বঙ্গবন্ধুর গণমাধ্যম ভাবনা
প্রকাশিত : ১০:০৩, ১৭ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১১:৩৭, ১৮ জানুয়ারি ২০২০
স্বাধীন গণমাধ্যম বনাম ‘দায়িত্বশীল’ গণমাধ্যম, কোনটি বেশি আকাঙ্ক্ষিত? গণমাধ্যম জগতে এ বিতর্ক বহু পুরোনো। স্বাধীন গণমাধ্যমেরই দায়িত্বশীল হওয়ার কথা। তাহলে স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম, দুটি ভিন্ন ধারণার জন্ম হলো কেন? স্বাধীন গণমাধ্যমের ধারণা যেখানে ব্যর্থ, সেখানেই জন্ম হয় দায়িত্বশীল গণমাধ্যম ধারণার।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ফ্রেডরিক এস সিবার্ট, থিওডর পিটারসন ও উইলবার শ্র্যাম তাদের ‘ফোর থিওরিস অব প্রেস’ বইতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত চার ধরনের গণমাধ্যমের কথা তুলে ধরেছেন। এগুলো হলো- কর্তৃত্ববাদী প্রেস, কমিউনিস্ট প্রেস, লিবার্টিরিয়ান প্রেস এবং সোশ্যালি রেসপনসিবল প্রেস।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকলেই গণমাধ্যম চর্চার সব জনস্বার্থ-সংশ্নিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল হয় এমন ভাবনা এবং বিশ্বাস সর্বক্ষেত্রে প্রমাণিত নয়। ১৯৭১ সালের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চর্চার অবাধ সুযোগ দিয়েছিলেন। এই সুযোগ বেশ নেতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়েছিল তৎকালীন সংবাদপত্রগুলো। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে গণমাধ্যমের যে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেটা তখনকার সংবাদপত্রগুলো রাখতে পারেনি; বলা যায় বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা তারা পালন করেনি।
স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়াও বিশ্বে নানা পদের গণমাধ্যম রয়েছে। কর্তৃত্ববাদী গণমাধ্যমের উদাহরণ আমাদের দেশ থেকে দিতে হলে বলা যায় সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান অথবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলের গণমাধ্যমের কথা। সাম্প্রতিককালে সর্বশেষ সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক আমলের অবস্থা দিয়েও আমরা কর্তৃত্ববাদী মিডিয়া দর্শনের উদাহরণ দিতে পারি।
কর্তৃত্ববাদী প্রেস যেখানে স্বৈরতন্ত্রের মুখাপেক্ষী, কমিউনিস্ট প্রেস সেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন পার্টির দিকনির্দেশনায় চলে। পার্টি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মিডিয়াকে সহযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করে এবং কাজে লাগায়। এখানে পার্টির আদর্শকে সমুন্নত রেখে সাংবাদিকতা করা হয়; তবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি পার্টি তথা রাষ্ট্রের আদর্শ ও লক্ষ্যের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ করে, তাহলে এ নিয়ে সমালোচনা ও পর্যবেক্ষণমূলক সংবাদ, ফিচার, সম্পাদকীয় লেখা যাবে বা প্রচার করা যাবে। সফল কমিউনিস্ট প্রেসের উদাহরণ হিসেবে আমরা চীনের সিনহুয়ার কথা বলতে পারি। সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা গণমাধ্যমের লাগামহীন অপপ্রচারকে রুখে দিয়ে চীন যে এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, সেখানে সিনহুয়ার ভূমিকা ঐতিহাসিক।
লিবার্টারিয়ান প্রেসের মূল কথা হলো, গণমাধ্যমের কোনো ধরনের কর্মকাণ্ডে সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ থাকবে না। মিডিয়া এখানে হবে চূড়ান্ত অর্থে স্বাধীন। স্বাধীন মিডিয়ার নানাবিধ সীমাবদ্ধতা থেকে উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে সৃষ্টি হয়েছে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ধারণা। স্বাধীনতার নামে মিডিয়া স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্বাধীনতার নামে মিডিয়া বেপরোয়াভাবে নেতিবাচক সাংবাদিকতা করতে পারে। রাষ্ট্র ও জনস্বার্থকে কম গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভুর হয়ে কাজ করতে পারে। এ-সংক্রান্ত উদাহরণ আগেই দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন কিন্তু দায়িত্বশীল গণমাধ্যম চাইতেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা হবে। শোষকদের আর বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। কোনো ভুঁড়িওয়ালা এ দেশে সম্পদ লুটতে পারবে না। গরিব হবে এই রাষ্ট্র এবং এই সম্পদের মালিক শোষকরা হবে না।
এই রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ থাকবে না। এই রাষ্ট্রের মানুষ হবে বাঙালি। তাদের মূলমন্ত্র- 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।' বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য কাগজকে আমি মতামত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার দিয়েছি।’’
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে ভাষণ প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :'বিপ্লবের পরে কোনো দেশ কোনো যুগে এতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে নাই, যা আমরা করছি। আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করি। এজন্য আপনাদের কোনো কাজে কখনো কোন রকম হস্তক্ষেপ করি নাই।... বিপ্লবের পরে ছ'মাসের মধ্যে আপনারা যতখানি স্বাধীনতা পেয়েছেন, ততখানি স্বাধীনতা এদেশে পূর্বে কেউ পায় নাই। আমার মতো আপনারা চারটি আদর্শ সমর্থন করেন। আমরা সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাই।
আমরা নতুন প্রচেষ্টা নিয়েছি গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু আমরা স্বাধীনতা দিয়েছি। দুনিয়ায় দেখা গেছে, সমাজতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে অনেক মানুষের মঙ্গলের খাতিরে বাধা দূর করবার জন্য রূঢ় হতে হয়েছে। সেটা আমি করতে চাই না। এজন্য যে, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা, আমি চেষ্টা করে দেখছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমার আন্দোলন। সেই জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব নষ্ট হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাও আমাদের আদর্শ।'
সভাপতি; সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়