আগরতলা মামলা বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিল : সেলিম
প্রকাশিত : ১৯:২০, ১৩ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ২৩:২৯, ১৪ আগস্ট ২০১৮
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ঐক্য ও স্বাধীনতার প্রতীক বলে স্বীকার করলেন কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। যিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে রাজধানীতে প্রথম যে প্রতিবাদ মিছিল হয় তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। অথচ তিনি কখনোই রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী ছিলেন না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সে সময়কার বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। তার সাক্ষাৎকারে একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের চিত্র উঠে এসেছে তেমনি দায়ী করা হয়েছে দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা শত্রুদেরকেও।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলাদেশের রাজনীতিতে কয়েক যুগ ধরে এক পরিচিত মুখ। কমিউনিস্ট পার্টির ( সিপবি) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এর আগে একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, ক্ষেতমজুর সমিতির সাধারন সম্পাদক ও সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ( ডাকসু) নির্বাচনে তিনি প্রথম ভিপি ( সহ সভাপতি) নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেে আপনার প্রথম পরিচয় কীভাবে, কখন, কোথায়?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: `বঙ্গবন্ধু` উপাধি লাভের অনেক অনেক আগেই যখন তিনি `শেখ সাহেব` বা `শেখ মুজিব` তখন থেকে তার নামের সঙ্গে বা কাজের সঙ্গে আমি পরিচিত। যদিও বা তখনো সামনাসামনি পরিচয় হয়নি। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন। আর আমার রাজনীতি হচ্ছে বাম ধারার রাজনীতি। যদিও বা পাকিস্তানের আইয়ুবী ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ধারা ও বামপন্থী ধারা একসঙ্গে সোচ্চার ছিল তবুও কখনো তাঁর (বঙ্গবন্ধু) সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ছয়দফা উথাপন করলেন তখন বেশ হৈচৈ শুরু হয়। বামপন্থীদের একটা অংশ ছয়দফাকে সিআইএ- প্রণীত দাবি বলে এড়িয়ে গেলেও অন্য অংশটি (আমরা), ন্যাপ (মোজাফফর) ছয়দফাকে সমর্থন দিই। আমাদের যুক্তি ছিল ছয়দফা একটি ন্যায্য দাবি। কিন্তু এটা মুক্তির সনদ নয়। তাই আমরা ছয় দফার পাশাপাশি শ্রমিক- কৃষকের দাবি সহ আরও বেশ কিছু দাবি তুলি। সেসব দাবির প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে এগার দফা দাবি নিয়ে গণঅভ্যুথান সংঘটিত হয়। যা বলছিলাম, যেহেতু আমরা ছয় দফাকে ন্যায্য দাবি কিন্তু মুক্তির সনদ নয় বলছিলাম, তাই প্রশ্ন উঠল আমাদের করণীয় কী? আমাদের পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত দিলেন, `তোমরা জনগণের সঙ্গে থাক`। জনগণের সঙ্গে থাকতে গিয়ে আমরা পিকেটিংএ বের হলাম। তারিখ হল ৭ জুন, ১৯৬৬। পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হই। রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হল। বখত সাহেব নামে একজন বিচারক সেখানে সামারী কোর্টের মাধ্যমে আমাদের দণ্ড নির্ধারন করলেন। আমাকে দেওয়া হলো এক মাসের কারাদন্ড। পাঠিয়ে দেওয়া হল কারাগারে। জেলখানায় নতুন কাউকে নিলে `কেস টেবিল`- এর সামনে আনা হয়। সেখানে নানা ধরনের ফর্মালিটি থাকে। আমরা কেস টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বসে সময় কাটাচ্ছি। কেস টেবিল যেখানে রাখা তার পাশে দেওয়াল। সেখানে ছোট একটি কাঠের দরজা। হঠাৎ সেই দরজাটি খুলে গেল। পাজামা- পাঞ্জাবি পড়া লম্বা চওড়া একজন বেরিয়ে এলেন। হাতে পাইপ। সঙ্গে সঙ্গেই পুরো কক্ষে এক ধরণের গুঞ্জন, আলোড়ন শুরু হল। বলাবলি শুরু হলো শেখ সাহেব আসছেন। আবার কেউ বললেন, শেখ মুজিব আসছেন। তিনি ( বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তখনো বঙ্গবন্ধু হননি।) দূর থেকে হাত নাড়লেন আমাদের দিকে তাকিয়ে। অনেকের মত আমিও দূর থেকে হাত নাড়ার ইশারা করলাম। এটা হচ্ছে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি ডাকসু ভিপি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনাকে দেখা সাক্ষাৎ করতে হয়েছে। তার আগে তাহলে এমন প্রক্ষাপট তৈরি হয়নি?