ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের জনকূটনীতি

মাসুদ করিম

প্রকাশিত : ১১:৩৩, ২৩ নভেম্বর ২০২০

[পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক সামিয়া হালিম আমাকে আমার কূটনৈতিক বিটের সংগঠন ডিকাবের অন্য কলিগদের সঙ্গে একটি ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি তার ডিনারে অংশ নেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। সামিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি উইংয়ের মহাপরিচালক। এই উইংটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন সংযোজন। আগে নাম ছিল এক্সটার্নেল পাবলিসিটি সংক্ষেপে ইপি উইং। পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির যাত্রা শুরুর বিষয় উদযাপনের লক্ষ্যে ডিনারের আয়োজন বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির ব্যাপারে আমার প্রবল আগ্রহ রয়েছে বিধায় এই উইংয়ের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরুর ডিনারে অংশ নেয়ার বিষয়ে আমার এত আগ্রহ। আমি অবশ্যই এই উইংয়ের প্রথম প্রধান হিসাবে সামিয়া হালিমকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাব। এই অভিযাত্রায় তার সাফল্য কামনা করবো। 

পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির যাত্রা শুরুর ঘটনাকে আমার কিছুতেই ছোট মনে হচ্ছে না। কারণ পৃথিবীতে বহু অসামান্য অর্জন পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। এ নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তর আলোচনা ভবিষ্যতে করা যাবে। আমি আজকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি কীভাবে বিশ্বব্যাপি জনমত প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য অবদান রেখেছিল; সে ব্যাপারে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি। পাশাপাশি, ওই সময়ে পাবলিক ডিপ্লোম্যসিতে সাংবাদিকরা কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন; যাদের কেউ কেউ নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে আমাদেরকে দিয়েছিলেন; একটি লাল-সবুজ পতাকা, স্বাধীন মানচিত্র। আমি আজ তাদেরকেও স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়।  
 
মুক্তিযুদ্ধে পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি তথা জনকূটনীতি নিয়ে আমি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নিউজলেটার রিপোর্টার্স ভয়েসের একটি লেখা লিখেছিলাম। সেখানে আমি আমজাদুল হকের সঙ্গে আমার আলাপচারিতার কথা উল্লেখ করেছি।] 

দিল্লিতে পাকিস্তানের প্রেস অ্যাটাশে ছিলেন আমজাদুল হক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। বাঙালীরাও গড়ে তোলে প্রতিরোধ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দিল্লিতে বসে সে খবর পেয়ে পাকিস্তান হাই কমিশনের আরেক বাঙালী কে এম শিহাব উদ্দিনের সঙ্গে গোপন আলোচনায় বসেন আমজাদুল হক। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অব্যবহিত পরেই ২৮ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে তারা পাকিস্তান হাই কমিশনের চাকুরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

চাকুরি ছেড়ে তারা কী করবেন এ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল- কেননা বাংলাদেশ সরকার গঠন হয়নি তাই ভারতে থাকা তাদের সম্ভব হবে না। ওই সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাকিস্তান ডেস্কের যুগ্ম সচিব এ কে রায়ের শরনাপন্ন হলেন। এ কে রায় তাদের ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার পরামর্শ দেন। সেই মোতাবেক রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন দুই বাঙালী। ভারতে তখন রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ক্ষমতা রাখেন শুধু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দিল্লিতে ওই সময়েই সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। ওই আলোচনা এতটাই গোপনে চলেছে যে, আমজাদুল হকরাও তখন ওই খবর জানতেন না।

ইন্দিরা গান্ধী ৫ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে করা দরখাস্ত অনুমোদন করেন। ফলে ভারতে অবস্থান করা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অবসান হয়। রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুমোদন পেয়ে কোনও দেরি না করে আমজাদুল হক ও শিহাব উদ্দিন ৫ই এপ্রিল মধ্যরাতেই পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারত সরকার হায়দরাবাদ হাউস নামে পরিচিত তাদের দেশের তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিরাট সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করার অনুমতি দেয়। কিন্তু তারা সেখানে সংবাদ সম্মেলন করতে রাজি হননি। সংবাদ সম্মেলন করার অন্য জায়গা খোঁজেন।

