দক্ষিণ এশিয়ার ৬০ কোটি শিশুর ভবিষ্যৎ সুরক্ষা জরুরি: ইউনিসেফ
প্রকাশিত : ১৭:৩২, ২৪ জুন ২০২০
দক্ষিণ এশিয়ায় গত কয়েক দশকে শিশু স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও কোভিড-১৯ মহামারীর আঘাতে এই অঞ্চলের লাখ লাখ পরিবার আবারও দারিদ্র্যে ডুবে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে ইউনিসেফ। এই অঞ্চলের লাখ লাখ পরিবারের পুনরায় দারিদ্র্যে নিপতিত হওয়া ঠেকাতে সরকারগুলোকে অবশ্যই জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও উল্লেখ করে সংস্থাটি।
বিশেষ করে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যার আবাস এই অঞ্চলে মহামারী দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকায় ৬০ কোটি শিশুর ওপর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে জাতিসংঘের সংস্থাটি। দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জ্যাঁ গফ বলেন, ‘লকডাউন এবং অন্যান্য পদক্ষেপসহ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে মহামারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নানাভাবে শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। তবে শিশুদের ওপর অর্থনৈতিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হবে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন মাত্রায়। এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নিলে কোভিড-১৯ পুরো একটি প্রজন্মের আশা ও ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিতে পারে।’ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, টিকাদান, পুষ্টি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে, যা পরবর্তী ছয় মাসে ৪ লাখ ৫৯ হাজার শিশু ও মায়ের জীবন হুমকির মুখে ফেলেছে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচিতে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেয়, তা সত্ত্বেও লকডাউনের সময় পরিষেবা প্রাপ্তির সীমিত সুযোগ এবং অভিভাবকদের সংক্রমণের আশঙ্কার কারণে এপ্রিল মাসে কেবলমাত্র অর্ধেক শিশু তাদের নিয়মিত টিকা নিতে পেরেছে। ইউনিসেফ সারাদেশে স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অপুষ্টির চিকিৎসায় ব্যবহৃত থেরাপিউটিক দুধের নতুন চালান সরবরাহ করেছে, যদিও তীব্র অপুষ্টিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের সেবা গ্রহণের হার জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জন হপকিন্স ইউনিভারসিটি ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথ কর্তৃক মে মাসে প্রকাশিত একটি স্টাডি অনুযায়ী মহামারির পরোক্ষ কারণে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আগামী ছয় মাসে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৮ হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হতে পারে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি তোমু হোজুমি বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলার পাশাপাশি বাংলাদেশেও এর ক্রমবর্ধমান ক্ষতির প্রেক্ষাপটে শিশুদের ওপর এর প্রভাবে ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের জীবন রক্ষাকারী টিকাদান কার্যক্রম এবং পুষ্টিজনিত সেবা অব্যাহত রাখতে হবে এবং যেহেতু বাবা-মায়েরা এসব সেবা অনুসন্ধান করে এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা প্রদান করে, তাই বাবা-মা স্বাস্থ্যকর্মী- উভয় শ্রেণিই যাতে নিরাপদে থাকে এবং নিরাপদ বোধ করে সেটাও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমাদেরকে স্কুলগুলোকেও যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদে পুনরায় চালু করতে হবে এবং শিশুদের জন্য হেল্পলাইনগুলোকেও আমাদের চালু রাখতে হবে। ইউনিসেফ এই সব ক্ষেত্রেই সরকারকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।’
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে: শ্রীলঙ্কায় ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩০ শতাংশ পরিবারের খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কমে গেছে। বাংলাদেশে, দরিদ্রতম কিছু কিছু পরিবার প্রতিদিনের তিন বেলার খাবার যোগাড় করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ৪৩ কোটিরও বেশি শিশুকে দূরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে, যা কেবলমাত্র আংশিকভাবে প্রয়োজন মেটাতে পেরেছে; অনেক পরিবারের, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে, বিদ্যুৎ সংযোগই নেই, সেখানে তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের তো সুযোগই নেই। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সুবিধাবঞ্চিত অনেক শিশু কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই স্কুলের বাইরে থাকা প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ শিশুর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
ঘরে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় সহিংসতা ও নিগ্রহের শিকার অনেক শিশুর কাছ থেকে ফোনের হেল্পলাইনগুলোতে আসা অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। কিছু সংখ্যক শিশু হতাশায় ভুগছে, যার ফলশ্রুতিতে এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টাও করছে। বাংলাদেশে শিশুদের জন্য চালু করা একটি হেল্পলাইন কেবল এক সপ্তাহে সম্ভাব্য ছয়টি আত্মহত্যার ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, হাম, নিউমোনিয়া, ডিপথেরিয়া, পোলিও এবং অন্যান্য রোগের বিরুদ্ধে জীবন রক্ষাকারী টিকাদান কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে হবে, এবং একই সঙ্গে বিশ্বে মারাত্মক রুগ্নতায় আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি বা প্রায় ৭৭ লাখ শিশুকে সহায়তা করার জন্যও কাজ শুরু করা উচিত। হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং অন্যান্য শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়গুলো নিশ্চিত করে যত দ্রুত সম্ভব স্কুলগুলো পুনরায় খুলে দেওয়া উচিত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির বদৌলতে দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য খাতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমানোতে যে উন্নতি হয়েছে তা স্কুলের বাইরে থাকা শিশুর সংখ্যা ও শিশু বিয়ের সংখ্যা কমার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে দেখা দেওয়া অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা এই অঞ্চলজুড়ে পরিবারগুলোর ভীষণ রকমের ক্ষতি করছে। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং পর্যটন খাত থেকে আয় কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক হারে চাকরি হারানো ও আয় কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। ইউনিসেফের প্রক্ষেপন অনুযায়ী, আগামী ছয় মাসে আরও প্রায় ১২ কোটি শিশু দারিদ্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় নিপতিত হতে পারে, যা তাদের ইতোমধ্যে দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হওয়া ২৪ কোটি শিশুর কাতারে নিয়ে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর প্রভাব কমাতে সরকারগুলোর উচিত জরুরি সার্বজনীন শিশু সুবিধা ও স্কুল ফিডিং (স্কুলে খাবার দেওয়া) কর্মসূচিসহ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলোর দিকে অবিলম্বে আরও বেশি করে সম্পদ বরাদ্দ করা। গফ বলেন, ‘এখন এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকট থেকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে একটি স্থিতিস্থাপক ও টেকসই উন্নয়নের মডেলে রূপান্তরিত হতে সহায়তা করবে, যেখানে শিশুদের কল্যাণ, অর্থনীতি এবং সামাজিক সংহতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সুবিধা পাওয়া যাবে।’
প্রতিবেদনটি কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট শিশু-বিষয়ক সমস্যাগুলো সামাল দেওয়ার গুরুত্বকে তুলে ধরেছে, যার মধ্যে রয়েছে:
কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্য সামাজিক সেবা প্রদানে নিয়োজিত কর্মীরা যাতে নিরাপদে তাদের কাজ করতে পারে সেজন্য তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) প্রদান করা। স্বল্প প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়িয়ে গৃহভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা (উদাহরণস্বরূপ, কাগজ ও মোবাইল ফোন ভিত্তিক উপকরণের সমন্বয় ব্যহার করা) বিশেষ করে মেয়ে শিশু, দুর্গম এলাকা ও শহুরে বস্তিতে বসবাসরত শিশু এবং শারীরিকভাবে অক্ষম শিশুদের মতো ঝুঁকির মুখে থাকা শিশুদের জন্য। বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে পানি সরবরাহ, শৌচাগার ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক পরিষেবাগুলোর ব্যাপক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা। মহামারিটি ঘিরে যে কাল্পনিক ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য উঠে আসছে সেগুলো শনাক্ত করতে ধর্মীয় নেতা ও অন্য সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করা।
ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো হচ্ছে: আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা।
জুনের শুরুর দিকে এই অঞ্চলজুড়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কার্যক্রম চালানোর মধ্যেই ইউনিসেফ ও তার সরকারি ও অন্য সহযোগীরা: কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনো-সামাজিক সহায়তা নিয়ে শিশুসহ ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৮২০ জনের কাছে সেবা পৌঁছে দিয়েছে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত বিষয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ ও কমিউনিটি সম্পৃক্ত করার বিসয়গুলোতে প্রায় ১০ কোটি মানুষকে সম্পৃক্ত করেছে। সংক্রমণ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ওয়াশ সেবা এবং উপকরণ পৌঁছে দিয়েছে। শিশুদের পাশাপাশি অন্তঃসত্ত্বা ও বুকের দুধ খাওয়ানো নারীদের মাঝে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ শনাক্ত করতে, চিকিৎসার জন্য রেফার করতে ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে ১৪ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ইউনিসেফের সহায়তাপ্রাপ্ত কেন্দ্রসমূহে টিকাদান, প্রসবপূর্ব ও প্রসবোত্তর যত্ন, এইচআইভি যত্ন এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার পরিষেবাসহ অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছে ৭৩ লাখ নারী ও শিশুর কাছে।
এমএস/এসি
আরও পড়ুন