেটার জন্য যদি একটু সরকারি সহযোগিতা পাওয়া যেত তাহলে আমার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হতো। আমি আমার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারতাম। মেয়েটার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। টাকার অভাবে এখনও বিয়ে দিতে পারিনি।
জোবেদার মতো আরও অনেক নারী এভাবেই কাজ করছেন রাজধানীর বৃহতম এ পাইকার বাজারে। তারা দিনের পর দিন কাজ করে অভাবকে জয় করে চলেছেন। এরপর কোনো ভিক্ষাবৃত্তিকে পুঁজি হিসেবে নেননি। হাত পাতেননি কারো কাছে।
আর/এসএইচ/