স্বপ্না ভৌমিকের এগিয়ে যাওয়ার গল্প
প্রকাশিত : ১৫:০৫, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৫:৪৯, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

স্বপ্না ভৌমিক- সংগৃহীত
স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্নের ডানায় ভর করে চলতেন। তবে নানা দোটানায়ও ছিলেন তিনি। আগ্রহ এক দিনে তৈরী হয় না। বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন পর্যায়ে তৈরী হয় আগ্রহ। আর বাবার আগ্রহ ছিল ভিন্ন। অবশেষে মেয়ের পীড়াপীড়িতে বাবার আগ্রহ মিলিত হলো মেয়ের আগ্রহের সঙ্গে। সে অনেক বছর আগের কথা। এখন তিনি বিশ্বখ্যাত একটি ব্রান্ড’র বাংলাদেশ প্রধান। বলছিলাম মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার’র (এমঅ্যান্ডএস) কান্ট্রি ডিরেক্টর বা বাংলাদেশ প্রধান স্বপ্না ভৌমিকের কথা।
২০১৩ সালে স্বপ্না এ দায়িত্ব নেন। তখন ব্রান্ডটি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করত ১৩ কোটি ডলারের পোশাক। পোশাক সরবারহ করত ৩০টি কারখানা। স্বপ্নার নেতৃত্বে বাংলাদেশে ব্যবসা বৃদ্ধি করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এ ফ্যাশন ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে আমদানি করছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পোশাক। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও ৩০ থেকে বেড়ে ৬০-এর কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে স্নাতক অর্জন করা স্বপ্না রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে আগ্রহের জন্য বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বিইউএফটি)। বিইউএফটির ডিপ্লোমা কোর্সে ভালো ফলের সুবাদে স্বপ্না ডাক পেলেন দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে। ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাও শেষ। গার্মেন্টসে কাজ করবেন কি করবেন না, এমন দোটানার মধ্যে সেই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন। প্রথম দিন কারখানায় পরিদর্শনে গিয়েই ধাক্কা খেলেন স্বপ্না। নারী
পোশাকশ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো বাথরুম নেই। পুরুষদের বাথরুমই ব্যবহার করতে হতো তাঁদের। বড় প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সুপারভাইজার বা ব্যবস্থাপক পদে কোনো নারী নেই। নারীদের জন্য কিছু করার তাগিদে সেদিনই স্বপ্না চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন—পোশাকশিল্পেই কাজ করবেন।
একজন সহকারী মার্চেন্ডাইজার থেকে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের বাংলাদেশি প্রধান হওয়ার গল্প বলেছেন দেশে একটি দৈনিকের কাছে। বললেন, ‘ছোটবেলায় আমি জানতাম না, বড় হয়ে কী হব। তবে একটি বিষয়ে পরিষ্কার ছিলাম, আমি পরিবর্তন চাই। সেটি যেখানেই হোক। জীবনে যা–ই করি না কেন। যদি আমি ছোটা বুয়াও হই, তাহলেও শ্রেষ্ঠ ছোটা বুয়া হব।’
মাগুরার নতুন বাজারে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন স্বপ্না ভৌমিক। সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে বদলি হলেন বগুড়ায়। সঙ্গে পরিবারও থিতু হলো সেখানে। পুলিশ লাইন হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন স্বপ্না। পরে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি।
রেনেসাঁ গ্রুপ দিয়ে পোশাকশিল্পে কর্মজীবন শুরু করেন স্বপ্না ভৌমিক। প্রতিষ্ঠানটিতে দুই বছর কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে স্বপ্না ভৌমিক বলেন, ‘খুবই চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল। হেড অফিসে কাজের পাশাপাশি সপ্তাহে চার দিনই আমাদের কারখানায় যেতে হতো। কারখানার পরিবেশ তখনো সে রকম উন্নত ছিল না। তবে সুতা থেকে কাপড় উৎপাদন, তারপর পোশাক তৈরি, মেশিনপত্র কিংবা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলা—সবকিছুতে আমি অন্য রকম আনন্দ পেতাম। সকালে বের হতাম আর কাজ শেষে রাতে বাসায় ফিরতাম। সব মিলিয়ে ১৮-১৯ ঘণ্টা কাজ করতাম।’
২০০২ সাল। হঠাৎ একদিন ব্রিটিশ খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড নেক্সটের কাছ থেকে ফোন পেলেন স্বপ্না। তারা জানতে চাইল, নেক্সটে কাজ করতে স্বপ্না আগ্রহী কি না। সাতপাঁচ না ভেবে সহকারী মার্চেন্ডাইজার হিসেবে যোগ দিলেন স্বপ্না। এর দেড় বছর পর মার্কিন খুচরা ওয়ালমার্টে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে যোগ দিলেন স্বপ্না।
২০০৬ সালে মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার এ আসলেন। তখন এর তুলনায় ওয়ালমার্ট বেশ বড় কোম্পানি। তারপরও চ্যালেঞ্জ নিলেন স্বপ্না ভৌমিক। বললেন, ‘এমঅ্যান্ডএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম দিন কথা বলে আমি বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশ নিয়ে বড়সড় পরিকল্পনা আছে। তাঁদের পরিকল্পনা ও চিন্তাধারা ছিল একটু অন্য রকম। সেখানে কাজ করার অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে। তা ছাড়া বিশ্বখ্যাত একটি ব্র্যান্ড বাংলাদেশে নতুনভাবে শুরু করতে চাচ্ছে—বিষয়টি আমাকে বেশ অনুপ্রেরণা দিল।’
ওয়ালমার্টের অফিসে ফিরে স্বপ্না যখন বললেন, তিনি এমঅ্যান্ডএসে যোগ দিচ্ছেন, তখন সহকর্মীদের প্রায় সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে লাগলেন। স্বপ্না ভৌমিক বললেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল কীভাবে ব্র্যান্ডটিকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। তো সবাইকে বুঝিয়ে আমি মার্চেন্ডাইজার হিসেবে এমঅ্যান্ডএসে যোগ দিলাম।’
এমঅ্যান্ডএসের ঢাকা কার্যালয় তখন ছোট। লোকবল কম। ফলে পোশাকের নকশা উন্নয়ন থেকে শুরু করে ক্রয়াদেশ দেওয়া এবং কারখানায় উৎপাদন পর্যায়েও কাজ করতেন স্বপ্না ভৌমিক। প্রয়োজনে চট্টগ্রাম বন্দরেও চলে যেতেন। ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা দিয়ে ব্র্যান্ডের কর্তাব্যক্তিদের নজর কাড়লেন। কান্ট্রি ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি দামের পোশাক বানানোর দিকে নজর দিই উল্লেখ করে স্বপ্না বলেন, ‘বাংলাদেশকে কীভাবে সারা বিশ্বের কাছে গন্তব্য বানাতে পারি, সেই চিন্তাই বেশি ঘুরপাক খেত। তখন আমাদের সরবরাহকারীরা সস্তা পোশাক বেশি পরিমাণে বানাতেন। তাঁদের সমস্ত নজর সেদিকে ছিল। ধীরে ধীরে তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা চালাই। এমঅ্যান্ডএস পণ্যের মানের বিষয়ে বেশ সংবেদনশীল। সেজন্য জার্নিটা ছিল বেশ কঠিন। বর্তমানে এমঅ্যান্ডএসের জন্য মোজা থেকে ব্লেজার পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের পোশাকই প্রস্তুত হয়।’
এক সময় এমঅ্যান্ডএসের সব পোশাকই বিদেশি কাপড়ে তৈরি হতো। সে জায়গায় বিরাট পরিবর্তন এনেছেন স্বপ্না ভৌমিক। বর্তমানে ব্র্যান্ডটির জন্য প্রস্তুত হওয়া পোশাকের ৫৫ শতাংশ কাপড় দেশীয় বস্ত্রকল সরবরাহ করছে। তা ছাড়া এমঅ্যান্ডএস সবচেয়ে বেশি ডেনিম বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে। আর পোশাকের কথা বললে এমঅ্যান্ডএসের সবচেয়ে বেশি পোশাক প্রস্তুত হয় বাংলাদেশি কারখানায়।
নারী শ্রমিকদের জন্যও কাজ করেছেন স্বপ্না ভৌমিক। বর্তমানে এমঅ্যান্ডএসের পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে ১৫০ জন নারী সুপারভাইজারসহ বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় পদে আছেন। নেতৃত্বে নারী ও পুরুষের ভারসাম্য থাকলে অনেক সমস্যা সমাধানের কাজ সহজ হয় বলে মন্তব্য করেন স্বপ্না।
স্বামী অনিন্দ্য চৌধুরী, ছেলে অরিত্র্ চৌধুরী, শাশুড়ি, বাবা-মাকে নিয়ে স্বপ্না ভৌমিকের সংসার।
এমএস/