যে মানুষ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন
প্রকাশিত : ১৬:৪৮, ২১ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৯:১৩, ২১ জুলাই ২০২১
বিখ্যাত লাতিন লেখক হোর্হে লুই বোর্হেস বলেছিলেন, মানুষ ছাড়া সব প্রাণীই অমর, কারণ তারা জানেই না যে তাদের মৃত্যু হবে। জীবন যে অনিত্য, এই ভয়ানক সত্যটি কখনও মানুষকে ছেড়ে যায় না। জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিলকে বলেছিলেন, প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দেয়, যিনি চলে যান তাঁর অনারব্ধ কাজ সমাপ্ত করবার দায় আমাদের বহন করতে হয়।
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং মারা গেছেন সুদুর রোমানিয়ায়, তার স্ত্রীর কর্মস্থলে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু ঈদের একদিন আগে শোক বয়ে আসে বাংলাদেশে। শুধু সাংবাদিক সমাজ নয়, রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষও ব্যথিত হয়েছেন।
সায়মনকে দু’বার বিদায় জানাতে হল। একবার তাকে বিদায় বলেছিলাম যখন একুশে টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়েছিল জামাত-বিএনপি সরকার সেই ২০০২ সালে। তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল বাংলাদেশ ছেড়ে। আবার এখন বলতে হল চিরদিনের জন্য।
অতিমারিতে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর খবর টিভিতে প্রতি বিকেলে স্তম্ভিত ও ভীত করে আমাদের। এর মধ্যেই এল সায়মনের খবর যাকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম একুশে টেলিভিশনে। প্রথম দেখা ও পরিচয় এক সংবাদ সম্মেলনে, যেখানে সায়মন ও তথ্য সচিব যৌথভাবে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি টিভি আসার খবর জানান দিচ্ছিলেন। এরপর তাঁর উৎসাহেই একুশে-তে যোগ দেয়া, বিবিসি’র প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করা।
দেশে বেসরকারিখাতে টেরিষ্ট্রিয়াল টেলিভিশনের স্বপ্নদ্রষ্টা, বিশিষ্ট শিল্পপতি এ এস মাহমুদ ছিলেন একুশে টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। যিনি 'ডেইলী স্টার'ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন খ্যাতিমান বৃটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং-কে যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার খবর প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে পৌছে দেন। সে সময় তিনি ঢাকা থেকে লন্ডনের ‘দ্যা ডেইলী টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। এর ২৯ বছর পর আবার বাংলাদেশে এসে তিনি একুশে টেলিভিশন পরিচালনার দায়িত্ব নেন।
বার্তা সম্পাদক হিসেবে আমি এবং নিয়াজ মোর্শেদ কাদেরী ছিলাম সরাসরি তাঁর তত্বাবধানে, বলতে গেলে তার নজরদারিতে। উন্মত্ত কর্মোদ্যোগে ব্যাপৃত এমন বস আমি জীবনে কম দেখেছি। সকাল সকাল তাঁর সাথে তাঁর রুমে নাস্তার সাথে সাথে সারাদিনের নিউজ প্লান করতে হত। কখনও কখনও নিজেই বার্তা কক্ষে চলে আসতেন। অফিসে থাকতেন রাত একারটার খবর অন এয়ার পর্যন্ত। কখনও কখনও রাত একটায়ও আমি তাঁর ফোন পেয়েছি নিউজের কোন আইডিয়া বা কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে। আমরা এতটাই কর্ম পাগল ছিলাম তাঁর কারণেই এসব আমাদের স্পর্শ করতে না এখন ঘুমের সময়।
স্ত্রী ফিয়োনা তাঁর ফেসবুক শোক বার্তায় জানিয়েছে মৃত্যুর সময় তাঁর দেহে ছিল একুশে টিভির লগো সম্বলিত পলো শার্ট। একুশের প্রতি তাঁর ভালবাসাটা এমনই ছিল। তাঁর জীবনের মুহূর্তগুলোতে বড় অংশ জুড়ে ছিল বাংলাদেশ আর একুশে টিভি। বাংলাদেশে টেলিভিশন জগতের বিপ্লব ঘটেছে, তাঁর হাত ধরে। উদ্যোক্তা হিসেবে এ এস মাহমুদ ছিলেন বাংলাদেশের শুদ্ধতম ব্যবসায়ী মানুষ। তবে একুশের ব্র্যান্ড ভ্যালু সৃষ্টি হয়েছিল সাইমন ড্রিং-এর নামে।
আমরা যারা প্রথম একুশে-তে কাজ করেছি তারা সবাই সায়মনের শিষ্য। তার শীষ্যরাই ছড়িয়ে আছে এখন বিভিন্ন টেলিভিশনে এবং ভিজুয়াল দুনিয়ার নানা প্লাটফর্মে। সায়মন বাংলা জানতেন না। তাঁর সাথে আমাদের সব যোগাযোগ ছিল ইংরেজিতে। কিন্তু বৃটিশ নাগরিক সায়মনের সেই ভাষা ছিল সহজ সরল এবং সবার কাছে পরিষ্কার। তাই একুশে টেলিভিশনের সংবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল আলাপের ভাষা। সায়মন আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে খবরের মানুষ হয়ে উঠতে হয়, সারাক্ষণ খবরের সাথে থাকতে হয়। স্টাইল, কথা বলার ভঙ্গি, দৃশ্যের সংযোজন সবকিছুর মাঝে রুচির উপস্থিতি নিয়ে সায়মনের মতই হ্যান্ডসাম হয়ে উঠেছিল একুশের সংবাদ।
অনেক অবক্ষয়ের মাঝেও সাংবাদিকতা পেশা পথ হারায় নি, বিশেষ করে টেলিভিশন সাংবাদিকতা। মানুষের কাছে তাঁর আবেদন ম্লান হয়নি। এর কারণ এই যে, এই নির্মম পেশাদারিত্ব আমরা শিখেছিলাম সায়মনের কাছ থেকে। যখন বড় ঘটনা ঘটে, বন্যায়, খরায়, মহামারিতে, ভূমিকম্পে টেলিভিশন যেটুকু দেখায় তাঁর শেখাটা সায়মনের কাছে।
সায়মন ছিলেন বাঙালির আত্মীয়, প্রগতিশীল বাঙালির হৃদয়ের মানুষ। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র তাকে কষ্ট দিয়েছিল। রোমানিয়ায় গত শুক্রবার ৭৬ বছর বয়সে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এ দেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতা, এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আজীবন থাকবেন তিনি।
দেশটাকে আরও ছোট করার, ভাবনাটাকে আরও সংকীর্ণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০১ সালের নির্বাচনের পর। সেই সংকীর্ণ ভাবনার, চরম প্রতিক্রিয়াশীলতার বলি হয়েছিল এদেশের সাংবাদিকতা, প্রগতিশীল সংস্কৃতি, ব্যক্তি হিসেবে এ এস মাহমুদ এবং সায়মন ড্রিং। সায়মনের মত মানুষ যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই প্রতিভা আর ত্যাগের স্বাক্ষর রেখেছেন। সায়মনরা মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। ভরসা জাগিয়ে রাখতে পারেন আমাদের হৃদয়ে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক জিটিভি, একুশে টিভির প্রথম বার্তা সম্পাদক ।