জাতির পিতার জন্মদিন ও নোট ছাপানোর আনন্দ কথা
প্রকাশিত : ১৩:৩২, ১৭ মার্চ ২০২১
১৯৯৮ সালের মধ্য নভেম্বরে হঠাৎ করেই আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে সদাশয় সরকার নিয়োগ দেয়। মনে পড়ে যায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ন্যক্কারজনক ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে জাতির পিতাকে হারানোর বেদনা। ওইদিনের পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে টুঁটি চেপে ধরে অবাধ পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থাপনা ফিরিয়ে এনে সোনার বাংলাকে আবারো রিক্ত করতে সচেষ্ট হয় ঘাতকরা। অবৈধ শাসকরা প্রত্যাহার করে নেয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি-সংবলিত সব কাগজের নোট। মনে মনে যে কয়টি সংকল্প নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুরূহ কাজটি শুরু করি, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি ছিল দেশের সব বৈধ কারেন্সি নোটে জাতির পিতার ছবি পুনঃস্থাপন করা।
১৯৯৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ৫০০ টাকাসহ সব নোটে জাতির পিতার ছবিসহ নোট ছাপানোর কাজ শুরু করা হয়। গাজীপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাঁকশাল ছাপাখানা ততদিনে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বেশকিছু দক্ষ জনবলে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। প্রথম দিকে কাউকে কিছু না বলে টাঁকশালে কর্মরত নকশাবিশারদ মাহমুদা খাতুনকে (আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কীর্তিমান বাঙালি অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা) ডেকে এনে নকশার খসড়া বানাতে অনুরোধ করি। আশ্চর্য কাকতাল! সহপাঠী বন্ধু রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ফাহমিদা খাতুন ঠিক সেই সময়েই ফোন করে বলে, ‘গাজীপুরে তোমাদের টাঁকশালে কর্মরত আমার ছোট বোন মাহমুদার চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে—বছরখানেকের জন্য তার অবসরে যাওয়ার তারিখটা কি পিছিয়ে দিতে পারো?’ ফাহমিদা জানতই না যে ওইদিন সকালেই মাহমুদা হাতে করে জনস্বার্থে তার চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর চিঠিখানা নিয়ে গেছে।
খুব যত্ন করে ৫০০ টাকার নোটে জাতির পিতার প্রতিকৃতিসহ নোট নকশার কয়েকটি নমুনা তৈরি করা হয়। এসব বিষয়ে মুস্তাফা মনোয়ারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি অল্প কয়েক দিন সময় নিয়ে আমাদের সঙ্গে সযতন আলাপ-আলোচনা শেষে রক্ষিত নমুনাটি চয়ন করে।
কালক্ষেপণ না করে অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়ার কাছে আমার প্রস্তাব এবং নোটের নকশাটি হাতে হাতে পেশ করি। তিনি সপ্রশংস চিত্তে তবে কিছুটা ভড়কে গিয়ে জানতে চান উদ্যোগটি ‘উপর’ থেকে এসেছে কিনা। নেতিবাচক উত্তর শুনে আমার সাহসের তারিফ করেছিলেন। নথিটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনবন্ধু শেখ হাসিনা এমপির অনুমোদন নিতে অর্থমন্ত্রীর কাছে রেখে আসতে চাইলে তিনি আমাদের হবিগঞ্জের ভাষায় বলেন, ‘ইতা কিতা কইন, আপনার সাহসী উদ্যোগের এই বিশাল কামের অনুমোদন নিজেই লইবা।’ শ্রদ্ধায় শির নত হয় আর বিস্ময়ে চিত্ত উষ্ণ। তার সংসদ ভবনের অফিসে মাননীয় সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার সামনে প্রস্তাবটি এবং নোটের নমুনা পেশ করি। খুবই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের মতোই জিজ্ঞেস করলেন, আবেগ ছাড়া অন্য কোন যুক্তিতে জাতির পিতার ফটোসংবলিত নোট ছাপানো হবে। বিজ্ঞানসম্মত উত্তর, যথা কাগজের মুদ্রায় ছবি একটি সুরক্ষাকবজের কাজ করে। কারণ নকল নোট প্রস্তুতকারকরা ফটোকপি করেই নোট বাজারে ছাড়ে। ফটোর শতভাগ অবিকল ফটোকপি সাধারণত হয় না বলেই এমনকি সৌদি আরবে বাদশা নামদারের প্রতিকৃতিসহ কাগজের মুদ্রা প্রচলিত রয়েছে।
প্রকল্প ও আমার চয়ন করা বঙ্গবন্ধুর ছবি, মুস্তাফা মনোয়ারের কমিটি মনোনীত এবং মাহমুদা খাতুন বিরচিত নকশা অনুযায়ী ৫০০, ১০০ ও ১০ মূল্যমানের নোট ছাপানোর জন্য কাগজ, কালি ও সুরক্ষা সুতা সরবরাহ করার জন্য বিধি ও রীতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হলো। দরপত্রগুলো বিবেচনা করে কোন কোনটির জন্য কোন কোনটিকে কার্যাদেশ দেয়া হবে তার জন্য নির্দিষ্ট করা টেন্ডার কমিটির সভা বসল গভর্নরের সভাপতিত্বে। তিনটি ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ দরদাতাকে চয়ন করতে হয় উত্কৃষ্টতম মান বিবেচনায়। এর মধ্যে একটি পার্শ্ব ঘটনা এত বছর পরও মনে দাগ কাটে। কমিটির অন্যতম সদস্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব চৌকস কর্মকর্তা জানিবুল হক আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ভাগ্নিজামাই। জানিবুল আমাকে একপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করে, ‘মামা, এই যে সর্বোচ্চ দর উদ্ধৃত প্রতিষ্ঠান তিনটিকে কার্যাদেশ দিতে সিদ্ধান্ত নিলে, তাতে তোমার জেলজুলুমের কথা মনে করে বুক কাঁপেনি।’ না, এ সিদ্ধান্ত নিতে আমি মোটেও দ্বিধা করিনি; কারণ একে তো দেশের সম্পদ হিসেবে নোট ছাপানো হচ্ছে, তা-ও আবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ। সর্বোচ্চ মানের উপকরণের জন্য সর্বোচ্চ মূল্য গুনতেই হবে। এতে ব্যক্তিগত ঝুঁকি থাকলেও করার কিছু নেই। উত্তর শুনে জানিবুল আশ্বস্ত ও খুশি হয়।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিসহ গভর্নরের দস্তখতে ৫০০ টাকা মূল্যমানের নোটটি বাজারে আসে ২০০০ সালের ১০ আগস্ট, ১০ টাকা মানের পলিমার নোট ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর এবং ১০০ টাকার কাগজের নোটটি আসে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ। জনগণ সাদরে গ্রহণ করে নোটগুলো। তার মধ্যে ব্যতিক্রমও দেখা দেয়। একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে খুবই ‘সম্ভ্রান্ত’ও এক বিত্তবান দম্পতির কর্তাব্যক্তি, যাকে জাতির পিতা ১৯৭২ সালে ডেকে এনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বানিয়েছিলেন, বেশ রূঢ়ভাবেই বললেন, ‘কী আশ্চর্য, আপনি শেখ মুজিবের ছবিসহ দেশের মুদ্রানোট ছাপানোর স্পর্ধা রাখেন। স্পষ্টত বোঝা গেল, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের মন্ত্রিসভার সদস্য ওই ভদ্রলোকের আনুগত্য তাকে যে বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী করে ফেলেছিল, তার রেশ তখনো কাটেনি। মনে মনে ভাবলাম, জাতির পিতার আদর্শের সন্তানকে অপমান ও চোখ রাঙানি সইতে পারার শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন। আবারো বলি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমি নিজেকে কারো চেয়ে খাটো মনে করি না।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও জাতির পিতার একান্ত সচিব
আরও পড়ুন