ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৮ অক্টোবর ২০২৪

আবেগময় সেই ভাষণ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:২৭, ১০ জানুয়ারি ২০২২

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার মাটি হানাদারমুক্ত হলেও যার ডাকে ধরা দেয় আরাধ্য স্বাধীনতা, সেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানে কারাবন্দি।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বিশ্ব জনমতের চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। মুক্তির পর তিনি লন্ডন যান। সেখান থেকে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে ১০ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছান।

সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্যরা সংবর্ধনা দেন বঙ্গবন্ধুকে। পরে সেদিন দুপুরে ঢাকা এসে পৌঁছান জাতির জনক।

বিমানবন্দর থেকে লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পৌঁছান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে সমবেত জনতার সামনে অশ্রুসজল চোখে আবেগময় ভাষণে তিনি বলেন, মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও দেশ, দেশের মানুষই ছিল তার চিন্তা-চেতনায়, মননে।   
     
যা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেদিন-
“আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সেপাই, পুলিশ, জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে। যাদের হত্যা করা হয়েছে, আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করি।

আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। 

আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী, যেভাবে সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না।

আমি আমার সেই যেই ভাইয়েরা আত্মহুতি দিয়েছে, শহীদ হয়েছে, তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

আজ প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে বাংলায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ, এত সাধারণ জনগণ মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই, যা আমার সাত কোটির বাংলাদেশে হয়েছে। 

আমি জানতাম না, আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও, কোনো আপত্তি নাই। মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙ্গালির কাছে দিয়ে দিও, এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।

আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনসাধারণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই জার্মানি, ব্রিটিশ, ফ্রান্স সব জায়গার জনগণকে, তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই যারা আমাকে সমর্থন করেছে।

আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই বিশ্বদুনিয়ার মজলুম জনগণকে, যারা আমার এই মুক্ত সংগ্রামকে সাহায্য করেছে। আমার বলতে হয়, এক কোটি লোক এই বাংলাদেশ থেকে ঘর বাড়ি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের জনসাধারণ, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাদের খাবার দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের আমি মোবারকবাদ না দিয়ে পারি না। যারা অন্যরা সাহায্য করেছেন তাদের মোবারকবাদ দিতে হয়।

তবে মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি বলেছিলাম যাবার আগে, ‘ও বাঙালি এবার তোমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার করো, তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করে সংগ্রাম করেছ। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, আমার বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই, তাদের আমি দেখব না। আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়া অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি, বোধহয় তার জন্যই আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।

আমি আশা করি, দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন যে, আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার জনগণের খাবার নাই, আমার মানুষ গৃহহারা-সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই।

দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও। দিতে হবে, উপায় নাই দিতে হবে। আমি-আমরা হার মানব না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- সাত কোটি বাঙ্গালির হে বঙ্গ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নাই।

কবিগুরু মিথ্যাকথা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে, দুনিয়ার ইতিহাসে স্বাধীনতার সংগ্রামে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি, আমায় দাবায় রাখতে পারবে না।

আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় । আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই।

এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায়, কাজ না পায়।

মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কর্মী বাহিনী তোমাদের মোবারকবাদ জানাই, তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ। রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।

একটা কথা, আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যে লোকরা আছে, অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, যারা বাংলায় কথা বলে না তাদের বলছি, তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি তাদের উপর হাত তুলো না। আমরা মানুষ, মানুষ ভালোবাসি।

তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে, স্বাধীন নাগরিকের মত, স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখায় দেবার চাই দুনিয়ার কাছে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।

আমায় আপনারা পেয়েছেন, আমি আসছি। জানতাম না, আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে, আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোদা হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান; একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব, আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাব না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না। এবং যাবার সময় বলে যাব জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।

ভাইয়েরা আমার, যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে, আপনারা জানেন। আমি সমস্ত জনসাধারণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই, জমিতে যাও ধান বুনো। কর্মচারীদের বলে দিবার চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না। মনে রাখবেন, তখন সুযোগ ছিল না, আমি দোষ ক্ষমা করব না।

ভাইয়েরা আমার, যাওয়ার সময়, যখন আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাজউদ্দীন, নজরুলেরা আমাকে ছেড়ে যায়, আমি বলেছিলাম ৭ কোটি বাঙালির সাথে আমাকে মরতে ডেক না। আমি আশীর্বাদ করছি, তাজউদ্দিন ওরা কাঁদছিল। তোরা চলে যা, সংগ্রাম করিস, আমার আস্থা রইল, আমি এই বাড়িতে মরতে চাই। এই হবে বাংলার জায়গা, এখানেই আমি মরতে চাই, ওদের কাছে মাথানত করে আমি পারব না।