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: না, ছয়দফা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাতারাতি তিনি এ অঞ্চলের কিংবদন্তিতে পরিণত হন। কিন্তু আমাদের আলাদা রাজনৈতিক ধারার কারণেই একসঙ্গে মেশা হয়ে উঠেনি। আমি আমার মত করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয় ১০ জানুয়ানি। তিনি যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। বিমান বন্দরে আরো অনেকের মত আমরা, আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ তাঁকে বরণ করতে যাই। সেখানে হাত মেলানোর সুযোগ হয়েছিল। আমি ডাকসু ভিপি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু চার বছর বেঁচে ছিলেন। এই সময়কালে তাঁর সঙ্গেে আমার যোগাযোগ নিত্য নৈমিত্তিক রুটিনে পরিণত হয়। ওনার গণভবনে (রমনা পার্কের উল্টোদিকে যেটা তখন ছিল) সেখানে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, কাজ করার সুযোগ বার বার পেয়েছি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বঙ্গবন্ধুকে `মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক` বলা হয়। আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মতাদর্শের অনেক পার্থক্য রয়েছে। সেই জায়গা থেকে তাঁকে মূল্যায়ন করুন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: এটা তো একশ’ ভাগ সত্যি কথা। অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সব জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ঐক্য সবসময় কর্মসূচির ভিত্তিতে হয়। একটা প্রতীকী নেতৃত্ব জনগণ নিজেরাই নির্মাণ করে নেয়। সেই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের ঐক্যের প্রতীক, আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। দুটো কারণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে নিজ মর্যাদায় অধিষ্টিত হতে পেরেছিলেন। এক, দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রাম, কারানির্যাতন, জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলা- তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন- যারা ভিত্তিতে তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা পাকিস্তানি শাসক গোষ্টীর কর্তব্য ছিল। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
আরেকটি ব্যাপার হলো ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে একটা আইনি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে দেশ পরিচালনা করেছেন। কবে ব্যাংক খুলবে, কখন অফিস আদালত বন্ধ থাকবে, রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা কী করবে সব তাঁর (বঙ্গবন্ধু) হুকুমে হয়েছে। শুধুমাত্র সামরিক প্রশাসন বাদে বাকি সব কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে ছিল। জনগণ কিন্তু তাঁর এই নেতৃত্ব সানন্দে মেনে নিয়েছে। এই অবস্থায় যখন ২৫ মার্চ রাতে ক্র্যাকডাউন হলো তখন তখন তাঁর নির্দেশ মাথায় রেখেই জনগণ অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আগে থেকেই কিন্তু তিনি পুরো জাতির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছিলেন। নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসেবেই আইনগত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তাঁকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। আইনগত ভিত্তি ও জনগণের ম্যান্ডেট সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু তখন একক নেতৃত্ব। তিনি তখন এতোটাই বিশাল মহীরুহ ধারে পাশে আর কেউ ছিল না। অতএব তিনি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক এ কথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ১৯৭৩ সালে আপনি ডাকসু ভবন থেকে নিজ হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলেছিলেন। যে নেতার নেতৃত্বে যুদ্ধ করলেন, দেশ পেলেন, তারই ছবি নামিয়ে ফেললেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভিয়েতনাম আমাদের পাশে ছিল। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা খুঁজে খুঁজে ভিয়েতনামের বই বের করে পড়তাম। গেরিলা যুদ্ধের জন্য ভিয়েতনাম ছিল আমাদের অাদর্শ। একটি স্লোগান আমরা প্রায়ই দিতাম ‘বিশ্ব জোড়া দুটি নাম, বাংলাদেশ আর ভিয়েতনাম’। ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু উত্তর ভিয়েতনাম ছিল স্বাধীন দেশ। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে উত্তর ভিয়েতনামের উপর মার্কিনিরা নতুন করে বোমা বর্ষণ করে। উত্তর ভিয়েতনাম ক্ষত বিক্ষত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এখানে যে গণহত্যা চলছিল ভিয়েতনাম তার প্রতিবাদ করেছিল। তাদের উপর যখন জোর করে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হল আমরা তার প্রতিবাদ করলাম। অনেকগুলো কর্মমূচি ঠিক করলাম। তার মধ্যে একটা হলো ১ জানুয়ারী ১৯৭৩ সালে বটতলা থেকে মিছিল নিয়ে আমেরিকান অ্যাম্বাসীতে গিয়ে স্মারক লিপি প্রদান করা। আমেরিকান অ্যাম্বাসী তখন ছিল মতিঝিলের আদমজীতে। প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে ছিল মার্কিন তথ্যকেন্দ্র অফিস ইউএসআইএস। আমরা যখন মিছিল নিয়ে ইউএসআইএস- এর সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে মতিউর ইসলাম ও মির্জা আবদুল কাদের নামে দু`জন ছাত্র ঘটনাস্থলে নিহত হন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হল, ছাত্ররা বেপরোয়ারা আচরণ করছিল। পুলিশ আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য গুলি চালাতে বাধ্য হয়। পুলিশ তো এটার জন্য কোন দু:খপ্রকাশ করলই না, বরং সব দায় চাপিয়ে দিল ছাত্রদের উপর। আমরা হত্যার প্রতিবাদে পরের দিন হরতাল ডাকি। পরেরদিন সরকারের বিবৃতি বেরিয়েছি। আমরা হরতালের পর পল্টনে জনসভা করি। জনসভায় আমরা কতগুলো দাবি দিই। দাবি দেওয়ার আগে জনসভায় আমি বলি, ‘যার হাত সন্তানের রক্তে রঞ্জিত, তিনি পিতৃত্বের দাবি করতে পারেন না। যতোক্ষণ তিনি দু:খ প্রকাশ না করছে ততক্ষন তাকে কেউ জাতির পিতা বলবেন না।’ পাশাপাশি আরেকটি ঘোষণা আমি মাইকে দিই। সেটি হলো, ‘আজীবনের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকসু`র সদস্যপদ স্থগিত ঘোষণা করা হল।’ সেই পরিপ্রেক্ষিতেই অনেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলা শুরু করে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সেদিনের সেই ঘোষণার জন্য কী আপনার মধ্যে অনুশোচনা কাজ করছে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: একটা কথা বলতেই হয়, আমি এবং আমার সংগঠন সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। পুলিশ যখন দু`জন ছাত্রকে শুধু শুধু গুলি করে হত্যা করল সেটা যেমন আমরা মেনে নিইনি তেমনি বঙ্গবন্ধুকে যখন তার পরিবারের সব সদস্যসহ হত্যা করা হল তখনো কিন্তু আমরা মেনে নিইনি। আমি ও আমার সংগঠন তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজধানীতে প্রথম যে প্রতিবাদ মিছিল হয় সেটা কিন্তু আমরা করেছিলাম। তখন কিন্তু আওয়ামী লীগের কেউ রাস্তায় নামেনি। না বললেই নয়, ১ জানুয়ারির এ ঘটনার পর আমরা কিন্তু আন্দোলন থামাই নি। ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে, ন্যাপ অফিসে আগুন দেওয়া হয়। আমরা আন্দোলন কন্টিনিউ করি। আমাদের উথাপিত দাবি অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হয়। একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটা তদন্ত কমিটি করা হয়। আহত একজন ছাত্র (পরাগ মাহবুব)কে তার পরিবারের এক সদস্য ও একজন চিকিৎসক সহ বিদেশ পাঠিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে আনা হয়। আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ইউএসআইএস- এর কার্যালয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে স্থানান্তর করা হয়। আমি নিজে ওই ভবনে উঠে মার্কিন পতাকা নামিয়ে ফেলি। অকম্যুনিস্ট দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম ভিয়েতনামকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ সরকারের টাকায় ধানমন্ডিতে একটি বাড়ি ভাড়া করে ভিয়েতনামের দূতাবাস খোলার ব্যবস্থা করা হয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনার কথায় বুঝা যাচ্ছে তিনি প্রতিপক্ষের আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: তিনি আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অনেকগুলো দাবি মেনে নিয়েছিলেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, মুক্তিযুদ্ধের ধারার পক্ষে তিনি যতোগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সব ছিল ইতিবাচক।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে পেয়েছেন। কয়েকটা ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: অনেক অনেক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যের ঘটনাগুলো লিখতে গেলে বড় বই হবে। স্বল্প পরিসরে তো সেটা সম্ভব না। শুধু একটা ঘটনা বলি। দুপুর বেলা গণভবনে তিনি খেতে বসছেন (রমনার উল্টো দিকের গেটে যেটা ছিল।) টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খাবার বের করছেন। কাতলা মাছের ঝোল, ডাল, সবজি, কী একটা ভাজি ইত্যাদি। আমাকে বললেন, ‘তোমার ভাবীর হাতের রান্না ছাড়া খেতে কষ্ট হয়। তাই রোজ বাসা থেকে খাবার পাঠিয়ে দেয়।’ আমি বললাম, ‘আপনি তাহলে ভাবীকে ৩২ নাম্বারে রেখেছেন কেন? গণভবনে নিয়ে আসলেই তো পারেন।’ বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, ‘আমি আজ প্রধানমন্ত্রী আছি। কাল তো প্রধানমন্ত্রী নাও থাকতে পারি। তখন তো আমি গণভবনে থাকতে পারব না। এই এসি তো তখন তোমার ভাবী পাবে না। এই আরাম আয়েশে যদি ওরা অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন তো পরে কষ্ট পাবে। একজন সরকার প্রধানের এত বড় চিন্তায় আমি বিস্মিত হই। আমার মনে হয় না এদেশে অন্য কোন ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ এরকম বড় চিন্তা করতে পারবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ১৫ আগস্টের কুশীলবরা এখনো সুবিধা ভোগ করছে। এটাকে কী আপনি রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা বলবেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: দৃশ্যমান ঘাতকদের বিচার কার্যকর করা হয়েছে। এটা শেখ হাসিনা সরকারের বড় সফলতা। তবে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রটা এই বিচারের আওতায় আসেনি। ১৫ আগস্ট কোন ছোট ঘটনা নয়। অনেক বড় বড় নাটের গুরু এটার সঙ্গে জড়িত। এটার ক্ষেত্রে আমেরিকার ভূমিকা কী, অন্য রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা কী - কারা কারা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে জড়িত, আন্তর্জাতিক অাইন এক্ষেত্রে কী বলে সবকিছু উঠে আসা এখন সময়ের দাবি। কেউ আইনের উর্দ্ধে নয়। খন্দকার মোশতাকের পেছনে কারা ছিল সেটা বের হওয়ার বিষয়। খন্দকার মোশতাকের কেবিনেটে যারা স্বত:স্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিল তারা কিন্তু আওয়ামী লীগের কেবিনেট। জাতীয় চারনেতা ও হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া আর সবাই মোশতাকের কেবিনেটে গিয়েছিল। প্রশাসনের সব অফিসাররা গিয়ে মোশতাকের কাছে আনুগত্য দেখিয়েছে। মোশতাক একটা সংসদীয় সভা ডেকেছিল। আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে আওয়ামী লীগের এমপিদের নিষেধ করেছিলাম সেই সভায় না যাওয়ার জন্য। তারা হাসাহাসি করে বলেছে, কী বলেন? বঙ্গবন্ধু হয়তো নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তো আছে। আমরা যদি না যাই তাহলে তো আমও যাবে ছালাও যাবে। আশ্চর্য্য হতে হয়, তারা তখন আম ছালা নিয়ে চিন্তা করছে। তবে অনেক সাহসী আওয়ামী লীগার ছিলেন। তাদের নাম আজকাল উচ্চারণ হয় না। আনোয়ার চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নামে একজন ছিলেন পাবলিকেশন সেক্রেটারী, শামসুদ্দীন মোল্লা, এখলাসউদ্দিন। ওনারা প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস তাদের ধারণ করেনি। সুবিধাবাদীদের ভিড়ে তারা হারিয়ে গেছেন।
আ আ / এআর/
আরও পড়ুন