করোনা মহামারিতে টিভি দেখতে চাই কেবল অপারেটরের সুরক্ষা
প্রকাশিত : ১০:৫৩, ২৩ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১২:৫৭, ২৩ এপ্রিল ২০২০
লুৎফর রহমান নাসিম
মিন্টো রোডে একজন মন্ত্রীর বাসায় টেলিভিশন দেখা যাচ্ছে না। যথারীতি অভিযোগের ফোন। অনুমান করলাম, ঝড়ো হাওয়ায় লাইনটি ডিসকানেক্ট হয়ে গেছে।
ঘটনাটি জানার পর, তাৎক্ষণিক আমাদের ইউনাইটেড কমিউনিকেশন সার্ভিসেস লিমিটেড-ইউসিএসের সংশ্লিষ্ট অপারেটরকে পাঠানোর উদ্যোগ নিই। কাঙ্খিত যন্ত্র আর কিছু টুলস নিয়ে সে যাত্রা শুরু করলো মিন্টো রোডে। কিন্তু কুড়ি মিনিটের মাথায় ফোন পেলাম। কারণ, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছাড়ানোর পর পুলিশ ব্যারিকেড ওকে আটক করেছে।
প্রবল বাধার মুখে পড়েছে ইউসিএস অপারেটর। লকডাউনের মধ্যে তাকে আর মুভ করতে দেয়া হয়নি। অথচ আমাদের উপর চটে আছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়। কারণ বিশেষ ব্যবস্থায় তার বাসার কেবল সমস্যা মেটাতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল।
ঘটনাটি তিন দিন আগের। কিন্তু লকডাউন পরবর্তী গেল এক সপ্তাহে এমন বাধার মুখে পড়েছে অসংখ্য কেবল অপারেটর আর মাঠকর্মীরা। সারাদেশে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। গ্রাহকের সঙ্গে একটি দূরত্বও তৈরি হচ্ছে আমাদের। এমনকি অভিযোগ এসেছে টেলিভিশন অফিস থেকেও।
কারণ কাঙ্খিত টিভি দেখতে না পেয়ে গ্রাহক চটে গিয়ে ফোন দিচ্ছেন টিভি অফিসে। সেখান থেকে আবার কল আসছে আমাদের কাছে। কিন্তু আমরা কোথাও দ্রুত সেবা দিতে পারছি, আবার কোথাও পারছি না। তবে এই পারছি না’র সংখ্যাটাই সবচেয়ে বেশি। কারণ লকডাউনে আমাদের কর্মীরা পুলিশি বাধার মুখে পড়ছেন। কোথাও কোথাও নাজেহালও হচ্ছেন।
ইউনাইটেড কমিউনিকেশন সার্ভিসেস লিমিটেডে একের পর এক এই নাস্তানাবুদের খবর আসছে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকেও।
সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহের উল্লেখ করার অর্থই হলো সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করা। করোনার এখন মধ্যম অবস্থা চলছে। বিশেষ সতর্কতা দেশজুড়ে। সেই হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবে এটাই স্বাভাবিক। তারা পাড়া-মহল্লায় দায়িত্ব পালন করছে বেশ সতর্ক অবস্থায়। অনাকাঙ্খিত কাউকে দেখলে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, বাধা দেবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু এটাও ঠিক যে, সেবাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেলায় তারা বেশ উদার হবেন। যেহেতু কেবল টিভি একটি সেবাধর্মী নেটওয়ার্ক। তারা মাঠে মুভ না করলে মানুষ টেলিভিশন দেখবেন কী করে। দর্শকেরা কিভাবে জানবেন দেশ কিংবা বিদেশের করোনা পরিস্থিতি।
শুধু তাই নয়, মহামারীর এই সময়ে জীবনরক্ষার একমাত্র মাধ্যমই হচ্ছে গণমাধ্যম। যা আমরা কেবল অপারেটররা অনেক পরিশ্রম করে সাধারণের ড্রয়িংরুমে পরিবেশন করে থাকি। আমজনতা বেশ আয়েশ করে সোফায় বসে তা দেখেন-শোনেন। খবর জানেন, খেলা দেখেন-শেখেন নিয়মআচার। এমনকি বাচ্চাদের স্কুলের পড়া-লেখাও হচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়।
স্বাস্থ্যসমাচার থেকে শুরু করে নাটক সিনেমা সবই উপভোগের ব্যবস্থা করি আমরা কেবল ব্যবসায়ীরা। বাসার টেলিভিশন বন্ধ তো কাঙ্খিত অনেককিছু থেকেই বঞ্চিত নাগরিকেরা।
এমন তো নয় যে, শুধু শহুরে লোকজনই এই সেবার স্টেক হোল্ডার। গ্রাম তো বটেই, দুর্গম চরেও রয়েছে আমাদের কেবল সেবা। তাই বৃহত্তর অংশের কথা বিবেচনা করে এই খাতকে জরুরি সেবার আওতায় আনার জন্য এ লেখার অবতারণা।
ঝড়-বৃষ্টি মহামারি সবসময়ই আমাদের এ সেবা অব্যাহত রয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা হয়। প্রথমবারের মতো ছুটির পর দ্বিতীয় দফায় ছুটির প্রজ্ঞাপন দেয় সরকার। তাতে যেসব জরুরি সেবা চালু রাখার প্রসঙ্গ এসেছিল, সেখানে কেবল সেবার ব্যাপারটি রীতিমতো অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু কেবল টিভি নেটওয়ার্ক জরুরি সেবার আওতায় না আনলে কর্মীরা কিভাবে কাজ করবে-সে প্রশ্ন ঘোরতরভাবে দেখা দিয়েছে করোনা দুর্যোগের এই সময়ে।
ধারণা করা হচ্ছে, লকডাউন আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। সেক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে ইউনাইটেড কমিউনিকেশন সার্ভিসেস লিমিটেডের দাবি, অবিলম্বে যেন এই নেটওয়ার্ককে জরুরিভাবে গুরুত্ব দিয়ে সেবার আওতায় আনা হয়।
ফায়ার সার্ভিস, ওষুধ, খাবার সরবরাহের মতো খবর ও বিনোদন সরবরাহের ক্ষেত্রেও রয়েছে আমাদের পরিপূর্ণ কর্মকাণ্ড। অপরাপর সব টেলিভিশনের সঙ্গে সারাক্ষণ যুক্ত থেকে আমাদের কর্মীরা বিভিন্ন মানুষের অফিস, ড্রয়িং রুম থেকে শুরু করে শোবার ঘর অব্দি পৌঁছে দিচ্ছে টেলিভিশন সেবা।
নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে অবশ্যই এই নেটওয়ার্কের কর্মীদের গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আশা করবো, পরবর্তী প্রজ্ঞাপনে কিংবা স্পেশাল কোনো অর্ডারে যেনো সেটি করা হয়।
সাধারণ নাগরিকদের সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করে কেবল অপারেটরদের সুরক্ষা করতে যেনো অবিলম্বে ব্যবস্থা নেন। পুরো বিষয়টি ইতোমধ্যে কেবল অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-কোয়াব সমন্বয় কমিটির আহ্বায়কসহ নেতৃস্থানীয়রা কথা বলেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে।
কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য, সরকারি প্রজ্ঞাপনে কেবল অপারেটরদের ব্যাপারটি উল্লেখ না হওয়া পর্যন্ত জরুরি খাতের আওতায় ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে দু’দিন আগে আমি কথা বলেছি তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের সাম্প্রতিক অসুবিধার কথাগুলো শুনলেন। বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কথা বলে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের আশ্বাসও দিলেন। কিন্তু এ প্রজ্ঞাপন জারি কবে হবে, তা স্পষ্ট নয়।
অথচ প্রতিনিয়তই আমাদের কর্মীরা নানামুখি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। নাজেহাল হচ্ছেন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে। ঢাকার বাইরে নিগৃহিতও হয়েছেন বেশ ক’জন। অথচ বাংলাদেশের বৃহত্তম এলাকায় ইউনাইটেড কমিউনিকেশনস সার্ভিসেস লিমিটেড ডিস লাইনের মাধ্যমে বিশেষ সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
ইউসিএস রাজধানী ঢাকার প্রায় ৫৮ থেকে ৬০ শতাংশ এলাকায় কেবল সেবা দিয়ে থাকে। সেখানেও চলতে-ফিরতে নানামুখি বাধার শিকার হচ্ছেন আমাদের কর্মীবৃন্দ।
রাষ্ট্রপতির বাসভবন-বঙ্গভবনেও ইউসিএসের নেটওয়ার্ক রয়েছে। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন-গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রী মহোদয়গণের বাসভবন, মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডে অবস্থিত অন্য ভিআইপিদের বাসভবন, সচিবালয়, পুলিশ সদরদপ্তর, বারিধারা, গুলশান, বনানীর মাল্টিন্যাশনাল অফিস, বিভিন্ন দূতাবাসেও রয়েছে ইউনাইটেড কমিউনিকেশন সার্ভিসেস লিমিটেডের কেবল সংযোগ।
পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ গ্রাহকের সংখ্যাও অনেক। যেকারণে আমাদের কেবল অপারেটর ও ফিড অপারেটরদেরকে যদি বিশেষ সুবিধা না দেয়া যায়, তাহলে ভিভিআইপি, ভিআইপি থেকে শুরু করে সবধরণের গ্রাহক কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। যেটি এই মহামারির সময়ে পরিলক্ষিত।
অথচ, এমন এক ভয়ঙ্কর পরিবেশে আমাদের সেবা দিতে হচ্ছে যখন আমরা গ্রাহকের কাছ থেকে কোনো ধরণের পাওনা টাকাও পাচ্ছি না। কারণ অনেকেই ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। যারা আছেন, তাদের একটি বড় অংশ লকডাউনে। অন্যদের মূল গেট তালাবদ্ধ। সেকারণে আমাদের অপারেটর ও মাঠকর্মীরা গ্রাহকের কাছ থেকে পাওনা টাকাও তুলতে পারছেন না।
উপরন্তু করোনার কারণেই সেবার ধারাবাহিকতা ও মান যারপরনাই বৃদ্ধি করা হয়েছে। কারণ সাধারণ মানুষ এখন সকাল-সন্ধ্যায় বসে আছেন টিভির সামনে। জানছেন বিশ্ব করোনা পরিস্থিতি। আমাদের কর্মীরা স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের হয়ে এই লকডাউনের মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে গ্রাহকের ফোন পেয়ে ছুটে যাচ্ছেন বাসা কিংবা অফিসে।
পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস, স্যানিটাইজারসহ নিত্যকার পোষাক পরিবর্তনের জন্য তাদের পেছনেও আমাদের বাড়তি খরচ হচ্ছে। তারপরও তারা পথিমধ্যে নাজেহাল হচ্ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে ব্যারিকেডে। অথচ তাদের কোনো গাফিলতি কিংবা গ্রাহকের বাসাবাড়িতে যাওয়া দেরি হলে টেলিভিশন দেখা বন্ধ থাকে।
সেখানেও প্রশ্নের মুখোমুখি। তাই কেবল টিভি সেবা সচল রাখার জন্য তাদেরকে বিশেষ জরুরি সেবার আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি মাঠকর্মীদের যাতে নাস্তানাবুদ-নাজেহাল করা না হয় তার জন্যও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও নির্দেশ প্রার্থনা করছি।
এ ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট দাবিসমূহ-
ক. জরুরি পরিষেবার মধ্যে কেবল টিভি সেবাকে অন্তর্ভূক্ত করে অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
খ.দেশব্যাপী সেবা সচল রাখতে বিভিন্ন জেলা উপজেলায় নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে কেবল টিভি যন্ত্রাংশের দোকান খোলা রাখতে হবে। অন্যথায়, কোনও গ্রাহকের বাসা কিংবা অফিসের কোন যন্ত্রাদী নষ্ট হয়ে গেলে তা সহসা সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে না। বন্ধ থাকবে সেবা কার্যক্রম। বন্ধ থাকবে টেলিভিশন দেখা। একইভাবে নির্দিষ্ট সময়ে কেবল টিভির প্রতিষ্ঠান খোলারও সুযোগ দিতে হবে। নইলে মনিটরিং করা সম্ভব নয়।
গ.জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপদকালীন কেবল অপারেটরা টিভি গ্রাহক সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন। বিধায় তাদেরকে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অবিলম্বে যেন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ঘ.টিভি গ্রাহকদের কাছে আমাদের আহ্বান থাকবে, দুর্যোগের এই সময়ে নিজ তাগিদে তারা যেন ব্যাংক, বিকাশ কিংবা সহজ কোনো পন্থায় মাসিক ভাড়া বা বকেয়া পরিশোধ করেন।
ঙ.টেলিভিশন সাংবাদিকবৃন্দ ও তাদের মালিকপক্ষ বিশেষ করে এ্যাটকো এ ব্যাপারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াবেন।
চ.বাণিজ্য ও তথ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কেবল টিভি সচল রাখতে অচিরেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করতে সক্ষম হবে।
লেখক: লুৎফর রহমান নাসিম-পরিচালক, ইউনাইটেড কমিউনিকেশন সার্ভিসেস লি. ইউসিএস।
এআই/