ভাইয়েরা আমার, ডা. কামালকে নিয়ে ৩ মাস পর্যন্ত সেখানে ইন্টারোগেশন করেছে, মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দাও, কয়েকজন বাঙালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে, তাদের আমরা জানি এবং চিনি, তাদের বিচার হবে। 

আর আমি বক্তৃতা করতে পারছি না। আপনারা বুঝতে পারেন- ‘নম নম নম সুন্দরী মম জননী জন্মভুমি গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবনও জুড়ালে তুমি’।

আজ আমি যখন ঢাকায় নামছি, তখন আমি চোখের পানি রাখতে পারি নাই। আমি জানতাম না, যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এত ভালোবাসি, যে বাংলাদেশকে এত ভালোবাসি, সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি, আমার ভাইদের কাছে, আমার মাদের কাছে, আমার বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন।

আমি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি, তোমরা সুখে থাকো। তোমাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণা নাই। তোমাদের আমরা শ্রদ্ধা করতে চেষ্টা করব। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে, আমার মা বোনদের রেপ করেছে, আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে, যাও সুখে থাকো, তোমরা সুখে থাকো। তোমাদের সাথে আর না, শেষ হয়ে গেছে, তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।

তোমাদের সঙ্গে আমার স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বন্ধু হতে পারে, তাছাড়া বন্ধু হতে পারেনা। তবে যারা অন্যায়ভাবে, অন্যায় করেছে তাদের সম্বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হবে। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই, আরেকদিন আমি বক্তৃতা করব কিছুদিন পরে, একটু সুস্থ হয়ে লই। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমি সেই মুজিবর রহমান আর নাই। আমার বাংলার দিকে চাইলে দেখেন সমান হয়ে গেছে জায়গা, গ্রাম, গ্রাম পোড়ায়ে দিয়েছে, এমন কোন ফ্যামিলি নাই যার মধ্যে আমার লোককে হত্যা করা হয় নাই।

কতবড় কাপুরুষ যে নিরপরাধ লোককে এভাবে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর লোকেরা, আর তারা বলে কি আমরা পাকিস্তানের মুসলমান সামরিক বাহিনী। ঘৃণা করা উচিত, জানানো উচিত, দুনিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে বাংলাদেশই দ্বিতীয় মুসলিম কান্ট্রি, মুসলমান বেশি, দ্বিতীয় স্থান। আর ইন্ডিয়া তৃতীয় স্থান, আর পশ্চিম পাকিস্তান চতুর্থ স্থান।

আমরা মুসলমান, মুসলমান মা বোনদের রেপ করে? আমরা মুসলমান। আমার রাষ্ট্রে এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যারা জানতে চান, আমি বলে দিবার চাই, আসার সময় দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমি আপনাদের বলতে পারি, যেহেতু আমি জানি তাকে, আমি তাকে আমি শ্রদ্ধা করি, সে পন্ডিত নেহেরুর কন্যা, সে মতিলাল নেহেরুর ছেলের মেয়ে। তারা রাজনীতি করেছে, ত্যাগ করেছে, তারা আজকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। যেদিন আমি বলব, সেইদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু কিছু সরায় নিচ্ছেন।

তবে যে সাহায্য করেছেন, আমি আমার ৭ কোটি দুঃখি বাঙালির পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে, তার সরকারকে, ভারতের জনসাধারণকে মোবারকবাদ জানাই, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই।

ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনও রাষ্ট্রপ্রধান নাই, যার কাছে তিনি আপিল করেন নাই যে, শেখ মুজিবকে ছেড়ে দাও। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে বলেছে, তোমরা ইয়াহিয়া খানকে বল শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়ার জন্য, একটা রাজনৈতিক সল্যুশন করার জন্য।

এক কোটি লোক মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য দেশে চলে গেছে। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে লোকসংখ্যা ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ। শতকরা ৬০টা রাষ্ট্র আছে, যার জনসংখ্যা এক কোটির কম। আর আমার বাংলা থেকে এক কোটি লোক মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভারতে স্থান নিয়েছিল। কত সেখানে অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছে, কত না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে। কত ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এই পাষণ্ডের দল।

ক্ষমা করো আমার ভাইয়েরা, ক্ষমা করো। আজ আমার কারও বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নাই, একটা মানুষকে তোমরা কিছু বলো না, অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দিব। আইনশৃঙ্খলা তোমাদের হাতে নিও না। 

মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো, ছাত্রসমাজ তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো, শ্রমিকসমাজ তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো, কৃষকসমাজ তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো। বাংলার হতভাগ্য হিন্দু-মুসলমান আমার সালাম গ্রহণ করো।

আর আমার কর্মচারী পুলিশ, ইপিআর যাদের উপর মেশিনগান চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যারা মা বোন ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে, তার স্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে কুর্মিটোলা নিয়ে যাওয়া হয়েছে তোমাদের সকলকে আমি সালাম জানাই, তোমাদেরকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।

নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে। এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য, আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি, এই আশীর্বাদ, এই দোয়া আপনারা আমাকে করবেন।

এই কথা বলে আপনাদের কাছে থেকে বিদায় নিবার চাই। আমাদের সহকর্মীদের আমি সকলকে ধন্যবাদ জানাই। যাদের আমি যে কথা বলে গিয়েছিলাম, তারা সকলে একজন একজন করে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে, না, মুজিব ভাই বলে গিয়েছে তোমরা সংগ্রাম করো, তোমরা স্বাধীন করো, তোমরা জান দাও, বাংলার মানুষকে মুক্ত করো।আমার জন্য চিন্তা করো না, আমি চললাম। যদি ফিরে আসি, আমি জানি আমি ফিরে আসতে পারব না।  

কিন্তু আল্লাহ আছে, তাই আজ আমি আপনাদের কাছে ফিরে এসেছি। তোমাদের আমি, আমার সহকর্মীরা তোমাদের আমি মোবারকবাদ জানাই। আমি জানি, কি কষ্ট তোমরা করেছ। আমি কারাগারে ছিলাম, নয় মাস পর্যন্ত আমাকে কাগজ দেওয়া হয় নাই। এ কথা সত্য আসার সময় ভুট্টো সাহেব আমাকে বলেছিলেন, শেখ সাব চেষ্টা করেন, দুই অংশের কোনো একটা বাঁধন রাখা যায় কিনা। আমি বললাম, আমি কিছু বলতে পারি না, আমি কোথায় আছি জানি না। আমার বাংলা, আমার মাটিতে গিয়ে আমি বলব।আজ বলছি, ভুট্টো সাহেব, সুখে থাকো, বাঁধন টুটে গেছে, আর না। তুমি যদি কোনও বিশেষ শক্তির সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে, আমার বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে চাও, এবার মনে রেখ, এবার দলের নেতৃত্ব দিবে শেখ মুজিবুর রহমান, মরে যাবে স্বাধীনতা হারাতে দিব না।

ভাইয়েরা আমার, আমার ৪ লক্ষ বাঙালি আছে পশ্চিম পাকিস্তানে। আমি অনুরোধ করব, তবে একটা জিনিস আমি বলতে চাই, তোমাদের অ্যাপ্রুভাল নিয়ে, আমার সহকর্মীরা, ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অথবা ওয়ার্ল্ড জুরির পক্ষ থেকে একটা ইনকোয়ারি হতে হবে যে, কী পাশবিক অত্যাচার, কীভাবে হত্যা করা হয়েছে আমাদের লোকেদের, এ সত্য দুনিয়ার মানুষকে জানাতে হবে। আমি দাবি করব জাতিসংঘকে, ইমিডিয়েটলি বাংলাদেশকে আসন দাও এবং ইনকোয়ারি করো। 

ভাইয়েরা আমার, যদি কেউ চেষ্টা করেন, ভুল করবেন।আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই, সাবধান বাঙালিরা, ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই।

একদিন বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, বলেছিলাম? বলেছিলাম যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করো, বলেছিলাম? বলেছিলাম এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এই জায়গায়, ৭ই মার্চ তারিখে। আজ বলছি তোমরা ঠিক থাকো, একতাবদ্ধ থাকো, কারো কথা শুনো না।

ইনশাল্লাহ স্বাধীন যখন হয়েছি, স্বাধীন থাকব। একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে এই সংগ্রাম চলবে। আজ আমি আর বক্তৃতা করতে পারছি না। একটু সুস্থ হলে আবার বক্তৃতা করব। আপনারা আমাকে মাফ করে দেন। আপনারা আমাকে দোয়া করেন, আপনারা আমার সাথে সকলে আজকে একটা মুনাজাত করেন।” 
আল্লাহুম্মা আমিন...
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি