মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নে আরো বেশি অবদান রাখার আহ্বান রাষ্ট্রপতির
প্রকাশিত : ২০:২১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরো বেশি অবদান রেখে দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার আহবান জানিয়েছেন। আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ এক বাণীতে এ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে ১৯৭১ সালের এই দিনে আমরা বহু প্রতীক্ষিত বিজয় অর্জন করি। বিজয়ের এই আনন্দঘন মুহূর্তে আমি দেশবাসী ও প্রবাসে বসবাসরত সকল বাংলাদেশিকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন।’
রাষ্ট্রপতি বলেন, মহাকালের ইতিহাসে স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এ অর্জন জাতিকে এনে দিয়েছে একটি সার্বভৌম দেশ, স্বাধীন জাতিসত্তা, পবিত্র সংবিধান, নিজস্ব মানচিত্র ও লাল-সবুজ পতাকা। তবে তা একদিনে অর্জিত হয়নি। এ অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস।
তিনি বলেন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে বীজ উপ্ত হয়েছিল দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়। তাঁরই নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।
রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতাকে, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপতি আরো শ্রদ্ধা জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থক, বিদেশি বন্ধু, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যসহ সর্বস্তরের জনগণকে, যাঁরা মহান বিজয় অর্জনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। জাতি তাঁদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে জাতির পিতা সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। ডাক দিয়েছিলেন কৃষি বিপ্লবের। আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোর, লুটেরাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ তাঁর পরিবারের আপনজনদের নৃশংস হত্যাকান্ডের ফলে উন্নয়নের সেই গতি থমকে দাঁড়ায়। রুদ্ধ হয় গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। উত্থান ঘটে স্বৈরশাসন ও অগণতান্ত্রিক সরকারের। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশে আজ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত।
আবদুল হামিদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজকে পরিপূর্ণতা দানের লক্ষ্যে সরকার ‘ভিশন ২০২১’, ‘ভিশন ২০৪১’ এবং শতবর্ষ মেয়াদি ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ গ্রহণ করেছে। এসব পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো জাতিসংঘ ‘টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট ২০৩০’ অর্জনসহ ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। সরকারের গৃহীত জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি গ্রহণের ফলে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিগত বছরগুলোতে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বেড়েছে মাথাপিছু আয়, গড় আয়ুষ্কাল।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু এখন সমাপ্তির পথে। বাস্তবায়িত হচ্ছে মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী বহুমুখী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো মেগাপ্রকল্প। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ অভিজাত স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য। উন্নয়নের এ ধারাকে এগিয়ে নিতে সকলের সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন।
তিনি বলেন, সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’, জাতির পিতা ঘোষিত এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত ও নির্যাতিত লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী। তিনি এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য মিয়ানমারসহ জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানান।
রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশের প্রবাসী ভাইবোনেরা তাঁদের কষ্টার্জিত রেমিটেন্স দেশে প্রেরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। জাতি তাঁদের অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস মানবসভ্যতাকে ইতিহাসের এক চরম বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যু ও আক্রান্তের মিছিলে যোগ হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। মুখ থুবড়ে পড়েছে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি, কর্মহীন হয়ে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩১-দফা নির্দেশনা এবং সময়োচিত সিদ্ধান্তে এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। করোনাযুদ্ধে জয়ী হতে তিনি দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান।
আবদুল হামিদ বলেন, গোটা জাতি এ বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপন করছে। ২০২১ সালে উদযাপিত হবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দলমত নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠান দুটির উদযাপন বাঙালির ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করবে। তিনি বলেন, লাখো শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও বেশি অবদান রাখি, দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাই, গড়ে তুলি বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবের ‘সোনার বাংলা’। মহান বিজয় দিবসে এই আমার প্রত্যাশা।’
এসি
আরও পড়ুন