কে এম শিহাব উদ্দিন এখন আর বেঁচে নেই। আমি যখন আমজাদুল হকের সঙ্গে কথা বলি; ওই সময়ে তাঁর বয়স ছিল ৮০ বছরের বেশি। আমি আমজাদুল হককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তারা সেদিন হায়দরাবাদ হাউসে সংবাদ সম্মেলন করেননি। জবাবে তিনি বলেন, ভারতের সরকারী প্রতিষ্ঠানে সংবাদ সম্মেলন করলে তাদেরকে ভারতের দালাল বলে অভিহিত করতো পাকিস্তান। জনমনে এমন ধারণা বদ্ধমূল হতো যে, ভারতই এসব করাচ্ছে। 

প্রেস অ্যাটাশের পদটা এমন যে, দেশি-বিদেশি সব সাংবাদিকের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয়। এই কাজকে বলে পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি - বাংলায় যাকে বলা যায় জনকূটনীতি। আজকাল পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির কাজে সাংবাদিকদের অহরহ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। 

আমজাদুল হক এবং কে এম শিহাব উদ্দিনের ঘটনাটি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিদেশে পাকিস্তানের পদ ছেড়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। ফলে গোটা বিশ্বই তাদের বিষয়টি আলোকপাত করে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তাদের নাম উঠে যায়। হায়দরাবাদ হাউসে সংবাদ সম্মেলন না করে তারা সংবাদ সম্মেলন করেন তৎকালে টাইমস অব ইন্ডিয়ার যুগ্ম সম্পাদক দিলিপ মুখার্জির ড্রইং রুমে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংবাদ কভার করার জন্যে ওই সময়ে বিদেশী সাংবাদিকরা দিল্লিতে থাকতেন। 

তখন দিল্লিভিত্তিক বিদেশী সাংবাদিক ছিলেন ৪৯ জন। আর বাংলাদেশে পাক বাহিনীর হামলার ঘটনা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ সহজ ছিল না। আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর পেতে মুখিয়ে ছিল। ফলে দিল্লিতে ৫ এপ্রিল রাত ১২টার ওই সংবাদ সম্মেলনে ৪৯ জন বিদেশী সাংবাদিকের সবাই উপস্থিত ছিলেন। ভারতের মিডিয়ার সাংবাদিক ছিলেন ৪১১ জন। দিলিপ মুখার্জির কার্পেট বিছানো ড্রইংরুমে তখন বসার জায়গা ছিলনা। এতটাই জনাকীর্ণ ছিল ওই সংবাদ সম্মেলন। যুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের বক্তব্য সবাই জানে। বাংলাদেশের বক্তব্য তখনও বাইরের দুনিয়া জানে না। 

সংবাদ সম্মেলনে তাই প্রথম প্রশ্নই ছিল, তারা কোন কর্তৃত্ববলে বাংলাদেশের পক্ষের হয়ে সংবাদ সম্মেলন করছেন, বাংলাদেশ কি সরকার গঠন করেছে? বাংলাদেশ কি তাদের কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়েছে?

এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া ওই সময়ে খুবই কঠিন ছিল। আমজাদুল হক তাই কৌশলী হয়ে জবাব দেন, ‘আমরা এখন গেরিলা। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা। ২৫ মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। নতুন রাষ্ট্র হয়েছে বাংলাদেশ’। এভাবেই আমজাদুল হক মুক্তিযুদ্ধে জনকূটনীতি শুরু করেন। তারপর আরও ঘটনা আছে। কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশন ছিল জনবলের দিক থেকে বিশ্বে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ কূটনৈতিক মিশন। তবে ওই মিশনের প্রধান ছিলেন বাঙালী কর্মকর্তা হোসেন আলী। কলকাতা মিশনে বাঙালী কর্মকর্তা ছিলেন ৬৫ জন। হোসেন আলী ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। ৬৫ বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবাই বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। এটি ছিল বিদেশে প্রথম কোনও পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণার ঘটনা। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালী কর্মকর্তারা সেখান থেকে পালিয়ে যান। হোসেন আলী, আমজাদুল হক, শিহাব উদ্দিনরা মিলে বাংলাদেশের পক্ষে চালিয়ে যান নানা কূটনৈতিক তৎপরতা। 

আমজাদুল হক প্রেস অ্যাটাশে হলেও তিনি পেশায় সাংবাদিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাকিস্তান তথ্য সার্ভিসের লোক। কিন্তু তার কাজের ধরন হলো আধা সাংবাদিক আধা কর্মকর্তার মতো। পেশায় সাংবাদিক ছিলেন আমজাদুল হকের ভাই নজমুল হক। তিনি ঢাকায় থেকে তিনটি সংবাদ মাধ্যমে এক সঙ্গে কাজ করতেন। এ তিনটি সংবাদ মাধ্যম হলো পিপিআই, সিটি টাইমস এবং সিবিএস। নজমুল হক এবং আরেক সাংবাদিক আতাউস সামাদ পল্টনে একই বাড়িতে থাকতেন। দুইজন দুই ফ্লোরে থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঢাকায় থেকে বাঙালীদের সাংবাদিকতা করা ছিল অসম্ভব কাজ। তখন জীবন বাঁচানোই ছিল কঠিন। 

আতাউস সামাদ প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁচতে পারেননি নজমুল হক। পাকিস্তানী বাহিনী তার বাড়িতে ঢুকে হত্যা করার আগে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চরম নির্যাতন করেছে। ওই নির্যাতনে অসহায় নজমুল ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেছেন। বড় দুঃসময় গেছে তখন। এই আর্তনাদ শুনেও কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার সাহস পাননি। বরং পাক বাহিনী উপহাস করে বলেছে, এখন তোকে কে বাঁচাবে, কেউ বাঁচাতে আসবে না! আমজাদুল হক আমাকে বলেছেন, তার ভাই নজমুলকে আরেক শহিদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের সঙ্গে হত্যা করা হয়। নজমুল হকের লাশ পর্যন্ত পাননি তার পরিবার। ওই সময়ে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকেও হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। এভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তারা। 

প্রতিহিংসায় বুদ্ধিজীবিদের টার্গেট করেছিল পাক বাহিনী। সাংবাদিকরা এমন কি করেছিল যে, তারা পাক বাহিনীর টার্গেট হন! মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব কূটনীতিক পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন তাদের অন্যতম মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি তখন পাকিস্তানের লন্ডন মিশনে কর্মরত ছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী কূটনীতিকদের একজন। আরও অনেকে ছিলেন।  

নজমুল হক, সিরাজউদ্দিন হোসেন, সেলিনা পারভীনরা বাঁচতে পারলেন না কেন? তারা এমন কি করেছিলেন যে, হানাদার বাহিনী তাদের শুধু গুলি করে হত্যা করেনি; বরং হত্যা করার জন্যে তাদের বেয়োনেটের খোঁচাখুচি করার মতো চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে? প্রতিহিংসার কি ক্রোধে নজমুলের লাশ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে ফেলে? আমার ব্যাক্তিগত ধারণা, নজমুলেরা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন কিছু করেছেন যা তাদের বিক্ষুব্ধ করেছে। সেটা অবশ্যই বর্হিবিশ্বে জনমত সৃষ্টির কাজ বলেই অনুমেয়। এ কাজকে বাংলাদেশের পক্ষে জনকূটনীতি বলা যায়। এ কারণে তাদেরকে হত্যার ধরনেও নিষ্ঠুরতা লক্ষ্যনীয়। নজমুলের সহকর্মী আতাউস সামাদ ভারতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে তার সহযাত্রী হয়ে দেশে ফেরেন।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’-এর লেখক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ছিলেন ইত্তেফাকের সাংবাদিক। তিনি কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনকূটনীতি জাতীয় কর্মকান্ড করেছেন। কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ‘বিশ্ব বেহায়া ইয়াহিয়া’ বিরোধী পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি করেছেন। কলকাতায় পত্রিকা বের করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি জনকূটনীতি করেন টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান। লন্ডনে সাপ্তাহিক ‘জনমত’ পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনেক জনমত গড়ে তোলে বিদেশীদের বাংলাদেশের পক্ষে আনে। ওই সময়ে পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন এ টি এম ওয়ালি আশরাফ। এক সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন। পরে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। এ রকম অনেক সাংবাদিকই জনকূটনীতিতে যুক্ত ছিলেন। 

বাংলাদেশের পক্ষে জনকূটনীতি করেছেন বিদেশী অনেক সাংবাদিক। তাদের একজন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। তিনি করাচির মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তিনি গোয়ানিস ছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবহতার তথ্য সংগ্রহ করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এসব পাকিস্তানের পত্রিকায় প্রকাশ করা সম্ভব হবেনা। তখন তিনি লন্ডনের সানডে টাইমসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সানডে টাইমসে গণহত্যার খবর প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তোলপাড় হয়। অ্যান্থনি পরে তার পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান। ১৯৮৬ সালে লন্ডনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার লেখা দু’টি বই ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলাদেশ : অ্যা লিগেসি অব ব্লাড’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পাক বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার অনন্য দলিল।

একাত্তর সালের মার্চে অনেক বিদেশী সাংবাদিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এটা বুঝতে পেরে অনেক বিদেশী সাংবাদিক আগেভাগেই শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জড়ো হন। তাদের অন্যতম ছিলেন সায়মন্ড ড্রিং। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে যে অভিযান চলে, ইন্টারকন্টিনেন্টালের ছাদের কোনও এক গোপন স্থান থেকে তিনি এর চিত্র ধারণ করেন। তারপর পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের টেলিগ্রাফে তা প্রকাশ করার পর প্রথমবারের মতো বিশ্ব জানতে পারে যে, বাংলাদেশে তখন কী ঘটছে!

মার্ক টালি ছিলেন বিবিসি’র দিল্লি প্রতিনিধি। পাকিস্তানি জান্তা যখন সবই সেন্সর করেছিল, তখন বিবিসি রেডিও ছিল বস্তুনিষ্ঠ খবর পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম এবং মার্ক টালি ছিলেন তার নেপথ্যে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী সাংবাদিকদের ভূমিকাও অনেক দীর্ঘ। এদেশের বাঙালী সাংবাদিকদের আত্মত্যাগ, বর্হিবিশ্বে বাঙালী সাংবাদিকদের ভূমিকা, বিদেশী সাংবাদিকদের ঝুঁকি নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ বর্হিবিশ্বে প্রকাশ করা- এসবের কারণে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে আসে। এসব কারণে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে থাকলেও ওই দেশেরই নাগরিক জর্জ হ্যারিসন গেয়ে ওঠেন ‘বাংলাদেশ ... বাংলাদেশ ...’। এ কারণে দুর্গত বাঙালীর জন্যে চাঁদা তোলে জাপানেরই জনগণ। ভারতের কথাতো বলাই বাহুল্য। পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নাই, যে দেশের জনগণ বাংলাদেশে নিষ্ঠুর গণহত্যার খবর জানে না। সাংবাদিকদের মাধ্যমেই বিশ্ববাসী এই খবর জানতে পারে। ওইসব সাংবাদিকরাই জনকূটনীতি করেছেন। তারাই আমাদের হিরো।     


[আজকাল পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির পরিধি অনেক বেড়েছে। সময়ের বিবর্তনে, প্রযুক্তির উৎকর্ষতায়, বিশ্বব্যাপি নিজেকে উৎকৃষ্ঠরুপে তুলে ধরার লড়াইয়ে অর্থনৈতিক, সামরিক, কৌশলগত শক্তিশালী দেশগুলি ‘প্রচারেই প্রসার’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নিজেদের মহত্ব প্রচার করছে। এই সময়ে বাংলাদেশের মতো দেশগুলির বিশ্বব্যাপি নিজেদেরকে তুলে ধরার গুরুত্ব অনেক বেশি। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে যেখানে আমাদের দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র ক্লিষ্ট, ইতাদি নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। কিন্তু আমাদের গৌরনের ঐতিহ্য, অর্জন, সমৃদ্ধি, সক্ষমতা, বদলে যাওয়া অজানা থেকে যাচ্ছে। এমন এক বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিলুপ্ত বহিঃপ্রচার অনুবিভাগ সবচেয়ে অবহেলিত ছিল। এখন পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি বিভাগ নামে অভিহিত করে পুর্নগঠনের উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। আশা করি, বাংলাদেশের সত্যিকার চিত্র ফুটিয়ে তুলতে পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি উইং অবদান রাখবে।]
লেখক : স্থায়ী সদস্য, ডিআরইউ, বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যুগান্তর।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি