আগুনে ভষ্মীভূত ৪ পরিবারের স্বপ্ন
প্রকাশিত : ২৩:৩৪, ৩০ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৩৬, ৩১ মার্চ ২০১৮
সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে মৃত্যুরথের সারথি হলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান এবং দীপ্ত সরকার। পথ ধরলেন তাদের অকাল প্রয়াত সহপাঠী শাহীন ও তৌহিদুলের। আজ শুক্রবার বিকেলে সতীর্থদের হারানোর শোকে যখন তার সহপাঠীরা অশ্রু বির্জন দিচ্ছিলেন তখন আকাশের বুক ছিড়ে অঝোর ধারায় যেন কেঁদে উঠলো প্রকৃতি। সেই বৃষ্টি যেন স্বজন হারানোর শোকেরই বহিঃপ্রকাশ!
অঝোর বৃষ্টি ধারায় স্বজন সহপাঠীরা তাদের কাঁন্না লুকাতে পারলেও বেদনার দহন থেকে কি মুক্তি মিলবে? গতরাতেই শাহীনের মরদেহ তার আপন ঠিকানায় পৌঁছালো। তার কবরের কাঁচামাটি না শুকানোর আগেই ডাক এলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পাশের বিছানায় রেখে আসা দুই সতীর্থ দীপ্ত সরকার ও হাফিজুর রহমানের।
যেন কেউ কাউকে রেখে যেতে নারাজ! একসাথে বাঁচা মরার প্রতিশ্রুতিতে তারা যেন বদ্ধপরিকর! বড্ড অভিমান তাদের! চলে যাবার এমন কি তাড়া ছিল। কিন্তু কিছু অসাধু মানুষের অবহেলায় শিকারে পরিণত হতে হয়েছিল তাদের। স্বজন সহপাঠীরা আর কত কাঁদবে। কতজনের লাশ বহন করবে তারা। একের পর এক মৃত্যুর মিছিলে সামিল হলো চার চারটে তাজা প্রাণকে। মৃত্যু হলো চারটি পরিবারের অন্তরে লালিত করা স্বপ্নের।
রাতদিন এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে টাকা, রক্ত ও ঔষধসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করেও তিন বন্ধু হাফিজ, দীপ্ত ও শাহিনকে বাঁচাতে পারেনি তাদের পরিবারের সদস্য ও সতীর্থরা। এক ঝাঁক বন্ধুদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় তাদের বাঁচাতে চেষ্টা করলেও বন্ধুদের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
বার্ন ইউনিটের কর্তব্যরত চিকৎসক জানান, গতরাত থেকেই হাফিজুরের হৃদস্পন্দন কমে যেতে থাকে। পরে স্বজনদের অনুরোধে ডিজিটাল ইসিজি মেশিন এনে হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করা হয়। ততক্ষণে হাফিজ এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন আপন ঠিকানায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে স্বজনদের অনুমতি নিয়ে হাফিজের লাইফ সার্পোট খুলে দেওয়া হয়। এরপরে সকালে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে দীপ্ত সরকারের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। হৃদস্পন্দন কমে যাওয়ার পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকেও মৃত ঘোষণা করেন। টানা সাতদিন তাকে লাইফ সার্পোটে রাখা হয়। বিস্ফোরণে শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিতে পারছিলেন না দীপ্ত সরকার।
হাফিজ তার পরিবারের একমাত্র নির্ভরযোগ্য স্বপ্নের নাম ছিল। বড় ভাইয়ের গর্বের জায়গা ছিলেন তিনি। একদিন বড় প্রকৌশলী হবে-এটা তার এলাকার সবাই এ স্বপ্ন লালত করতেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল পুরো মান্দা উপজেলায়।
হাফিজুরের বড় ভাই রবিউল আর্তনাদ করে বলেন, ‘“ভাই কথা বল, মাকে কি জবাব দিব? এলাকার মানুষ আমাকে বলতো তোমার ভাই একদিন বিরাট ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমার ইঞ্জিনিয়ার ভাই আমাকে ছেড়ে কই গেল।”
তার মত মেধাবী ছেলেকে হারিয়ে নওগাঁর মান্দা উপজেলার পেটগ্রামে এখন শোকের মাতম চলছে। তার মৃত্যু সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজারো মানুষ তাকে এক নজর দেখার জন্যে অপেক্ষা করছে। ওই দিকে তার বড় ভাই রবিউল শোকে স্তব্ধ হয়ে আছে। তার বাবা বিল্লাল হোসেন সন্তান হারানোর বেদনায় মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। তার মা গ্রামের বাড়িতে ছেলের মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান হয়ে আছেন। আজ বিকেলে তাদের দু`জনের ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয় দুই মেধাবীর মরদেহ।
বিকেলে হাফিজুরের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার পেটগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করে। হাফিজের সহপাঠী তানভীর রিফাত ও তুষারসহ কুয়েটের বেশকিছু সহপাঠী মরদেহবাহী গাড়ির সাথে রয়েছেন।
একই সাথে দীপ্ত সরকারের মরদেহবাহী গাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার দীঘল গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করে। তার গ্রামের বাড়িতে মরদেহ পৌঁছানোর পরে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী তাকে সমাহিত করা হবে বলে জানিয়েছেন তার স্বজনেরা।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির বিভাগের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, “এই তিন শিক্ষার্থীর অবস্থা প্রথম থেকেই আশঙ্কাজনক ছিল। শাহিনের ৮৩ শতাংশ, দীপ্তের ৫৪ এবং হাফিজের ৫৮ শতাংশ পুড়ে তাদের সবারই শ্বাসনালী পুড়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় সাধারণত কোনো রোগীকে বাঁচানো খুবই কঠিন। চিকিৎসক হিসেবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের বাঁচানো গেল না। জীবন মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তার ইচ্ছার ব্যতিরেক কিছুই হয় না। ``
কুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুল জলিল বলেন, ``আমি সন্তান হারানোর বেদনা দগ্ধ। মেধাবী চার শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে তাদের পরিবার যেমন নির্ভরযোগ্য সন্তান হারিয়েছেন ঠিক একই সাথে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি দেশ চারজন সোনার ছেলে হারিয়েছে। আমরা কেবল নীরবে তাদের মৃত্যুর মিছিল দেখলাম, তাদের ফেরাতে কিছুই করতে পারিনি। স্বজন হারানোর বেদনা যে কত কঠিন তা আমি এখন উপলব্ধি করতে পারি। আমার একটাই চাওয়া, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমুলক বিচার হোক।``
নিহতদের বন্ধু তানভীর রিফাত বলেন, “আমরা পারলাম না তাদের ধরে রাখতে, সেই শক্তি আমাদের নাই, সেই শক্তি মানুষের নাই। জানি না তাদের পরিবার এই শোক কীভাবে সহ্য করবে। আমরা তাদের মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারিনি। সরি!
উল্লেখ্য, গত ২৪ মার্চ রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায় একটি ছয়তলা ভবনের তৃতীয় তলায় গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ছাত্র শাহীন মিয়া, হাফিজুর রহমান ও দীপ্ত সরকার। তাদের আরেক সহপাঠী তাওহীদুল ইসলাম অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান। বাকি তিনজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগেরে এই চার শিক্ষার্থীর অকাল প্রয়াণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিনদিনের শোক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
টিকে
আরও পড়ুন