চট্টগ্রামের ৫ দৈনিক পত্রিকা অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ
প্রকাশিত : ১৪:২৩, ৭ আগস্ট ২০২০
নিত্যদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিরহ ব্যথার বার্তা বহন করে যে কাগজটি ভোর হতে না হতেই আমাদের দ্বারে প্রবেশ করে , তার নাম সংবাদপত্র। বর্তমান গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বহু দল ও মতের ধারক-বাহক হিসেবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে। সংবাদপত্র গণতন্ত্রের সদা জাগ্রত প্রহরী।এটিকে একটি সমাজের সামগ্রিক পরিচয়ের প্রাত্যহিক দলিল ও বলা হয়। মহাবিচারপতির বিচারলয়ে এটি নিপীড়িত মানুষের পক্ষ সমর্থন করে।
মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, গণতন্ত্রের মর্যাদা লুণ্ঠিত কিংবা গণতন্ত্রের পবিত্রতা কোনো কারণে কলুষিত হলে সংবাদপত্রের নির্ভীক কণ্ঠ সেখানে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সংবাদপত্র তাই জনগণের পবিত্র গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণের সর্বদা দায়িত্বশীল অভিভাবক। বতর্মমান সভ্যজগতে সংবাদপত্রের অস্তিত্বহীনতা কল্পনাও করা যায় না। প্রকৃত জরকল্যাণই সংবাদপত্রের একমাত্র কাজ ও লক্ষ্য।
সে জন্যে সংবাদপত্রের কাজে যারা নিয়েজিত তাদের নিরেপক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা উচিত। সংবাদপত্র ও এর কর্মকর্তারা যতো দল নিরেপক্ষ, নির্ভীক শিক্ষিত ও সভ্য হবেন, ততোই দেশ ও জনগণের মঙ্গল। কোনো ব্যক্তি, সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধানের সকল পথ যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন তারা সংবাদপত্র তথা সাংবাদিকদের শরণাপন্ন হয়। তাই বলা হয়, “ It is the peoples parliament always in sessions.” সংবাদপত্র আক্ষরিক অর্থে জনগণের সদা জাগ্রত জাতীয় সংসদ।
সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক ও সাংবাদিকরা জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। পত্রিকার মালিক-সম্পাদক ও সাংবাদিকদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদা-ই আলাদা। সংবাদপত্রশিল্পকে ব্যবসায়িক দুষ্টিভঙ্গিতে না দেখে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করতে হয়। এর ব্যতিক্রম হলে সংবাদপত্রশিল্প সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় না। মালিকপক্ষ যদি উদারদৃষ্টিভঙ্গি ও সাংবাদিকবান্ধব হন, তাহলে পত্রিকামালিক ও সাংবাদিকেরা একই পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে যান। পরস্পরের মধ্যে ভালো বোঝাবুঝি ও আন্তরিকতা ও সহমর্মীভাব তৈরি হয়। সংবাদপত্র নিয়ে এ গল্পের মূল উদ্দেশ্য চট্টগ্রামের পাঁচটি স্থানীয় দৈনিকের হঠাৎ করে ঘোষণা ছাড়াই বন্ধের বিষয়টি আলোকপাত করা।
ঈদের আগে পূর্ণাঙ্গ বেতন-বোনাসের দাবীতে সাংবাদিকদের দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের বাসা ঘেরাও কর্মসূচির ফলে চট্টগ্রামের ৫টি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। পত্রিকা গুলো হচ্ছে, দৈনিক আজাদী, পূর্বকোণ, পূর্বদেশ, সুপ্রভাত বাংলাদেশ ও বীরচট্টগ্রাম মঞ্চ। মালিক-সম্পাদকেরা এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্যে আগাম ঘোষণা ছাড়া পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা বন্ধ করায় তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সিইউজে নেতৃবৃন্দ।
কয়েকটি পত্রিকার মালিক কোরবানির ঈদে অর্ধেক বোনাস দিলে সংবাদকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ঈদের আগে পুরো বেতন ও বোনাসের দাবীতে পত্রিকার মালিক-সম্পাদকের বাড়িঘেরাও কর্মসূচি দেয় চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন )সিইউজে)। এর আলোকে গত ৩০জুলাই সকালে নগরের খলিফাপট্টি এলাকায় দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের বাসভবন ঘেরাও করে সমাবেশ করে সিইউজে। গত ২৯জুলাই বুধবার রাতে এ পাঁচটি দৈনিকে কাজ চললেও গভীর রাতে চট্টগ্রামের পত্রিকা মালিক-সম্পাদকের সংগঠন চট্টগ্রাম নিউজপেপার অ্যালায়েন্স সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন (৩০জুলাই) পত্রিকা প্রকাশিত হবে না। এ প্রেক্ষাপটে ঈদের আগের বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার পত্রিকা ৫টি প্রকাশিত হয়নি। ৪আগস্ট পর্যন্ত ঈদের ছুটি থাকায় ৫আগস্ট পত্রিকার প্রকাশের কথা থাকলেও তা হয়নি।
সিইউজে নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নিয়মাতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবীদাওয়া জানিয়ে আসলেও মালিকপক্ষ তাতে সাড়া না দেয়ায় তারা বাসাঘেরাও এর মতো কঠিন কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, “পত্রিকা বের করার কোনো পরিবেশ আছে, কীভাবে পত্রিকা বের করবো? ইজ্জত নিয়ে যেখানে টানাটানি, নিজের স্ত্রী-সন্তান ও পাড়াপ্রতিবেশির সামানে যদি কেউ আপনাকে অসম্মান করে আপনার কেমন লাগবে? পত্রিকা মালিকের বাসার সামনে এসে আন্দোলনের ইতিহাস কী অতীতে আর একটি আছে? আমি এখনো বোঝতে পারছি না আমার অপরাধটা কোথায়।”
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আলী চাটগাঁরবাণীডটকম কে বলেন, “ কোনো ঘোষণা ছাড়াই ঈদুল আযহার দু’দিন আগে মালিকপক্ষ আকস্মিকভাবে ৫টি পত্রিকা একসাথে বন্ধ করে দেয়। এটি অত্যন্ত অমানবিক ও অযৌক্তিক। আমরা বার বার চেয়েছিলাম আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কটের সুরাহা করার। কিন্ত্র পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি। আমরা আবারও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আলোচনায় বসে এ অচলাবস্থা নিরসনের আহবান জানাচ্ছি।”
ইতোমধ্যে সাংবাদিকেরা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে তাঁদের দাবী দাওয়া নিয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন।
কথা হচ্ছে, সংবাদপত্রশিল্প আর পোশাকশিল্প এক নয়। পোশাকশিল্পের মালিকেরা যেভাবে পোশাকশ্রমিকদের সাথে আচরণ করেন সেভাবেই সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদকেরা সংবাদকর্মীদের সাথে করতে পারেন না। কেন না, দেশের সবধরনের শিল্প, রাজনীতিক থেকে শুরু করে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ তাদের সমস্যা নিয়ে সংবাদপত্র তথা সাংবাদিকদের দ্বারস্থ হন। এ কারণে সংবাদপত্রকে বলা হয় ফোরথস্টেট। সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সাংবাদিদের মান-মর্যাদা সমাজ ও রাষ্ট্রে অনেক উচ্চতায় ও মর্যাদার। এ কারণে সংবাদপত্রশিল্পের অভ্যন্তরিণ সমস্যা ও পারস্পরিক ভুলবোঝাবুঝি নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলালোচনা করে সমাধান করাই শ্রেয়। বাইরের কেউ এ সমস্যা সমাধানে হস্তক্ষেপ করা মালিক-সম্পাদক ও সাংবাদিকদের জন্যে বড়ই অসম্মানের। যে পাঁচটি পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে সেখানে আজাদী-পূর্বকোণ তো অনেক প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা।
বিশেষ করে আজাদীর প্রকাশানার অর্ধশতাধিক বছরের ইতিহাম-ঐতিহ্য আছে, আছে এর অগণিত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতা। এ পত্রিকার সম্পাদক তো চট্টগ্রামের দৈনিক পত্রিকারগুলোর মালিকদের সংগঠনের সভাপতি। তিনি সাংবাদিকদের শ্রদ্ধাভাজন মুরুব্বিও বটে। সাংবাদিকেরা প্রয়োজনের তাগিদে তাঁর বাসার সামনে কর্মসূচি দিয়েছেন, অবশ্যই বিষয়টি অসুন্দর ও অপ্রত্যাশিত। অন্যভাবেও আন্দোলন করা যেতো। যা হয়েছে- তা ক্ষমাসুন্দরদৃষ্টিতে নিয়ে আজাদী’র স্বনামধন্য সম্পাদক লায়ন এম এ মালেক আলাপ-আলোচনা মাধ্যমে চলমান সঙ্কটের সহজে সুরাহা করতে পারেন।
এছাড়া ঈদবোনাসের জন্যে রাস্তায় নামা- সাংবাদিকদের জন্যেও তো খুবএকটা সম্মানের নয়। সাংবাদিক আর মালিক-সম্পাদক তো একে অন্যের প্রতিপক্ষ নন। কোনো সঙ্কট তৈরি হলে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা যায়।এদিকে বকেয়া পাওনাদি ও পত্রিকা পাঁচটি চালুর দাবীতে আজ সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।
অন্যদিকে বন্ধ পত্রিকাগুলোর পাঠকেরাও কিন্তু পত্রিকা পাঠ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা, সংবাদকর্মীদের “অভিভাবক” হিসেবে এ ব্যাপারে আজাদী সম্পাদক দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
লেখক: প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম